দেশে ২ মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৮৪৬

আগের সংবাদ

ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে সেমিতে অস্ট্রেলিয়া

পরের সংবাদ

শামসুর রাহমান ও জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশিত: নভেম্বর ৬, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ৬, ২০২১ , ১২:৪২ পূর্বাহ্ণ

ইংরেজি পরীক্ষায় ভালো করেছিলেন বলে পগোজ স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক চিন্তাহরণ বাবু সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছিলেন। টিচার্স রুমের এক কোণে একটা বাক্স ছিল, চিন্তাহরণ বাবু তার ওপর বসেই চিন্তামগ্ন থাকতেন, চেয়ারে বসতেন না। ইংরেজি ক্লাসে খোলামেলাভাবে এতই প্রশংসা করতেন যে, সহপাঠীরা শামসুর রাহমানকে ‘চিন্তাহরণ বাবুর জামাই’ বলে খ্যাপাতে শুরু করেন। সেই শামসুর রাহমান বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে পরীক্ষা-লাজুক হয়ে উঠলেন।
‘একাধিকবার পরীক্ষা অসম্পূর্ণ রেখে বাইরের খোলা হাওয়ায় বেরিয়ে পড়েছি কী এক অজানার টানে। আমার এই খামখেয়ালিপনা ও অস্থিরতার ফলে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স ডিগ্রি হাসিল করার সৌভাগ্য অর্জন করা সম্ভব হয়নি।’ ফলে বিএ পাস করে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে এমএতে ভর্তি হয়ে প্রথম পর্ব সাফল্যের সঙ্গে উতরে গেলেন এবং ‘প্রস্তুতি নিয়েও’ এমএ ফাইনাল দেয়ার জন্য আর পরীক্ষার হলমুখো হননি। ‘ছেঁড়াখোঁড়া’ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রজীবনে তাকে জুনিয়রদেরও সহপাঠী হতে হয়েছে- তাদের একজন আবুল মাল আবদুল মুহিত।
এই যে পরীক্ষার হলে যাওয়া এবং যেতে না চাওয়া এর পেছনের কারণ তার ভাষায় ‘স্বভাবদোষ’। আবুল আহসান চৌধুরীকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, এটা এক ধরনের কেয়ারলেসনেস : ‘কারণ ঠিক যতটা সিরিয়াসলি নেয়া উচিত ছিল পড়ালেখাটাকে বিশেষ করে পরীক্ষাকে, আমি সেটা নিইনি। ইংরেজিতে আমার অনার্স ছিল। আমি হয়তো দু-এক পেপার পরীক্ষা দিলাম, শোনা গেল যে ভালোই মার্কস পেয়েছি। কেন যে বাকি পরীক্ষাগুলো দিলাম না। যাই হোক পরে যখন দেখলাম যে ডিগ্রি নেয়া-ডিগ্রি পাওয়া যাবে না, তখন চট করে আবার পাস কোর্সে পরীক্ষা দিয়ে পাস করলাম। ডিগ্রি নেয়া হলো।’ (অন্তরঙ্গ শামসুর রাহমান, সাক্ষাৎকার, কবিকথন ২০১১) চল্লিশের দশকের শেষ ভাগের বিশ্বযুদ্ধোত্তর পূর্ব বাংলায় অক্সফোর্ড-খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন ১৯৪৭ সালে। বিশ্ববিদ্যালয় ভবন তখন দ্বিখণ্ডিত। অর্ধেকাংশজুড়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ। ক্ষতি পুষিয়ে দিয়েছে নামজাদা শিক্ষকদের পাঠদান ও তাদের স্নেহস্পর্শ। তাদের মধ্যে ছিলেন : এসএন ঘোষ (এসএনজি নামে পরিচিতি পেয়েছেন), এসএন রায়, অমলেন্দু বসু, বিসি রায়, অমিয়ভূষণ চক্রবর্তী প্রমুখ। