মিয়ানমার ছায়া সরকার ও মার্কিন প্রতিনিধির বৈঠক

আগের সংবাদ

ইএফডির দাম নিয়ে জটিলতা : দোকান নির্ধারণ করবেন ভ্যাট কর্মকর্তারা, বিপাকে পড়বেন ছোট ব্যবসায়ীরা

পরের সংবাদ

স্বদেশে ফিরে আসা

প্রকাশিত: অক্টোবর ২৮, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ২৮, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

পরাধীন ব্রিটিশ-ভারত থেকে পাকিস্তানের কালো অধ্যায় পেরিয়ে জন্ম হয় বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের। এই মহান অর্জনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইতিহাসের মোড় ঘোরানো নানা ঘটনা, যার কারিগর হিসেবে কেউ আখ্যায়িত হয়েছেন নায়কের অভিধায়; কেউবা আবির্ভূত হয়েছেন খলনায়কের চরিত্রে। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে সেসব ঘটনা ও তার নায়ক-খলনায়কদের কার কী ভূমিকা, তাই নিয়েই অধ্যাপক আবু সাইয়িদের গ্রন্থ ‘যেভাবে স্বাধীনতা পেলাম’। স¤প্রতি ভোরের কাগজ প্রকাশন থেকে বের হয়েছে বইটি। এ বই থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রতিদিন কিছু অংশ তুলে ধরা হচ্ছে ভোরের কাগজের পাঠকদের জন্য।
পাকিস্তানের লায়ালপুর জেলে বঙ্গবন্ধুু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার কার্যক্রম শুরু করা হয়। রাওয়ালপিন্ডি থেকে ২৪০ কি.মি. দক্ষিণ-পশ্চিমে পাঞ্জাবের শিল্পনগরী লায়ালপুর। ১৬ ফুট উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা লায়ালপুর সেন্ট্রাল জেল। লায়ালপুরের লাল ইটের আদালত ভবনটি মূল কারাগারের লাগোয়া হলেও, বন্দিকে লম্বা সরু করিডোর দিয়ে আদালতে প্রবেশ করতে হত। সেখানে ছিল চারটি ভারি লোহার দরজা। প্রতিটি দরজার পাশে সাব-মেশিনগান হাতে যুদ্ধ-পোশাক সজ্জিত সৈনিক দাঁড়িয়ে থাকতো। সারি বাঁধা বেঞ্চ ও উঁচু প্ল্যাটফর্ম এবং পাকিস্তানি পতাকা সজ্জিত আদালত কক্ষে প্রবেশ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পুরোপুরিভাবে উপেক্ষা করতেন বিচারকার্য। শান্ত। সৌম্য। অবিচল একজন মানুষ।
বিচার সপ্তাহকাল ধরে চলে এবং প্রতিদিন বিকেল ৪টা নাগাদ শেখ মুজিব সেলে ফিরে আসতেন। কখনো কখনো অভিযুক্তের পক্ষে নিয়োজিত কৌঁসুলিকে তার সঙ্গে দেখা করতে দিতে হতো। তবে বন্দি প্রায় কখনোই কোনো কথা বলতেন না। একবার আদালতের কার্যক্রমের বিবরণী তাকে দেয়া হলে তিনি এর ওপরে লেখেন, ‘সব মিথ্যা’।
আরেকবার লেখেন, ‘কাকে বলে রাষ্ট্রদ্রোহিতা? আমরা যে নির্যাতিত এটা মনে করাটা কি রাষ্ট্রদ্রোহিতা?’
আগস্টের শেষ সপ্তাহে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যে বিবৃতি দেন তাতে আরো সন্দেহ ছিল না যে, এই বিচার ন্যায়ানুগ হবে না এবং বিচারের রায় পূর্বেই স্থির করে রেখেছে। আদালত কেবল স্থিরকৃত রায় পাঠ করে দেবে।
ট্রায়ালের জন্য ১৯ আগস্ট শেখ মুজিবকে স্পেশাল মিলিটারি ট্রাইবুনালে হাজির করা হয়। প্রিজাইডিং বিচারপতি ছিলেন একজন ব্রিগেডিয়ার। কোর্টের অন্যান্য সদস্যের মধ্যে দুজন ছিলেন সামরিক অফিসার, একজন নেভাল অফিসার এবং পাঞ্জাব থেকে আগত একজন জেলা জজ। তার বিরুদ্ধে ১২টি

