১০ সরকারি ব্যাংকে নতুন ২০ ডিএমডি

আগের সংবাদ

মাসসেরার দৌড়ে সাকিব

পরের সংবাদ

কমিটি গঠন নিয়ে বিএনপির তৃণমূলে অস্থিরতা

প্রকাশিত: নভেম্বর ৪, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ৪, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

** বাড়ছে অভ্যন্তরীণ কোন্দল, পদত্যাগের হিড়িক ** ভাইরাল হচ্ছে টাকা ভাগাভাগির ভিডিও ** কমিটি বাণিজ্যে তারেক রহমানের নাম **
রুমানা জামান : সাংগঠনিক কমিটি গঠন নিয়ে অস্থিরতা বাড়ছে বিএনপিতে। গণতান্ত্রিক নিয়মের বদলে এসব কমিটি হচ্ছে অর্থের বিনিময়ে ‘পছন্দমাফিক’। ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাকর্মীর পরিবর্তে অযোগ্য, চাটুকার ও অনুপ্রবেশকারীরা আসছেন বড় পদে। এ নিয়ে ত্যাগীদের ক্ষোভ-বিক্ষোভ প্রকাশ্যে আসছে। ফলে কমিটি দেয়ার পর তা অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হচ্ছে। দাঁড় করানো হচ্ছে পাল্টা কমিটি। ঘটছে পদত্যাগের ঘটনাও। অনেকেই রাজনীতি থেকে গুটিয়ে নিচ্ছেন নিজেদের।
বিএনপির সিনিয়র নেতাদের কেউ কেউ আধিপত্য ধরে রাখতে নিজের অনুসারীদের যে কোনো মূল্যে নেতৃত্বে আনতে মরিয়া। অনেকে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে অযোগ্যদের উঁচু পদ দিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তাদের শঙ্কা, পুনর্গঠনের গতি বাড়াতে ভবিষ্যতে এ কোন্দল আরো ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। যা আগামীতে সরকারবিরোধী আন্দোলন ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
তবে কমিটি পুনর্গঠন প্রশ্নে বিএনপিতে কোনো অস্থিরতা নেই বলে দাবি করেছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ভোরের কাগজকে তিনি বলেন, বিএনপি একটি বড় দল। দেশব্যাপী যে সংখ্যক নেতাকর্মী রয়েছে সেই তুলনায় পদের সংখ্যা কম। তাই যোগ্যতা থাকার পরেও সবাইকে গুরুত্বপূর্ণ পদে রাখা সম্ভব হয় না। ফলে অনেকের মধ্যে পদ না পাওয়া নিয়ে কিছুটা অভিমান থাকতে পারে। সেটাকে আমরা কোন্দল বলছি না। কিছু জায়গায় বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটছে আমরা সেটা সমাধানের চেষ্টা করছি।
সূত্র জানায়, ডিসেম্বরের মধ্যেই পুনর্গঠন শেষ করার নির্দেশ দিয়েছে বিএনপির হাইকমান্ড। এরপর থেকেই বেশির ভাগ নেতা মূল দলসহ অঙ্গ সংগঠনে নিজ অনুসারীদের নেতৃত্বে আনতে জোর তৎপরতা চালাচ্ছেন। তবে পদপ্রত্যাশী এবং মনোনায়নপ্রত্যাশীদের মুখোমুখি অবস্থানের কারণে বেশ কিছু জেলায় বারবার উদ্যোগ নেয়ার পরও নতুন কমিটি দিতে পারছেন না দায়িত্বপ্রাপ্তরা। যেখানে কমিটি দেয়া

