ডেঙ্গুতে ৯১ জনের মৃত্যু, আক্রান্ত সাড়ে ২৩ হাজার

আগের সংবাদ

তৃণমূলে সংঘাত থামছেই না : সংঘর্ষে জড়িতদের তালিকা করছে আ.লীগ, অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষে এক মাসে নিহত ৮, নির্বাচনী সংঘর্ষে ৩৮ নিহত

পরের সংবাদ

ত্রিকোণ প্রেম

প্রকাশিত: নভেম্বর ১, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ১, ২০২১ , ১:০৬ পূর্বাহ্ণ

রোজ রোজ এভাবে তোর মদ খাওয়া আর রাতজাগা আমার একদম ভালো লাগে না। কেনো করিস এমন? অনেক সময় তো গেলো, এবার এই বদ অভ্যাসটা ছাড় তো…
ও আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি একটা হাসি দিয়ে বললো- বদ অভ্যাস! আমি তো আমার বদ অভ্যাসটাকে ছাড়তেই এই রাত জাগাকে আপন করে নিয়েছি, এটা আমার বদ অভ্যাস নয় রে…। যখন ওকে রোজ রোজ দেখতে পেতাম, তখন ওটা আমার বদ অভ্যাস ছিল। সারাক্ষণ ওকে দেখতে চাওয়াটা আমার বদ অভ্যাস ছিল, ওর জন্য ভেবে ভেবে দুঃখের সাগরে ডুবে থাকাটা আমার বদ অভ্যাস ছিল। কিন্তু এখন, এখন আমার আর কোনো বদ অভ্যাস নেই, আমি কী সুন্দর একা চলতে শিখে গিয়েছি দেখছিস না? শুধু আমার একাকিত্বে সঙ্গী হয়েছে এই মদের বোতলগুলো। আর তুই সেটাকেই বলছিস বদ অভ্যাস? যা বাড়ি যা, আমাকে নিয়ে তোকে এতো ভাবতে হবে না।
এই বলে ও আবারো মদের বোতলটা মুখে পুরে নিয়ে মদ খেতে শুরু করলো।
আমি জ্যোতি, এতক্ষণ যার সঙ্গে কথা বলছিলাম ও আমার বন্ধু মৃদুল। আমাদের পাশাপাশি বাড়ি হওয়ায় ছোটবেলা থেকে বড় হওয়া, পড়াশোনা সবকিছুই একসঙ্গে।
আর মৃদুল যাকে দেখতে না পাওয়ার কষ্ট সহ্য করতে না পেরে এই মদের নেশায় মেতেছে, সে হলো কাশফিয়া। আমাদের দুজনেরই বন্ধু, তবে মৃদুলের ভালোবাসাও ছিল সে।
স্কুল-কলেজ তিনজনেরই একসঙ্গে কেটেছে। কতদিন যে আমরা তিনজন স্কুল-কলেজ ফাঁকি দিয়ে ওই রেললাইনের রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছি! কত যে আনন্দের সময় কেটেছে আমাদের তা বলে শেষ করা যাবে না।
সেই ছোটবেলা থেকেই মৃদুল কাশফিয়াকে পাগলের মতো ভালোবেসে এসেছে! এক কথায় ওকে ছাড়া মৃদুল কখনো আমাকেও ভালো করে দেখত না পর্যন্ত। তবে এর মধ্যেও একটা বিশাল সত্যি হলো, মৃদুল কাশফিয়াকে ভালোবাসে আর আমি মৃদুলকে!
আমি মৃদুলকে ভালোবাসতাম, আর এখনো বাসি। কিন্তু মৃদুল কখনো কাশফিয়াকে ছেড়ে আমার দিকে ভালোবাসার নজরে তাকালোই না।
একবার কলেজ থাকতে, বর্ষবরণ অনুষ্ঠান ছিল আমাদের। আমি আর কাশফিয়া দুজনেই লাল পাড় সাদা শাড়ি পরে, চোখে কাজল এঁকে, লাল রেশমি চুরিতে হাত সাজিয়ে, খোঁপায় সাদা কাঠগোলাপের গাজরা পরে কলেজে গিয়েছিলাম। আমি জানতাম, মৃদুল আমায় নয় কাশফিয়াকে পছন্দ করে। তারপরও সেদিন আমি খুব করে চাইছিলাম মৃদুল এসে বলুক, আমায় আজ দেখতে ভীষণ সুন্দর লাগছে!
ওর মুখে শুনব বলে কত কথাই না ভেবে রেখেছিলাম সেদিন!
মৃদুল এসেও ছিল আমাদের কাছে। খুব সুন্দর দেখাচ্ছে তোকে, অপূর্ব লাগছে, চোখ ফেরাতেই ইচ্ছে করছে না- এরকমটাই বলেছিল সেদিন, তবে আমাকে নয়! কাশফিয়াকে।
আমি মুখটা নিচু করে হাঁটছিলাম, মাথা তুললেই যদি আমার ছলছলে দুচোখ ওরা দেখে নেয় আর আমায় জিজ্ঞেস করে কী হয়েছে, তখন কী উত্তর দেবো সেই ভয়ে।
একটু বাদেই মৃদুলের এক বন্ধু যাচ্ছিল বাইক নিয়ে। মৃদুল ওকে থামিয়ে বললো- দু ঘণ্টার জন্য বাইকটা দে তো, আমরা বেড়াতে যাবো…
মৃদুলের সেই বন্ধুটা বাইক দিয়ে চলে গেলো।
মৃদুল বাইকে উঠে কাশফিয়াকে ইশারা করে বসতে বললো। কাশফিয়াও উঠে বসলো। এরপর ওরা দুজন হাসতে হাসতে আমায় বললো- তুই বাড়ি যা, আমরা মেলা থেকে একটু ঘুরে আসি, আসার সময় তোর জন্য ফুচকা আনবো…
আমার চোখের সামনে ওরা হাসতে হাসতে সাঁই করে চলে গেলো। ওরা এত খুশি ছিল যে আমার ছলছলে কাজল লেপ্টানো চোখ জোড়া খেয়ালই করতে পারেনি। ধুর, আমি শুধু শুধুই ভয় পাচ্ছিলাম এতক্ষণ! ওরা চোখে পানি দেখে কী বলবে না বলবে সেটা নিয়ে। আমাকে নিয়ে ভাবার এত সময় কই ওদের?

