চাকরি দেয়ার নামে প্রতারণা : চালকের সহকারী শাহীরুল এখন কোটিপতি

আগের সংবাদ

তিস্তার তাণ্ডবে লালমনিরহাটে পথে বসেছে হাজারো পরিবার

পরের সংবাদ

পল্টু আমার পল্টু

প্রকাশিত: অক্টোবর ২৫, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ২৫, ২০২১ , ১:০১ পূর্বাহ্ণ

একবিংশ শতাব্দীতে এসে বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের কথা বলি। চাঁদপুর কদমতলা প্রাইমারি ইস্কুলে পড়ি। হাফ টাইম ছিল ‘হাফেনার’ পরিচিতিতে। মূল শব্দ ছিল আসলে ইংরেজিতে ‘হাফ অ্যান আওয়ার’। মানে অর্ধঘণ্টার বিরতি। আমাদের বাড়ি ইস্কুল থেকে অনেক দূরে। প্রায় মাইল দুয়েক। সেকালে ইস্কুলে বাড়ি থেকে টিফিন নেয়ার দস্তুর ছিল না। হাত খরচাও তেমন মিলত না। পল্টুর বাসা কাছেই। পল্টু প্রতিদিন ‘হাফেনারে’ বাসায় গিয়ে কিছু খেয়ে আসত। পল্টু আমার প্রাণবন্ধু। একদিন জোর করে আমাকে ওদের বাসায় হাফ টাইমের ঝটিকা সফরসঙ্গী করে নিল। শরম সংকোচ নিয়ে আমি দুপুরে তার বাসায় যাওয়ার একপ্রকার নিত্যসঙ্গী হয়ে গেলাম। পল্টু আমাকে প্রথম দিনই সাবধান করে দিল। সব ঘরে ঢুকতে পারবি। একটি ঘর ছাড়া। ওটা ওদের পূজার ঘর। পল্টুর মা ছিলেন আদর দেয়ার মতো একজন মা। ওই স্বল্প সময়ে নাড়ু, লাড্ডু, পিঠা ইত্যাদি বরাদ্দ ছিল প্রতি দুপুরে। পল্টু এবং আমার বন্ধুত্ব ছিল দারুণ।
তা একদিন ইস্কুলের কোনো এক বড় অবকাশ শেষে এসে দেখি পল্টু ক্লাসে আসছে না। ভাবলাম অসুখ-বিসুখ। দেখতে গেলাম। এই জীবনে এমন ধাক্কা কম খেয়েছি। এক মহিলা দরজা খুলে বললেন, ‘পল্টুরা তো নাই। অরা ইন্ডিয়া চইল্যা গেছে। এই বাড়ি এহন আমাগো।’ এখনো আমি প্রায়ই নিঃশব্দে নীরবে চিৎকার করে উঠি, পল্টু তুমি কই, পল্টু তুই কই। আমার জীবন থেকে চিরতরে হারিয়ে গেল।
পল্টু আমাকে না জানিয়ে চলে গেল। বড় অভিমান আমার। আরো একটু বড় হতে হতে দেখতে থাকলাম, এমনি হঠাৎ হঠাৎ না বলে ‘ইন্ডিয়া’ চলে যাওয়ার ঘটনা। আর তার নিকট-বন্ধুদের অভিমানজাত রাগ। ‘হিন্দুরা এমনই। বন্ধুদের না জানিয়ে চলে যায়।’ আর একটু বড় হয়ে বুঝতে থাকলাম, এভাবে না জানিয়ে যাওয়ার কারণ ‘নিরাপত্তা বোধ’, ‘ইন্ডিয়া চিরতরে’ যাওয়ার পথে অনেকেই সর্বস্ব হারিয়েছে। সুতরাং ‘বন্ধু-বান্ধব-পরিচিত কাউরে কবি না।’ পারিবারিক নিষেধাজ্ঞায় লাখ লাখ ‘মানবিক সম্পর্ক’ এভাবে থেঁতলে গেছে। যার যার দুঃখ, জটিলতা তারা সেটা বোঝে। অন্যের পক্ষে বোঝা কঠিন। ‘আমি তো কাছের বন্ধু, আমাকে বলে গেল না!’ প্রতাপ ছিল ময়মনসিংহের নিষ্ঠাবান ছাত্রনেতা। প্রগতিশীল বাম মতাদর্শে প্রাণপাত শ্রম দেয়া অগ্রণী একজন সেই শহরের। বাবরি মসজিদ ঘটনার পর হঠাৎ তাদের পরিবার কাউকে না জানিয়ে শিলিগুড়ি চলে গেল। প্রতাপও। বড় রকমের আঘাত সহকর্মীদের। ময়মনসিংহ শহর কাঁপিয়ে দেয়া বিদ্যুৎ ঘোষ। বিশাল সম্পত্তি বিক্রি করেও প্রায় নিঃস্ব অবস্থায় দেশত্যাগ করল সে বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকেই। প্রতাপ এখন শুনেছি শিলিগুড়িতে ক্ষুদ্র দোকানদার। ময়মনসিংহ শহরেই এমনি কত হাজার প্রতাপ আর বিদ্যুৎ চিরতরে হারিয়ে গেছে।
এখন ‘কার্যকারণ’ খুঁজি। উপমহাদেশের মানচিত্র টুকরো টুকরো করে হিন্দু প্রধান ‘ভারত’ আর মুসলিম প্রধান ‘পাকিস্তান’ গড়ে ১৯৪৭ সালে ‘বুদ্ধিমান’ ব্রিটিশরা উপনিবেশ ছেড়ে দিল। যাওয়ার সময় যে গিট্ঠু লাগিয়ে গেল, সেই গিট্ঠু দিন দিন জটিল থেকে জটিলতর হতেই থাকল। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক মতাদর্শকে হারিয়ে দিয়ে যে বাংলাদেশের জন্ম, সেখানেও সাম্প্রদায়িকতার নব নব কৌশলের আঘাত বেড়েই চলেছে। একবিংশ শতাব্দীর একবিংশ বছরে শিউলি কাশবনের বাংলায় সর্বজনীন শারদীয় উৎসবে উৎপাতের শবদেহ রক্ত ঝরাল। গুজবে, চক্রান্তে, প্রযুক্তির অপকাণ্ডে লাখ লাখ শিশুর আনন্দময় মুখগুলো কেমন আতঙ্কিত, শুকনো হয়ে গেল। আনন্দের রং হয়ে গেল বেরং মøান।
এই ঘটনা কারা ঘটাল। গবেষকদের কথা এবং ভাষার ভেতর যাচ্ছি না। তবে সাধারণ হিসেবেই বলা যায়, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর মৃত্যু ব্যবসায়ী তথা অস্ত্র বিক্রেতাদের প্রয়োজন হলো নতুন নতুন উত্তেজনার। অতএব খ্রিস্টানকে করো কট্টর খ্রিস্টান, মুসলমানকে করো অধিক উগ্র, হিন্দুত্বের ঝাণ্ডা উড়াও দিল্লির লালকেল্লায়, শান্তিপ্রিয় বৌদ্ধদেরও উগ্রতার সুধা সেবন করাও। চারদিকে দ্ব›দ্ব-যুদ্ধ লাগিয়ে দাও। পৃথিবীজুড়ে ধর্মের মানবিকতা নিয়ে যারা নিজেদের নিয়োজিত রেখে আসছিল, তারা সব দেশেই প্রান্তিক হতে থাকল। ধর্মবাণিজ্যের প্রসার ঘটতে থাকল। এতকালের যুক্তিশীল প্রগতিশীল অনেকের মগজেও সাম্প্রদায়িকতার অঙ্কুর গজাতে দেখছি। বুদ্ধিদীপ্ত রং কেমন বেরং হতে থাকল ক্রমাগত। সাফল্য ওই বিশ্ব অস্ত্র বিক্রেতাদের। না জেনেই আমরা ওদের মদদ দিয়ে চলছি।