অভিযোগ উত্থাপন করা হয়- যার মধ্যে ছয়টি ছিল মৃত্যুদণ্ডের। সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ ছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করা। যখন মুজিবকে তার ডিফেন্স কাউন্সিল সিলেক্ট করার জন্য বলা হয় তখন তিনি ড. কামাল হোসেনকে আইনজীবী হিসেবে নিয়োগের কথা বলেন। তাকে বলা হলো এটা সম্ভব নয়। তখন শেখ মুজিব এ কে ব্রোহীকে সিলেক্ট করেন, তিনি ছিলেন সিনিয়র আইনজীবী এবং সংবিধান বিশেষজ্ঞ।
কিন্তু বিচারকার্যের একপর্যায়ে রাষ্ট্রপক্ষ কর্তৃক ২৬ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের প্রদত্ত ভাষণে শেখ মুজিবের কার্যক্রম, অসহযোগ আন্দোলন থেকে হরতাল, নির্দেশ ইত্যাদিকে রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক কাজ বলে অভিযোগ পত্রে উল্লিখিত হওয়ায় শেখ মুজিব এই ট্রায়ালে অংশগ্রহণে অস্বীকৃতি জানান এবং তার নিয়োজিত আইনজীবী ব্রোহীকে বিদায় করে দেন। কিন্তু বোর্ডের অনুরোধে ব্রোহী রাষ্ট্রপক্ষ হতে প্রতিনিধিত্ব করতে থাকেন।
শেখ মুজিবের বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, এটা বিচারের নামে প্রহসন চলছে- যা হবে সাজানো মৃত্যুদণ্ড। তিনি নির্বিকার। একের পর এক সাক্ষীরা আসছেন। পাকিস্তানের অখণ্ডতাকে ধ্বংসের জন্য দায়ী করে সাক্ষ্য দিচ্ছেন। প্রসিকিউশন ১০৬ জনের সাক্ষ্যতালিকা ট্রাইবুনালে পেশ করেন, কিন্তু তার অর্ধেককে বোর্ডের সামনে উপস্থিত করা হয়নি। যারা কেবলমাত্র সামরিক অফিসে বা পুলিশের কাছে জবানবন্দি দিয়েছিল কেবলমাত্র তাদেরই হাজির করা হয়।
ব্রোহী কোর্টের কাছে আবেদন করেন যারা ক্র্যাক ডাউনের পূর্বে ঢাকায় নেগোশিয়েশনে অংশগ্রহণ করেছিলেন কর্নেলিয়াস, পীরজাদা, এম এম আহমদ তাদের হাজির করা হোক। তাদের জেরা করারও আবেদন জানান তিনি। তখন কোর্ট তার আবেদন নাকচ করে দেয়। অর্থাৎ বিচার প্রক্রিয়ার শেকড়ে যাওয়ার ক্ষেত্র বন্ধ করে দেয়া হয়। ইয়াহিয়া খান বলেন, ‘সামরিক আদালতে শেখ মুজিবের বিচার ও মৃত্যুদণ্ডের ব্যবস্থা করার জন্য জেনারেলরা চাপ দিচ্ছেন। আমি সম্মত হয়েছি।’
এসবই ছিল ন্যায় বিচারকে প্রভাবান্বিত করার অপচেষ্টা। এ বিষয়ে আরো কতিপয় বক্তব্য, মন্তব্য উপস্থাপন করা যেতে পারে। এসব প্রচারণা ছাড়াও বন্দি শেখ মুজিবের বিচার প্রভাবান্বিত করার লক্ষ্যে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে এমন কথাও তিনি বলেছেন, যার অর্থ জনগণকে জানানো যে, শেখ মুজিব কী ভয়ংকর দেশদ্রোহী! কোনো খবরের কাগজ, বই বা রেডিও তাকে দেয়া হয়নি। তার যেটা একমাত্র বিলাসিতা সেই তামাক তাকে দেয়া হয়েছিল। তিনি দিনের গণনা রাখতেন, পাঠ করতেন কুরআন, তাকিয়ে থাকতেন ক্ষুদ্র এক খণ্ড আকাশের দিকে এবং নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন কারাগারের অবিচ্ছিন্ন নীরবতার কাছে।
১৫ ডিসেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও হেনরি কিসিঞ্জার মন্তব্য করেছিলেন উপমহাদেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতার লক্ষ্যে শেখ মুজিবের মুক্তি অনিবার্য। ভুট্টোকে তখনই একথা বলে দেয়া হয়েছিল।
১৯৭২ সালের ৩ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো ও মার্কিন রাষ্ট্রদূত যোশেফ ফারল্যান্ড করাচিতে বৈঠক করেন। তিনি রাষ্ট্রদূতকে বলেন, জনসভায় বাংলাদেশ প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে নিঃশর্ত বন্দিশালা থেকে মুক্তির ঘোষণা দিবেন। ৪৫ মিনিটব্যাপী বৈঠকে ভুট্টো বলেন, তিনি একদা কারাগারের যে সেলে ছিলেন শেখ মুজিব সেখানেই আছেন এবং সে স্থান থেকে সরিয়ে একটি গেস্ট হাউসে নিয়ে আসা হবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের শীর্ষ নেতা হিসেবে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদ’-এর অভিযোগে জেনারেল ইয়াহিয়া খান তাকে গ্রেপ্তার করেন। কোর্ট মার্শালে তাকে মৃতুদণ্ড দেয়া হয়েছিল।