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এসএনজির মাত্র দুটি লেকচার পেয়েছেন। শেকসপিয়ারের ট্র্যাজেডি নিয়ে তিনি যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তার চেয়ে গভীর কিংবা উজ্জ্বল ভাষণ বা বক্তব্য তিনি কোনো পুস্তকেও পাননি। কিন্তু দুর্ভাগ্য ‘দাঙ্গার প্রকোপে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু হিন্দু অধ্যাপক ক্রমান্বয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করেন।’ বুদ্ধদেব বসুর বন্ধু অমলেন্দু বসুর একটি ক্লাসও তিনি পাননি বলে আফসোস করেছেন। অমিয়ভূষণ চক্রবর্তী পড়াতেন রোমান্টিক কবিদের কাব্য- কিটস, শেলী, বায়রন; বিসি রায় পড়াতেন আলেকজান্ডার পোপ- তেমন আকর্ষণীয় ছিল না তার ক্লাস। সর্বভারতীয় রাজনীতিবিদ, কবি ও সম্পাদক হুমায়ুন কবির এবং বিসি রায় উভয়েই যে হিন্দু তরুণীর প্রেমে পড়েছিলেন তার শর্ত ছিল দুজনের মধ্যে যিনি ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হবেন তিনি তাকেই বিয়ে করবেন। ফার্স্ট ক্লাস সেকেন্ড হয়ে বিসি রায় চিরকুমারই রয়ে গেলেন, তরুণী হলেন হুমায়ুন কবিরের স্ত্রী।
শামসুর রাহমান অনার্স পড়ার সময় সাবসিডিয়ারি নিয়েছিলেন বাংলা ও ইতিহাস। বাংলার অধ্যাপক বিশ্বরঞ্জন ভাদুড়ী ছিলেন তার সবচেয়ে ভালো লাগার শিক্ষক। দীর্ঘকায়, সুদর্শন, সোনালি রঙের রিমলেস চশমা পরিহিত, বুদ্ধিদীপ্ত চেহারার বিশ্বরঞ্জন পড়াতেন রবীন্দ্রনাথের বিচিত্র প্রবন্ধ। ক্লাস শেষ হওয়ার পরও তাকে শুনতে আগ্রহী ছাত্র শামসুর রাহমানের সঙ্গে তিনি দীর্ঘক্ষণ আলাপচারিতা চালিয়ে যেতেন। কমবয়সি ছাত্র বলে উপেক্ষা করতেন না।
‘কালের ধুলোয় লেখা’ স্মৃতিচিত্রে শামসুর রাহমান লিখেছেন, ‘পরীক্ষায় কৃতিত্বের ঝলক দেখাতে না পারলেও কবিতা রচনার ক্ষেত্রে আমার কিছু সাফল্য ধরা পড়েছিল সে সময়ে কারো কারো কাছে। আমার শিক্ষক অমিয়ভূষণ চক্রবর্তী আমার লেখায় একজন ভালো কবির আভাস পেয়েছিলেন- এ কথা আমি বুঝতে পারি তার উদার আচরণে।’
ইংরেজির অমিয়ভূষণ অপরিমেয় স্নেহ ও প্রশ্রয় দিয়ে শামসুর রাহমানের সামনে খুলে দিয়েছেন তার বাড়ির ব্যক্তিগত লাইব্রেরি। তিনিও কবিতা লিখতেন। রেলওয়ে ওয়াগানের ভেতর বসে থাকা বিহার থেকে আসা শরণার্থীদের নিয়ে অমিয়ভূষণের প্রস্তাবে দুজনই কবিতা লিখলেন। শামসুর রাহমান লিখলেন ‘কয়েকটি দিন : ওয়াগানে’। সাহিত্য পত্রিকা বের করবেন বলে সৈয়দ নুরুদ্দিন কবিতা নিতে এলেন অমিয়ভূষণের কাছে। তিনি তাকে বললেন, শামসুর রাহমানের কবিতাটি বেশি ভালো হয়েছে, ওটি নাও।
সৈয়দ নুরুদ্দিন কবিতা নিলেন এবং তাৎক্ষণিকভাবে মানিব্যাগ খুলে সম্মানী ২৫ টাকা দিলেন কবিকে। সেই সাহিত্য পত্র আর বের হয়নি, ২৫ টাকাও ফেরত নেননি সম্পাদক।
শামসুর রাহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েই কবিতা লিখতে শুরু করেন, কবিতার প্রকৃত স্বীকৃতি এই শিক্ষকের কাছেই, একেবারে অর্থকড়ি প্রাপ্তিযোগসহ স্বীকৃতি। ‘স্যার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ধমকে খুব তাড়াহুড়ো করে একদিন ঢাকা ছেড়ে কলকাতায় চলে যান। আমার শিক্ষক অমিয়ভূষণ চক্রবর্তীর মুখ প্রায়ই চোখের সামনে ভেসে উঠে, শুনতে পাই তার কণ্ঠস্বর। কী করে ভুলব তার স্নেহস্পর্শ?’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন আনন্দ-বেদনার মিশেলে যে প্রেম জেগে উঠেছিল তার মধ্যে সে কথা এক সাক্ষাৎকারে নাসির আলী মামুনকে শুনিয়েছেন (সময় সব ধূসর করে দেয়, সাক্ষাৎকার, প্রথম আলো ১৭ আগস্ট ২০০৭)। মেয়েটি ইংরেজির নয়, অন্য বিভাগের।