হচ্ছে সেখানে যে গ্রুপের নেতাকর্মীরা বাদ পড়ছেন তারাই বিক্ষোভে ফেটে পড়ছেন।
দলটির তৃণমূল নেতারা জানান, বিএনপির মূল চালিকাশক্তি ছাত্রদল, যুবদল আর স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটি গঠনে শুরু হয়েছে তুঘলকিকাণ্ড। অন্যান্য অঙ্গ, সহযোগী সংগঠনের বিরুদ্ধেও রয়েছে অভিযোগের পাহাড়। হাইকমান্ড থেকে বিশ্বাস ও আস্থা নিয়ে সারাদেশে থানা, পৌর, মহানগর ও জেলা কমিটি গঠনে বিভাগীয় সাংগঠনিক টিম গঠন করে দেয়া হয়েছে। তবে অনভিজ্ঞ ও জুনিয়র নেতাদের দিয়ে বেশির ভাগ টিম গঠন করায় বিতর্ক বাড়ছে। সব টিমের বিরুদ্ধেই কম-বেশি অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে প্রাধান্য পাচ্ছে- নিজস্ব বলয়, স্বজনপ্রীতি ও গুরুতর আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ।
শুধু টিমের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারাই নন, জেলার দায়িত্বশীল নেতার পাশাপাশি কেন্দ্রের শীর্ষ নেতাদের অনেকেই কমিটি বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত। অঙ্গ সংগঠন পুনর্গঠনের নেতৃত্বে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান থাকায় তার নাম ভাঙিয়ে কেন্দ্র ও বিভাগীয় টিমের একটি অংশ সহজেই এই কমিটি বাণিজ্য করছে। কমিটি বাণিজ্যের টাকা ভাগাভাগি করে নেয়ার ভিডিও ভাইরাল হচ্ছে। এসব নিয়ে টিম লিডারদের সঙ্গে বিএনপির স্থানীয় নেতারা যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তারেক রহমানের অজুহাত দিয়ে তাদের এড়িয়ে যাচ্ছেন। যখন-তখন বাকযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছেন এবং বাড়াবাড়ি করলে তারেক রহমানের কাছে নালিশ করার হুমকিও দিচ্ছেন। এতে স্থানীয় বিএনপি নেতারা চুপসে গেলেও বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছেন।
জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, কমিটি পুনর্গঠনে ক্ষোভ-বিক্ষোভ সব দলেই থাকে। অনেক দিন পরে পুনর্গঠনের কাজ শুরু হয়েছে। যেসব জায়গায় অভিযোগ আছে সেখানে তদন্ত কমিটি করে আমরা সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেব।
গত ২৫ সেপ্টেম্বর নরসিংদীতে যুবদলের কমিটি গঠনের নামে পদ বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগের আঙুল ইউনিট কমিটিগুলো গঠনের দায়িত্বে থাকা ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক টিমের প্রধান জাকির হোসেন নান্নু ও জেলা যুবদলের সভাপতি মহসীন হুসাইন বিদ্যুতের দিকে। এ ঘটনায় থানা যুবদলের পাল্টাপাল্টি কমিটি দেয়াকে কেন্দ্র করে নরসিংদী জেলা বিএনপির সভাপতি খায়রুল কবির খোকনকে অবাঞ্চিত ঘোষণা করে ঝাড়– মিছিল ও বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে।
২৫ আগস্ট ঘোষণা হয় মুন্সীগঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি। আগের সভাপতি আবদুল হাই ও সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান রতনকে আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব করে এ কমিটি দেয়া হয়। এতে ক্ষুব্ধ হন জেলার নেতাকর্মীরা। কেন্দ্রের দেয়া আহ্বায়ক কমিটিকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে গঠন হয় পাল্টা কমিটি। ২ সেপ্টেম্বর মুন্সীগঞ্জ প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কমিটি ঘোষণা করা হয়। এতে জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ও হরহঙ্গা কলেজের সাবেক ভিপি মো. রফিকুল ইসলাম মাসুমকে আহ্বায়ক ও মিয়া মো. বাবুল সরকারকে সদস্য সচিব করা হয়। পাল্টাপাল্টি কমিটিকে কেন্দ্র করে জেলায় সৃষ্টি হয়েছে উত্তেজনা। নেতাকর্মীরাও বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। যে কোনো সময় বড় ধরনের সংঘর্ষের আশঙ্কা করছেন তারা।
জানতে চাইলে রফিকুল ইসলাম মাসুম বলেন, যাদের দিয়ে কেন্দ্র জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি করেছে তারা পুরোপুরি ব্যর্থ। পাঁচ বছরে উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কোনো কমিটি হয়নি। এমনকি জেলা কমিটিই পূর্ণাঙ্গ করতে পারেনি। অথচ ব্যর্থ সেই সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব করে নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। বিগত সময়ে যারা রাজপথে ছিলেন তাদের বাদ দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে ছাত্রদলের সাবেক নেতাদের রাখা হয়নি।