১৯৪৭-এ গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং হলো দেশভাগের মনস্তত্ত্বকে জোরদার করার জন্য। মানুষ এবং বাংলা ভাগ হলো, কোটি কোটি লোকের মর্মান্তিক ও ভয়ংকর নৃশংস দেশান্তর হলো, যা আজো ঘটে চলেছে। ১৯৫৪ সালে পাকিস্তানে মুসলিম লীগ সরকার পূর্বাঞ্চলে প্রাদেশিক নির্বাচনে কুপোকাত হওয়ার পর দাঙ্গা বাধিয়ে যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দিল। ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব ক্ষমতা কব্জা করে এ অঞ্চলের প্রতিষ্ঠিত হিন্দু ব্যবসায়ীদের ‘চোরাচালানি’ তকমা লাগিয়ে কোমর ভেঙে দিল। পল্টুদের মতো লাখো পরিবার দেশান্তরী হলো নব স্রোতে। ১৯৬৪ সালে সেই আইয়ুব গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে স্তব্ধ করার জন্য দাঙ্গা বাধাল। বাকি পল্টুদের অনেকে দেশান্তরী হলো। স্বাধীন বাংলাদেশেও সাম্প্রদায়িকতার মনস্তত্ত্ব তেমন দুর্বল হলো না। রাজনীতি এবং সমাজের নানা স্তরে সাম্প্রদায়িক চেতনা বরং নিত্যনিয়ত বেড়েই চলল। অপেক্ষাকৃত সবল শক্তি ‘সংখ্যাগুরু’ পরিচয়ে দুর্বল ‘সংখ্যালঘুদের’ অবস্থা গুরুতর করে তুলল। নৃতাত্ত্বিক জাতিসত্তাগুলো নিপীড়নের শিকার হলো। বৌদ্ধদের ওপরও নির্যাতন হলো। ধর্মীয় বিভেদ-বিদ্বেষের আড়ালে সম্পদ দখলের হিংস্র এবং হীন কাণ্ড ঘটাতে লাগল ক্ষমতাবানরা। এসব নিয়ে বিশাল বিশাল পুস্তক ও গবেষণাপত্র তৈরি করা যেতে পারে।
তা এসবের অবসান ঘটবে কবে কেমন করে! জানি না। বুকের ভেতর পাষাণ বেঁধে আছি। অবশিষ্ট পল্টুরা প্রিয় জন্মভূমি ছেড়ে নিরাপত্তা-মরীচিকায় পুনঃছুটতে থাকবে কি?
কুমিল্লায় এমন ঘটনা কারা ঘটাল? পারস্পরিক দোষারোপ চলছে। কে হারল কে জিতল? বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির হাল্কা এবং ভারী অংশের তো পুষ্টি ঘটলই। ভারতে হিন্দুত্বের শক্তি নবজাগ্রত হয়ে আসন্ন রাজ্য নির্বাচনগুলোতে নবশক্তিতে সজ্জিত হওয়ার মওকা পেয়ে গেল। এপারে কুমিল্লা, ওপারে ত্রিপুরা। কে ঘটাল তা নিয়ে অনুসন্ধান চলুক। আমরা বুঝি সাম্প্রদায়িক শক্তি উপমহাদেশজুড়েই চটকদার রং চড়াতে সুযোগ পেল। অসাম্প্রদায়িক শক্তি বেরং রক্তহীন দুর্বল হয়ে পড়ল আরো একটু।
তবে ভারতের উত্তর প্রদেশের যে মোজাফফরনগরে বছর কয়েক আগে সাম্প্রদায়িক ভয়ংকর দাঙ্গা হলো, সেই মোজাফফরনগর কিছুকাল আগে এক নব আশার উদাহরণ গড়ল। সেই হিন্দু-মুসলমান সে অঞ্চলে এক মঞ্চে উঠল, একসঙ্গে কৃষকের বাঁচার দাবিতে এক কণ্ঠ হলো। জীবনের প্রয়োজনে বিদ্বেষ-বিভেদ ভুলে এক হলো। সব ধর্মাবলম্বীকে এক হওয়ার মতো ইস্যু খুঁজে অসাম্প্রদায়িকতার নব টিকা তৈরিতে সফল হবো কি আমরা? পল্টুকে যেন খুঁজে পাই হারানো শৈশবের স্মৃতি সমুদ্র থেকে।

হিলাল ফয়েজী : মুক্তিযোদ্ধা ও রম্যলেখক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়