‘আমি তো এমএ পড়েছি, পরীক্ষা দিইনি- অর্ধেক দিয়েছি অর্ধেক দিইনি। তিনি পরীক্ষা দিয়ে পাস করে অধ্যাপনা করছেন। তার প্রেমে পড়েছিলাম।’ সেকালে ক্লাস ছুটির পর সাহিত্যসভা হতো, লেখকরা নিজের লেখা পড়ে শোনাতেন। প্রায় সব সভাতেই ক’জন নারীর আগমন ঘটত, তাদেরই একজন তিনি। ওখানে একজনকে আমার চোখে পড়ে, তিনিও আমার দিকে চেয়ে থাকতেন, শুনতেন ভালো করে। খুব সুন্দরী ছিলেন। বিশেষ করে তার চোখ দুটো ছিল নীল। তার সঙ্গে প্রেম জমে উঠেছিল। দুজনেই স্থির করেছিলাম আমরা বিয়ে করব। কিন্তু একদিন তিনি আমাকে চিঠি লিখলেন, লাস্ট চিঠি তার। লিখলেন যে, আমাকে এমএ পরীক্ষা দিতেই হবে; পরীক্ষা দিয়ে সিএসপি হতে হবে। চিঠিটি আমার বাবার হাতে পড়ে। মা-ও ছিলেন আমার পাশে। বাবা তখন মাকে বললেন, ‘তোমার ছেলের অন্য সব মেয়ে ফুলের মালা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, বিয়ে করার জন্য।’
শর্ত প্রতিপালনও সম্ভব ছিল না, বিয়েও হলো না। শর্ত দিয়ে কি আর প্রেম-ভালোবাসা টিকে থাকে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীদের মধ্যে প্রিয় বন্ধু জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, এসএম আলী এবং সাবের রেজা করিম। জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী ইংরেজির অধ্যাপক ও ভাইস চ্যান্সেলর, সরকারের উপদেষ্টা, এস এম আলী ডাকসাইটে সাংবাদিক, ডেইলি স্টারের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক আর সাবের রেজা করিম ডাকসাইটে কেন্দ্রীয় আমলা।
বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক আড্ডার বন্ধুদের মধ্যে ছিলেন- হাসান হাফিজুর রহমান, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গির প্রমুখ। ১৯৫১ সালে আজিজুল জলিল প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি সংসদেও তিনি ছিলেন সক্রিয় কবিতা পাঠক। দারুণ রোমান্টিক ছিল তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সঙ্গে মধুর ক্যান্টিন তো জড়িয়েই থাকে। একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে নিহত মধুসূদনকে স্মরণ করলেন, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনকেও তার ‘মধুস্মৃতি’ কবিতায় :
ক্লাস শেষ হলে, লাইব্রেরি ঘরে না বসলে মন
আপনার ক্যান্টিনে আশ্রয় খুঁজতাম
বিবর্ণ চেয়ারে
চায়ের তৃষ্ণায় নয় তত
যতটা আড্ডার লোভে আমরা ক’জন
একে একে অনেকেই জুটত সেখানে-
মদনরাজ্যের অনুগত প্রজা কেউ কেউ, কেউবা নবীন
সামন্ত প্রতাপশালী। কেউ
ক্ষীণকায়, প্রায় রোগী, কবি,
কেউবা বিপ্লবী নেতা, কেউবা বৃত্তিভোগী
মসৃণ দালাল। আমাদের কারো কারো
মনে দিন ব্যাপ্ত কার্ল মার্কস-এর মহিমা।
টেবিলে টেবিলে কত তর্কের তুফান
যেত বয়ে…