১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১ অত্যন্ত অসম্মানজনকভাবে ৯৩ হাজার পাকিস্তান সামরিক বাহিনী বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। পাকিস্তানের এই লজ্জাজনক আত্মসমর্পণে পশ্চিম পাকিস্তানে চরম বিক্ষোভ শুরু হয় সর্বস্তরে। ভুট্টোর দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি সমগ্র পশ্চিম পাকিস্তানে এমন অবস্থা সৃষ্টি করে যার ফলে সেনাবাহিনীর চক্রান্তে ইয়াহিয়াকে সরে যেতে হয়। ভুট্টো ক্ষমতা দখল করেন। তবে কীভাবে ক্ষমতা দখল করেছেন সে সব ঘটনা রাষ্ট্রদূতকে লুকিয়ে যান ভুট্টো। প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে একথা বলেন যে, মুজিবের ইচ্ছাকেই তিনি প্রাধান্য দেবেন। শেখ মুজিবের মুক্তির ক্ষেত্রে তিনি ‘কূটনৈতিক চালের’ আশ্রয় নেবেন। কূটচালটি ছিল, তিনি শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে পারেন এ শর্তে যে, অন্যান্য দেশ বাংলাদেশকে যেন স্বীকৃতি না দেয়। কেননা, তিনি বাংলাদেশের নেতার সঙ্গে সমঝোতার প্রচেষ্টায় দর কষাকষি করবেন।
জুলফিকার আলী ভুট্টো শেখ মুজিবের মুক্তির পূর্বে তার সঙ্গে দুবার দেখা করেন। ভুট্টো ক্ষমতা দখল করার তিন দিন পর শেখ মুজিবের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ করেন। রটনা করা হয়, ভুট্টো শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ করে ভারত পূর্ব পাকিস্তান দখল করে নিয়েছে, এরকম একটি শক্ত ধারণা দেন। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ-পাকিস্তানের মধ্যে একটি কনফেডারেশন জাতীয় সম্পর্ক বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। ভুট্টো যদিও ভারতের সাংবাদিক কুলদীপ নায়ারকে বলেছিলেন যে, শেখ মুজিব ভুট্টোকে কথা দিয়েছেন যে, তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে একটি সম্পর্ক রাখবেন। কথাটি সঠিক ছিল না। ডিসেম্বর ২৭ তারিখে ভুট্টো দ্বিতীয়বার বৈঠকে বসলে শেখ মুজিব তাকে স্পষ্ট করেই বলেন যে, আমি এই মুহূর্তে কোনো বিষয়ে বলতে পারছি না, পাকিস্তানের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখা যাবে কিনা সে বিষয়েও না। বঙ্গবন্ধু কুলদীপ নায়ারকে বলেছিলেন যে, জেলারের কাছে থেকে তিনি জেনেছিলেন বাংলাদেশে স্বাধীন হয়েছে। সেজন্য তাকে জেলখানা থেকে সরিয়ে আনা হয় যাতে জুলফিকার আলী ভুট্টো তার সঙ্গে আলোচনা করতে পারেন। শেখ মুজিব এমন একটি ভাব করেন যেন তিনি বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছুই জানেন না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত রাশিয়া, ব্রিটেনসহ সব পরাশক্তি গণতান্ত্রিক দেশগুলো শেখ মুজিবকে অবিলম্বে ছেড়ে দিতে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে বন্দিখানা হতে মুক্তি দেবার বিষয়ে ভুট্টো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন।
পাকিস্তানের একটি গ্রুপ চেয়েছিল বাংলাদেশে আটক পাকিস্তানি সৈন্যদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য মুজিবকে ‘ট্রাম কার্ড’ হিসেবে ব্যবহার করা উচিত। এই অভিমতের দৃঢ় সমর্থক পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ১২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২ মার্কিন ডেপুটি চিফ অব মিশন সিডনি সোবারকে বলেছিলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে মৌলিক বিষয়ে সমঝোতা না হওয়া পর্যন্ত মুজিবকে মুক্তি দেয়া ভুট্টোর মারাত্মক ভুল ছিল।
সিআইএর ৩ জানুয়ারির রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, মুজিব ছিলেন মধ্যপন্থি। তার পেছনে রয়েছে বিশাল জনশক্তি। একইসঙ্গে রাজনৈতিক, সামরিক এবং গেরিলা বাহিনীর ওপর তার প্রভাব ছিল প্রচণ্ড- তিনিই কেবল এই মুহূর্তে দেশটিকে স্থিতিশীলতার দিকে নিয়ে যেতে পারেন। মার্কিন গোপন নথিতে পরিদৃষ্ট হয় যে, বাংলাদেশের মধ্যে বিভিন্ন গ্রুপ ও উপদলীয় কোন্দল নিরসনে শেখ মুজিবের অবিলম্বে মুক্তি ব্যতীত অন্য কোনো বিকল্প নেই।
আগামীকাল প্রকাশিত হবে
‘ট্রামকার্ড’
‘যেভাবে স্বাধীনতা পেলাম’- বইটি পাওয়া যাচ্ছে ভোরের কাগজ প্রকাশনে (ভোরের কাগজ কার্যালয়, ৭০, শহীদ সেলিনা পারভীন সড়ক, মালিবাগ, ঢাকা)। এ ছাড়া নযড়ৎবৎশধমড়লঢ়ৎড়শধংযধহ.পড়স থেকেও সংগ্রহ করা যাবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়