বাড়ি এসে সেদিন খুব কেঁদেছিলাম! মনের কোণে কোথাও কাশফিয়ার প্রতি খুব হিংসে হচ্ছিল সেদিন, এটা অস্বীকার করতে পারবো না। তারপরও আমি মনেপ্রাণে চাইতাম ওদের ভালোবাসাটা পরিণতি পাক।
এভাবে ওদের কত দিন কত রাতের ভালোবাসার সাক্ষী যে আমি হয়েছি তার কোনো ঠিক নেই। হঠাৎ কোনো সন্ধ্যাবেলা কাশফিয়ার ঝালমুড়ি খেতে ইচ্ছে করলে, মৃদুল দুটো ঝালমুড়ি এনে একটা আমার হাতে দিয়ে বলতো- তুই রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখ কেউ আসছে কিনা। আমি ওকে ঝালমুড়িটা খাইয়ে দিয়ে আসি।
আমিও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বেশ মন দিয়ে
পাহারা দিতাম ওদের।
সবকিছু খুব ভালোই কাটছিল। দিন গিয়ে, মাস গিয়ে, কেটে গেলো প্রায় দুবছর। এরই মধ্যে হঠাৎ একদিন সন্ধ্যাবেলা কাশফিয়া এসে জানালো, ও খালার বাড়ি বেড়াতে যাবে। মৃদুল বললো, যেখানেই যাস দুই দিনের বেশি থাকা চলবে না।
কাশফিয়া মুচকি হাসি দিয়ে বললো- কেনো রে দুইদিনের বেশি কি আমায় না দেখে থাকতে পারবি না?
মৃদুল বললো- দুইদিন? তোকে দুই ঘণ্টা না দেখলে আমার বুকটা খালি খালি লাগে, সেটা তুই বুঝিস না পাগলি?

