রাশিয়ার একাতেরিনবার্গে ভেজাল মদপানে মৃত্যু ১৮

আগের সংবাদ

মরুর বুকে গতির ঝড় অব্যাহত

পরের সংবাদ

‘হামরা এখন কী খায়া বাঁচমো’

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৯, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ১৯, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

পীরগঞ্জ (রংপুর) প্রতিনিধি : বিভীষিকাময় আগের রাতে প্রাণ বাঁচাতে জঙ্গলে কিংবা ধানক্ষেতে লুকিয়ে ছিলেন রংপুরের পীরগঞ্জের বড় করিমপুর গ্রামের হিন্দু বাসিন্দারা। ভোরে পুলিশের মাইকিংয়ে পোড়া ভিটায় ফিরে আসেন তারা। তারপরই আতঙ্ক পরিণত হয় আহাজারিতে। বসতবাড়িতে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগে নিঃস্ব মানুষের চোখেমুখে সর্বস্ব হারানোর বেদনার পাশাপাশি ছায়া ফেলছিল অজানা শঙ্কাও।
গতকাল সোমবার সকালে ওই গ্রামে ঢুকতেই নারী, পুরুষ ও শিশুদের আহাজারি শোনা গেল। নন্দ রানী (২৩) ও তার শাশুড়ি সুমতি রানী (৫৫) বুক চাপড়ে আহাজারি করছিলেন। দেখা গেল, সুমতির তিন ছেলের টিনের চারটি বসতঘর ও ঘরগুলোর ভেতরে থাকা যাবতীয় জিনিস পুড়ে গেছে। আগুনে পুড়েছে তাদের দুটি গাভী। যে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় সংসারের চাকা ঘুরত, সেটিও পুড়ে শেষ। সুমতির ছেলে প্রদীপ চন্দ্র বলেন, রাতে শত শত মানুষ ধর্মীয় সেøাগান দিয়ে বাড়িতে ঢুকে পড়ে। এ সময় দুজন তাকে মারধর করলে তিনি দৌড়ে কোনোমতে রক্ষা পান। পরিবারের অন্য সদস্যরাও ভয়ে বাড়ি থেকে চলে যান। হামলাকারীরা ঘরে থাকা ২৫ হাজার টাকা, টিভি ও একটি গরু নিয়ে গেছে। যাওয়ার সময় বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়।
একটু এগোতেই আরেক বাড়িতে কান্নার শব্দ। ভেতরে ঢুকে দেখা যায়, একটি শিশু ও এক নারী পোড়া ঘরের বারান্দায় বসে কাঁদছেন। ওই নারীর নাম তারা রানী। শিশু বর্ষা রায় (৯) তার মেয়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়িতে ফিরে স্ত্রী-সন্তানকে ব্যর্থ সান্ত¡না দিচ্ছিলেন ননী গোপাল রায়। তিনি জানান, তার চারটি টিনের ঘর, ধান, চাল ও আসবাবপত্র পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তারা রানী আহাজারি করে বলছিলেন, ‘ভগবান! হামরা কী দোষ করিনু বাহে। হামার সউব শ্যাষ হয়া গেল। হামরা এখন কী খায়া বাঁচমো।
ননী গোপাল বলেন, তিনি ঘটনার সময় বাড়িসংলগ্ন রাধাগোবিন্দ মন্দিরে পূজা করছিলেন। হঠাৎ শত শত লোক দল বেঁধে বাড়ি ও মন্দিরে ঢুকে আগুন ধরিয়ে দেয়। লুট করে নিয়ে যায় গরু ও স্বর্ণালঙ্কার। পরনের কাপড় ছাড়া সব পুড়ে গেছে। থানায় ফোন করলেও পুলিশের সহযোগিতা পাননি বলে তিনি অভিযোগ করেন।
পূর্ণিমা রানী বলেন, হামলাকারীরা বাড়িতে ঢুকে তার দুই তরুণী মেয়ে কোথায়, তা জানতে চায়। ঘরে ঢুকে ভাঙচুর করে ৫০ হাজার টাকা ও একটি গরু নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। গ্রামের নিরঞ্জন রায় বলেন, ১৫টি পরিবারের ২১টি বসতঘর সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। গ্রামের অন্তত ৫০টি বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়েছে। হামলাকারীরা অন্তত ২৫টি গরু ও ১০টি ছাগল নিয়ে গেছে।
হরিদাস রায় নামে এক বৃদ্ধ বলেন, রাতে যখন পাশের বাড়িতে হামলা হয়, তখন তিন বছরের নাতি ও অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে পাশের ধানক্ষেতে ঢুকে পড়ি। স্ত্রীকে মাটিতে শুইয়ে দিয়ে নাতিকে নিয়ে চুপচাপ বসে থাকি। শুধু শোরগোল কানে বাজছিল। একসময় কে যেন টর্চ জ্বালায় ধানক্ষেতের দিকে। ঠিক সেই মুহূর্তে অবুঝ নাতির কাশি শুরু হলে তার মুখ চেপে ভগবানের নাম জপতে থাকি। এভাবে অন্ধকারে কেটে যায় অনেকটা সময়। এরপর মাইকে শুনতে পাই, কে যেন বলছেন- আমরা প্রশাসনের লোক, আপনারা কেউ কোথাও লুকিয়ে থাকলে বাইরে আসেন। আর কোনো সমস্যা নেই। পরে একটু মাথা উঁচু করে দেখি পুলিশ মাইকিং করছে। তখন বাসায় ফিরেছি।
রানীবালা (৩৫) বলেন, যখন বুঝলাম গ্রামে হামলা হয়েছে, তখন আমার ক্লাস এইটের ছেলে গৌতম রায়কে নিয়ে পাশের ধানক্ষেতের ভেতরে গিয়ে শুয়ে পড়ি। শরীর চুলকাতে থাকে। তারপরও কষ্ট করে শুয়ে থাকি। স্যাররা (পুলিশ) মাইকে ডাকলে ভোরে বের হয়ে বাড়িতে এসে দেখি, ঘরে আগুন জ্বলছে। জীবনে এমন কষ্টের দিন আসবে, কোনো দিন ভাবিনি।
নয়নী রানী বলেন, সামনে মেয়ের বিয়ে। বিয়ের জন্য কিছু জিনিস কেনা হয়েছিল। শাড়ি-গয়না সব শেষ হয়ে গেছে। ঘরে থাকা ১ লাখ টাকাও লুট হয়েছে।
ওই গ্রামের বাসিন্দা রাসেল মিয়া (৩৫) ঘটনার অভিন্ন বর্ণনা দিয়ে বলেন, হিন্দুদের বাড়িতে হামলা, লুটপাট ও আগুন লাগানোর ঘটনা মর্মান্তিক। এমন নিষ্ঠরতা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না।
রামনাথপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাদেকুল ইসলাম বলেন, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আদলে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে ওই গ্রামে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার আগেই সবকিছু পুড়ে যায়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়