ভিসি এয়ার মার্শাল নজরুল : ওবিই হচ্ছে জ্ঞানগর্ভ ও চিন্তা উদ্দীপক কর্মশালা

আগের সংবাদ

টানা ৪ জয়ে সেমিতে পাকিস্তান

পরের সংবাদ

‘পাপন’ একটু ‘আপন’ হোন!

প্রকাশিত: নভেম্বর ২, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ২, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

অতি সম্প্রতি পাপন সাহেব আপনি তৃতীয়বারের মতো ‘বিসিবি কাপ্তান’ হয়েছেন দেশের ক্রিকেট-মহানদের ভোটে। অপ্রতিদ্ব›দ্বী আপনি। বিসিবির ভাণ্ডারে আপনি বিশাল তহবিল জমা করেছেন, এই কৃতিত্ব আপনার কাছের লোকরা গর্বভরে উল্লেখ করে থাকেন। আমরা সবাই খুশিতে বাগ বাগ। আহা উহু! অবশ্য একজন বেরসিক বন্ধু বললেন, ধরুন বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে বিলিয়ন বিলিয়ন টংক জমা আছে, আর সেই ব্যাংক ভবনের বাইরে ফুটপাতে খেতে না পাওয়া কিছু কঙ্কালসার হতভাগা শুয়ে আছেন, তাহলে ওই ‘ভল্টে লাত্থি মারি’ বলে কেউ যদি ক্ষোভ প্রকাশ করেন; কী বলবেন আপনি পাপন সাহেব?
কিছু মনে করবেন না। সামনাসামনি দেখলে আমাকে বয়সবিচারে ‘আংকেল’ বলেই ডাকবেন। তাই সাহসভরে দু-একটি কথা বলি। প্রায় ষাট বছর আগের কথা। ক্লাসে প্রথম হতাম বলে সুনাম ছিল। একবার কেন যেন অঙ্কে ডাব্বা মারলাম। আমার আব্বা জন্মস্থান চাঁদপুরের বাইরে কর্মস্থলে থাকতেন। সুতরাং স্বয়ংক্রিয় অভিভাবক আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা, আমরা যাকে ‘মিয়াভাই’ বলে ডাকতাম। আমার উজ্জ্বল মহিমায় কালিমার দাগ পড়ায় মিয়াভাই মারাত্মক ক্ষুব্ধ হলেন। কালিমাখা পাতিল আমার মাথায় বসিয়ে দিলেন। মুখে পাতিলের কালি মেখে হনুমান বানিয়ে দিলেন। তাতেও মিয়াভাইয়ের রোষ আর ক্ষোভ অতৃপ্ত। বুকে লকেট হিসেবে কয়েকটি জুতা পরিয়ে দিলেন। চাঁদপুরের কোড়ালিয়া পাটওয়ারী বাড়ির ঘরে ঘরে গিয়ে ‘আমি আর পরীক্ষায় খারাপ করুম না’ বলে দাদা-দাদি, চাচা-চাচি, ফুফু, বড় ভাইয়ের সামনে জোরে জোরে কড়াল করতে হলো। আমার চোখে তখন অঝোর ধারা, নিকটস্থ মেঘনার মতোই। মিয়াভাই পৃথিবী ছেড়েছেন বছর তিনেকের মতো। ওনার শেষ ঠিকানা ঢাকার মিরপুর। শেরেবাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামের কাছেই। ওই শেষ ঠিকানায় আমি নিঃশব্দে কাঁদি। সেই মেঘনার মতোই। তবে অপমানে নয়। স্মৃতি সম্মানে। তবুও বলি মিয়াভাই পরীক্ষার ফলাফলে যে কালিঝুলি অপমান-অসম্মান করেছেন, তা ঠিক করেননি। আমার ব্যক্তিত্ব গঠনে তা নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। আমাকে এখনো কেউ অবজ্ঞা বা অপমান করলে আমি অনেক সময় বেসামাল ক্ষুব্ধ হয়ে যাই। রেগে যাই, হেরে যাব জেনেও। চালাকরা সুযোগ নেন, সুযোগ মতোন।