দু’দিন বাদে কাশফিয়া ফিরে এলো, তবে ওর হাসি মুখটা কেমন মলিন। আমি আর মৃদুল বার বার জিজ্ঞেস করছি- কী হয়েছে বল?
কিছুক্ষণ চুপ থেকে ও এবার মৃদুলকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো- বাড়িতে তোড়জোড় চলছে, আমাকে বিয়ে দিয়ে দেবে!
সঙ্গে সঙ্গে মৃদুলের মুখটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেল। সেদিন আমি মৃদুলের চোখে কাশফিয়াকে না পাওয়ার এক অনিশ্চয়তার ভয় দেখতে পেয়েছিলাম। কাশফিয়াও যে ভয় পেয়েছিল, সেটাও ওর চোখ মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল।
প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে আমরা ভাবছিলাম এই দুইদিনের মধ্যে কী করলে ওদের বিয়েটা আটকানো যাবে? হঠাৎই মৃদুল বলে উঠলো কাশফিয়াকে- পালিয়ে যাবি আমার সঙ্গে?
মৃদুলের কথা শুনে আমি আর কাশফিয়া দুজনেই প্রথমে খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। তবে ভেবে দেখলাম আর কোনো উপায়ান্তর নেই!
যেমন কথা ঠিক তেমন কাজ। আমাদের তিনজনের সেই অল্প বয়সের কাঁচা বুদ্ধির পরিকল্পনাতেই পরদিন সকালে ফেরার হলো মৃদুল আর কাশফিয়া। আমার এক মামাতো বোনের বাড়িতে থাকার উদ্দেশ্যে ওরা গিয়েছিল, আর দুই একদিন পর বিয়েটা করবে বলেই ঠিক হয়েছিল। সন্ধ্যার দিকেই জানাজানি হয়ে গেলো সবটা! চারপাশে খোঁজ পরে গেল, কানাকানি শুরু হলো, আমি ওদের বন্ধু হওয়ায় আমাকেও অনেক কিছু হজম করতে হয়েছে সেই সময়!
কাশফিয়ার বাড়ি থেকে তুমুল বেগে খোঁজাখুঁজি শুরু করলো। এভাবে কাটলো দিন তিনেক। তিনদিন বাদেই কাশফিয়ার বাবা, কাকা মিলে কোত্থেকে যে ওদের দুজনকে খুঁজে নিয়ে এলো সেটা আমার ধারণারও বাইরে। আমি ভাবতেই পারিনি ওরা ধরা পড়ে যাবে!
তারপর এক করুণ বিচ্ছেদ দেখতে হয়েছিল আমাদের। মৃদুল আর কাশফিয়াকে করা হয়েছিল ঘরবন্দি। দুজন মানুষের এক হওয়া আর হয়ে উঠলো না। সবকিছু খুব কষ্টকর ছিল বটে!
তবে বেশ কিছুদিন পর বাবা-মায়ের কথায় কাশফিয়ার মনে হয়েছিল, যা করেছে তা ভুল করেছে! বন্ধুদের প্ররোচনায় পড়ে এমনটা করে ফেলেছিল, তাই এখন বাবা-মায়ের পছন্দে নতুন করে সবটা গুছিয়ে নেয়াই উচিত। কিছুদিন পরই পারিবারিকভাবে এক বড় বাড়িতে বিয়ে হলো কাশফিয়ার। জানি না কাশফিয়া চাইলে বিয়েটা আটকাতে পারতো কিনা, জানি না চেষ্টার কোনো ত্রæটি থেকে গিয়েছিল কিনা! তবে তিনজন মানুষের জীবন পুরোপুরি উল্টে পাল্টে গিয়েছিল।
একটা পরিবারের চাপে দুটো জীবন, দুটো মানুষ হয়ে গিয়েছিল আলাদা। সেই সবকিছুই এখন অতীত!
এখনো কাশফিয়া যখন বাবার বাড়িতে বেড়াতে আসে তখন ওকে দেখে মৃদুলের দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া হৃদয়ের কষ্টটা ভেসে ওঠে ওর চোখেমুখে। আমি এখনো মৃদুলকে দেখে বুঝতে পারি, ওর ভেতরটা কতটা ভেঙে চুরে যাচ্ছে!
সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে, দুজন মানুষের বিচ্ছেদ হয়েছে, তারপরও তারা একজন আরেকজনকে দেখেও না দেখার ভান করে পাশ কাটিয়ে চলে যায়! যেনো কেউ কাউকে চেনেই না!
তবে সম্পর্কের সমীকরণ কিন্তু সেই একই আছে। এখনো মৃদুল ভালোবাসে কাশফিয়াকে আর আমি মৃদুলকে। এরকম ত্রিকোণ প্রেমের গল্প থাকে অনেকের জীবনেই। যাদের মধ্যে সবকিছু ভুলে দিব্যি ভালো থাকে একজন!
অনেক বছর পর সেই পুরনো স্মৃতি আঁকড়ে ধরে একাকী বাঁচতে থাকে আরেকজন, যার সাদাকালো জীবনের একাকিত্বের সঙ্গী হয় লাল নীল কিছু মদের বোতল!
আর বাকি একজন, যে কিনা এত কিছুর পরও কারো ভাঙা হৃদয়ে নিজেকে বসিয়ে দুজন মিলে সেই না হওয়া সংসার করার স্বপ্ন দেখতে থাকে!
:: টেবুনিয়া, পাবনা

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়