কাউন্টারে বসে হাসতেন মৃদু, নাড়তেন মাথা
মাঝে-মধ্যে।…
বিশ্বাস করুন,
ভার্সিটি পাড়ায় গিয়ে আজও মধুদা মধুদা বলে খুব
ঘনিষ্ঠ ডাকতে।
(মধুস্মৃতি, বন্দিশিবির থেকে)

জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী
১৯৪৭-পূর্ব ভারতে, র‌্যাডক্লিফ রোয়েদাদ ঘোষণার আগে যশোর-বনগার মধ্যে হিন্দু-মুসলমানের বিভাজন রেখাটা আতঙ্কের ছিল না, বরং যশোরের জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর কাছে পদ্মার ওপারে ঢাকাই ছিল পাণ্ডববর্জিত; সেখান থেকে প্রতি বছরই দাঙ্গার সংবাদ আসত, কাজেই ঢাকা ছিল পরিহার্য।
তবুও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে তাকে ঢাকায় আসতেই হলো। যশোরে গ্রামের বাড়িতে থাকা অবস্থাতেই সলিমুল্লাহ মুসলিম হল বরাবর ভর্তির আবেদনপত্র পাঠিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজ জীবনে টেইলর হোস্টেলের সহ-তত্ত্বাবধায়ক মোহাম্মদ হোসেন ইংরেজির প্রতি তার আগ্রহ দেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ এবং সলিমুল্লাহ মুসলিম সম্পর্কে আগ্রহান্বিত করে তুলেছিলেন। তিনি নিজেও ইংরেজির এবং একই হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন। তিনি ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীকে বই পড়তে দিয়েছেন। তিনি ইংরেজিতে ফার্স্ট ক্লাস পেতে পারেন ভর্তির আগেই সে বিশ্বাসও জন্মিয়েছিলেন। হলের সিট বরাদ্দ পেতে এদ্বারে ওদ্বারে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে একজনের প্রায়োগিক পরামর্শে ব্যাগ-ব্যাগেজ নিয়ে হলে উঠে পড়লেন। ‘প্রেসিডেন্সি কলেজের মসৃণ প্রশাসনের’ পর জটিলতায় ঘেরা ঢাকার হল প্রশাসনের অভিজ্ঞতা তার সুখকর নয়। পুরনো আবাসিকদের কেউ কেউ নবাগতদের সুনজরে দেখেননি- বিশেষ করে ভিন্ন উচ্চারণের ছাত্ররা বিজাতীয় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গীয় বুলির কারণে তিনিও বিজাতীয় বলে চিহ্নিত। তার কলকাতার সহপাঠীদের মধ্যে ঢাকায় এলেন বাদশা- ড. আনোয়ার হোসেন, শাহাবুদ্দীন মাহতাব, ভোলার জয়নুল আবেদীন এবং জহুরুল কাইযুম। সৈয়দ মোহাম্মদ আলীও কলকাতা থেকে আসা, তবে পরিচয় ঢাকায়।
তিনি প্রভোস্ট হিসেবে পেয়েছেন ড. সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন এবং ড. ওসমান গণিকে। হলের সংসদীয় জীবনটি ছিল বেশ প্রাণবন্ত। একালের চাঁদাবাজ ও অর্ধশিক্ষিতদের মতো ছিলেন না বলে হলের পদগুলোতে যারা অভিষিক্ত হতেন তারাও ছিলেন বিশেষ মর্যাদাবান। বিদায়ী সহসভাপতি হিসেবে পেলেন শফিউল আজমকে, তিনি ইংরেজির কৃতী ছাত্র, পাকিস্তানে প্রথম স্থান অধিকার করে সিএসপি হয়ে চাকরিতে যোগ দেন। তার স্থলাভিষিক্ত হলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, একাত্তরে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান।