তা পাপন সাহেব, ব্যক্তিগতভাবে আপনার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ ঘটেনি। ছেলেব্রিটি-মেয়েব্রিটি কোনো কিছুই হওয়ার সুযোগ ঘটেনি এ জীবনে। কিছু মনে করবেন না। আমাদের ক্রিকেট দলটি এবার টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপে প্রথম পর্বে প্রথম খেলায় দুর্বল স্কটল্যান্ড দলের কাছে হেরে গেল। সমগ্র বাংলাদেশ নতমুখী হয়ে গেল। সবচেয়ে বেশি হলো ক্রিকেটার এবং তাদের পরিবারবর্গ। কিন্তু পাপন মহোদয়, বিসিবির সদ্যবিজয়ী প্রধান হিসেবে আপনার কাছ থেকে পৃথিবী প্রত্যাশা করেছিল উপশম-মলম। পরিবর্তে সেই ষাট বছর পূর্বের ‘মিয়াভাই’কে দেখলাম। কালিঝুলি জুতা- এটা কী করলেন পাপন ভাস্তে। এভাবে মিডিয়া ভিডিওযোগে সব দলকে অসম্মান-অপমান করে ‘ক্রিকেট’ নামক ভদ্দরনোকের খেলাকে কর্দমাক্ত করে দিলেন!
দেখুন তো সেদিন ভারত তার চিরপ্রতিদ্ব›দ্বীর কাছে ১০ উইকেটে হেরে এক বিশাল অপমানের হিমালয় পাষাণ বুকে বেঁধে নিল। সোশ্যাল মিডিয়ার কথা বাদ দিন। ওটা উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক-কুরুচি-আবর্জনা ভরপুর হয়ে গেছে। যার অসহায় শিকার শামি-লিটন-সৌম্য। ওদের পরিবার। কিন্তু এত বড় লজ্জাজনক পরাজয়ের পর বিসিসিআই প্রধান সৌরভ নিশ্চয়ই প্রসন্ন হননি। অথচ সৌরভ কী সুরভিত ব্যবহারের স্বাক্ষর রাখলেন। সৌরভের আদি উৎস বাড়ি পূর্ববাংলাতেই। পরিণত বয়সেও পাপন আপনাকে অনুরোধ করছি অন্তত সৌরভ-শচীন থেকে পরিমিতি-জ্যামিতিবোধ শিখুন।
ক’দিন আগে আপনি দেশপ্রেমের স্বাক্ষর রেখে এক সাক্ষাৎকারে বললেন, বাংলাদেশের পরাজয় আপনি সহ্য করতে পারেন না। রাতের ঘুম গুম হয়ে যায়। রক্তচাপ বেড়ে যায়। ডাক্তার বলেছেন, এসব চাপ-টাপ নেবেন না। এসব দায়ভার আর নয়। ওই সাক্ষাৎকারে ভেবেছিলাম আপনি আর বিসিবি-শার্দূল থাকবেন না। রাষ্ট্রের ক্রীড়াপ্রেমী মাননীয় ক্ষমতাপ্রধানের আপনি অশেষ স্নেহপুষ্ট। পাশাপাশি দেশের সেরা পুঁজিপ্রধানের আপনি নিকটজন। ক্রিকেটের দায়পাশ থেকে সরে যাওয়া আপনার পক্ষে কঠিন। তবে স্বাভাবিক জীবনে দেশপ্রেম থেকে আত্মপ্রেম কম মূল্যবান নয়। আপনার আবেগক্ষুব্ধ ঝাড়ির পরও ক্রিকেটের নিয়মেই বাংলাদেশ হারা-জেতার মধ্যেই আছে। দুটি দলের সঙ্গে জিতে যাওয়ার সুযোগও হয়েছিল। আমরা আশা করব। নিরাশ হবো। সোশ্যাল মিডিয়ার নোংরা আবর্জনা গড়ব।