স্বেচ্ছাসেবক দলের ময়মনসিংহ বিভাগীয় সাংগঠনিক টিমের প্রধান ছিলেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি আসাদুজ্জামান নেসার। জেলার বিভিন্ন ইউনিটের কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে তার বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ থাকায় কেন্দ্র তাকে দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করে নেয়। একই অভিযোগে ওই টিমের আরেক সদস্য কেন্দ্রীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক বাহারুল ইসলামকেও দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।
এরপর ওই বিভাগের দায়িত্ব দেয়া হয় কেন্দ্রীয় আরেক সহসভাপতি সুলতান মো. নাসির উদ্দিনকে। তার বিরুদ্ধেও অভিযোগের পাহাড়। ময়মনসিংহ সদরসহ কয়েকটি ইউনিটের পক্ষ থেকে আগে থেকেই আর্থিক সুবিধা নেয়ার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগ সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের কাছে পাঠানো হয়েছে। তবে সুলতান মো. নাসির এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
কমিটি গঠন কেন্দ্র করে অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে সিলেট বিএনপিতে। কোন্দলে বিপর্যস্ত জেলার রাজনীতি। সম্প্রতি জেলা ও মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটি ঘোষণাকে কেন্দ্র করে ফের প্রকাশ্যে আসে কোন্দল। যোগ্য ও ত্যাগীদের বাদ দেয়ায় ক্ষুব্ধ হন কেন্দ্রীয় বিএনপি সহ-স্বেচ্চাসেবক সম্পাদক এডভোকেট শামসুজ্জামান জামান। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বরাবর পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন। পরে তার অনুসারীদের সঙ্গে নিয়ে ২০ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে দল থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন তিনি। জামানের পর নবগঠিত সিলেট জেলা ও মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের ১১ নেতা পদত্যাগ করেন। ঘোষিত কমিটি বাতিল করা না হলে জামানের অনুসারীরা গণপদত্যাগের ঘোষণা দেন। এরই মধ্যে বিভিন্ন উপজেলায় জামানের অনুসারী কয়েকশ নেতাকর্মী পদত্যাগ করেছেন।
ময়মনসিংহের নান্দাইলে হামলা-মামলায় জর্জরিত ত্যাগী নেতাদের বাদ দিয়ে স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটি ঘোষণা করা হয়। এরপর নবগঠিত কমিটির ১৮ নেতা পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। এর মধ্যে উপজেলা কমিটির ১০ জন এবং পৌর কমিটির ৮ জন রয়েছেন। এর আগে একই অভিযোগে হালুয়াঘাট ও গৌরীপুর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের ২৩ নেতা নতুন কমিটি থেকে পদত্যাগ করেন।
যুবদলের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি ও খুলনা মহানগরী সভাপতি মাহবুব হাসান পিয়ারু, খুলনা জেলা যুবদল সভাপতি শামীম কবির এবং টিমে থাকা অন্য পাঁচজনও কম-বেশি কমিটি বাণিজ্য করেন। ফেসবুকে ভাইরাল হওয়াসহ নানাভাবে প্রাপ্ত তথ্যমতে, সাতক্ষীরার তালা উপজেলার দুই যুবদল নেতার কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা নেয়া হয়। অভিযোগ আছে, সাতক্ষীরার সীমান্ত ভোমরায় গিয়ে ফেনসিডিল খেয়ে ওই দুই নেতাকে পদ পাইয়ে দেন শামীম-পিয়ারু ও খুলনা যুবদল সাধারণ সম্পাদক ইবাদুল হক রোবায়েদ। একপর্যায়ে নানা অভিযোগ আসা শামীম কবির পদত্যাগ নাটকও করেন।
শামীম কবিরের হোয়াটসঅ্যাপের কথোপকথন অনুযায়ী, সাতক্ষীরার তালা উপজেলার একজন আহ্বায়ক পদপ্রার্থী তাকে বলেছেন, ‘আমার ব্যাপারটা মাথায় আছে তো ভাই’? শামীম কবির বলছেন, ‘আমি আগেই কিন্তু সব ক্লিয়ার করে বলেছিলাম। আতিয়ার-মন্টু ১০ লাখ টাকা খরচ করেছে। বিভাগীয় টিমের সবাইকে খরচ দিয়েছে। আমি তোমাকে আগেই বলেছিলাম ৫ লাখ টাকা দাও। বাকিগুলো আমি ম্যানেজ করে নেব।’ এরপর সেই আহ্বায়ক প্রার্থী বলছেন, ‘আপনার কথামতো ৫ লাখ টাকা আমি একবারে দিইনি। ৫ হাজার, ১০ হাজার করে ২ লাখ টাকা দিয়েছি। আপনি আমাকে তালা যুবদলের আহ্বায়ক বানান, তারপর পুষায় দেব। সমস্যা হবে না।’ জবাবে শামীম কবির বলছে, ‘চেষ্টা করব। রাতে হোয়াটসঅ্যাপে কল দেব।’
সম্প্রতি ঘোষিত ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপির কমিটি নিয়েও নেতাকর্মীদের রয়েছে চাপা ক্ষোভ। দলের দুঃসময়ে মাঠে থাকলেও অনেককে রাখা হয়নি কমিটিতে। ফলে অভিমানে দলীয় রাজনীতি থেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছেন। আগের কমিটির গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকজন নেতাকে এখন আর কর্মসূচিতে দেখা যায় না। দুই সিটির নবগঠিত কমিটি শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মাজারে শ্রদ্ধা জানালেও এসব নেতা সেখানে যাননি।
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু বলেন, দলের মধ্যে সরকারের কিছু দালাল আছে, যারা এসব নিয়ে ব্যবসা করছে। দলে শৃঙ্খলা আনতে হলে আগে এসব ব্যবসা যত দ্রুত সম্ভব বন্ধ করতে হবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়