পরের বছর সহসভাপতি পদে জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী সমর্থন করেছেন বরিশালের আবদুর রহমান চৌধুরীকে (পরে বিচারপতি); হাবিবুর রহমান শেলী সহসভাপতি এবং জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী হয়ে পরের বছর নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন। হাবিবুর রহমান পরবর্তী সময়ের প্রধান বিচারপতি এবং দ্বিতীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান; আর জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী ইংরেজির অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ও প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা।
১৯৪৭-১৯৫১ শিক্ষা বছরের ছাত্র জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী। তিনি ইংরেজি বিভাগে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছেন মিস এজি স্টক, ড. এসএন রায়, আরএ গোমেজ, এমএন ঘোষ এবং চারুপমা বসুকে। পরবর্তী বছরগুলোতে ইংরেজি বিভাগে যোগ দিলেন বেশ ক’জন মেধাবী শিক্ষক- অমলেন্দু বসু, অমিয় চক্রবর্তী, সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, সৈয়দ আলী আশরাফ, খান সারওয়ার মুর্শিদ ও মুনীর চৌধুরী; শেষের দিকে পেলেন জেএস টার্নারকে।
অমলেন্দু বসু অল্পদিন ছিলেন, কিন্তু এর মধ্যেই বুঝিয়ে ছেড়েছেন যে তিনি খাঁটি অক্সোনিয়ান। তিনি এবং এসএন ঘোষ দেশভাগের সময়ই পূর্ব বাংলা ছেড়ে যান; হিন্দুদের ঢাকা ছাড়ার হিড়িক অগ্রাহ্য করে ড. এসএন রায় ও চারুপমা বসু রয়ে গেলেন; কিন্তু পঞ্চাশের দাঙ্গার পর আর ‘পূর্ব সংকল্পে স্থির থাকতে পারলেন না’। তারা চলে গেলেন। দাঙ্গার সময় ইংরেজি বিভাগের ছাত্ররা ড. এসএন রায় এবং জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার বাড়িতে পাহারা দিয়েছেন। ‘অমুসলমানদের দেশ ত্যাগের হিড়িক দেখে জ্যোতির্ময় গুহ বলেছিলেন, আমরা ঢাকার মানুষ, দাঙ্গায় ভয় পাই না। ভয় না পাওয়ার চরম মূল্য দিয়েছিলেন একাত্তরে।’
প্রায় সম্পূর্ণ অনালোচিত একজন খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী শিক্ষকের কথা তিনি লিখেছেন : ‘আরএ গোমেজ এসেছিলেন সাতচল্লিশে। বঙ্গীয় আইনসভায় তিনি ছিলেন একজন এমএলএ-খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি। শোনা যায় তিনি সেই প্রতিনিধিত্ব রক্ষা করতেই চলে এসেছিলেন ঢাকায় এবং তার এলাকায়। গোমেজ সাহেব পোশাকেও সাহেব ছিলেন। তাকে কোনোদিন দেশীয় পোশাকে দেখেননি, কোনোদিন তার মুখে ইংরেজি ছাড়া বাংলা শুনেননি। তবে তার সাহেবিয়ানার দৌড় ওই পর্যন্তই। স্বভাবে এমন নম্র ও বিনয়ী ব্যক্তি সহজে দেখা যায় না।’
নিষ্ঠাবান ক্যাথলিক হওয়ায় আর এ গোমেজ তার ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও হতাশাবাদী টমাস হার্ডির উপন্যাস পড়াতে রাজি হননি। তিনি শেকসপিয়র পড়িয়েছেন।
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী দুজন শিক্ষকের কথা বলেছেন, মুনীর চৌধুরী এবং জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা- দুজনের কণ্ঠে দুই ধরনের জাদু ছিল। তিনি সাবসিডিয়ারি হিসেবে পড়েছেন ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান।

ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে, নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়