কিন্তু ক্রিকেট যখন থেকে টংকচক্রে নিপতিত হলো, এর বাহারে রঙ খোলতাই হতে থাকল, পাতানো-জুয়াড়িরা ক্রিকেটের ভাগ্য গড়তে লাগল, তখন এর জৌলুস বেড়ে গেল। বাজিকর। বাজিকর। সবই বুঝি শাহরুখ। ধরা পড়ল আজহার। মরতে হলো হ্যান্সি ক্রোনিয়েকে। আমাদের আশার ফুল আশরাফুলের প্রতিভার অপমৃত্যু ঘটে গেল। আরো কত। বাংলাদেশের এ যাবৎকালের সেরা ক্রিকেটার সাকিব পর্যন্ত রেহাই পেল না। এত সব কিছুর মধ্যেও ক্রিকেটের জমকালো জৌলুস বেড়েই চলল। পাপন, আপনিও ক্রিকেটের বিশ্বব্যক্তিত্বের একজন পরিগণিত হলেন। আপনার মতো এমন ক্রিকেটব্যক্তিত্বের এমন আবেগ জর্জরিত প্রতিক্রিয়া শারীরিক এবং সামাজিকভাবে মানায় না। সব কিছু দেখে-শুনে অনুমান করি, আপনি বাংলাদেশের সিনিয়র এবং পারঙ্গম পাঁচজন ক্রিকেটারের ব্যক্তিত্ব খর্ব হতে দেখলেই প্রীত হন। কেউ বেশিদিন থাকবেন না। আপনিও নন, ওই পাঁচ-দশজনও নন। এবার আপনাকে বলি। প্রধান দায়িত্ব আপনার। এই পাঁচজনের মানের ক’জন খেলোয়াড় আমাদের পাইপলাইনে আছে? একটি আন্তর্জাতিক মানের একাডেমি হয়নি কেন এখনো? এত টাকা ভল্টে আটকে কী লাভ! জেলায় জেলায় যে ক্রিকেট-মহানদের ভোটে আপনি পুনঃপদায়িত হচ্ছেন, সেই প্রত্যেকটি জেলা থেকে প্রতি বছর একজন করে সম্ভাবনাময় ক্রিকেট অংকুরও যদি গজিয়ে উঠত? খেলোয়াড় নয়, সম্ভাবনাময় নয়, সবার আগে চাই ভোট। কয়টি জেলায় কয়টি ক্রিকেট স্টেডিয়াম আর অবকাঠামো? দলকে বকাবাদ্য করার আগে মুশফিকুর রহিমের ভাষায় বলি, ‘আয়না দেখুন’। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সেদিন ৫০ রান করল। কই, তাদের ক্রিকেটপ্রধানরা তো ক্ষেপে-টেপে পৃথিবী মাতাল না!
পরিশেষে একটি ঐকান্তিক অনুরোধ। আপনি যে ক্লাবটির প্রধান, সেখানকার মাঠের এক কোনায় কিশোর-তরুণরা নিজেদের ব্যয়ে রোদ-বৃষ্টির আচ্ছাদনবিহীন কঠিন অবস্থায় অনেক দূর থেকে এসে কোচিং করছে, একবার নিজে দেখে আসুন। ২৫টির মতো প্রাইভেট কোচিং কেন্দ্র সেখানে গিজগিজ করছে। আপনাদের জমা কোটি কোটি টাকার জমাট বরফ কিঞ্চিৎ গলিয়ে ওই আগ্রহী বাচ্চা-কাচ্চাগুলোর কোচিংয়ের সুযোগ-সুবিধা একটু বাড়াবেন কি? বকাঝকা তো ভালোই দেন, বকাঝকার বিপরীতে গণমানুষও আপনাদের কম দেয় না আংকেল। বেচারা কোচিং-শিক্ষানবিসদের সামান্য প্রাকৃতিক কার্যক্রম ও পরিচ্ছন্ন নাস্তাপানির সুবিধাদিও সেখানে আছে কিনা একটু দেখুন। পাপন সাহেব একটু আপন হোন!

হিলাল ফয়েজী : মুক্তিযোদ্ধা ও রম্যলেখক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়