রাশিয়ার একাতেরিনবার্গে ভেজাল মদপানে মৃত্যু ১৮

আগের সংবাদ

মরুর বুকে গতির ঝড় অব্যাহত

পরের সংবাদ

চৌমুহনীতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা : জুমার আগে প্রতিমা বিসর্জন তবুও ঠেকানো যায়নি হামলা

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৯, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ১৯, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মোহাম্মদ সোহেল, নোয়াখালী থেকে : কুমিল্লা, চাঁদপুরের পর সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে নোয়াখালীতে। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার ছয়ানী ইউনিয়নে আর শুক্রবার দুপুরে একই উপজেলার চৌমুহনী এলাকার অন্তত ১২টি পূজামণ্ডপে হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। হামলায় প্রাণ হারান হিন্দু সম্প্রদায়ের এক যুবক, আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে মারা যান আরেক ব্যক্তি।
পূজামণ্ডপে তাণ্ডবলীলা : নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত পূজামণ্ডপগুলো সরজমিন পরিদর্শনকালে দেখা যায়, ১২টি মণ্ডপেই ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে। সর্বপ্রথম হামলা চালানো হয় বেগমগঞ্জ উপজেলার ছয়ানী বাজার এলাকার শ্রীশ্রী সার্বজনীন দুর্গা মন্দিরে। পুরো মন্দিরে ক্ষত-বিক্ষত। মাটিতে পড়ে আছে দুর্গা দেবীর প্রতিমা। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই শুরু হয় অতর্কিত হামলা। হামলাকারীরা প্রথমেই বাড়ির বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে। অন্ধকারের মধ্যে চলে লুটপাট। এরপরই হামলা হয় মণ্ডপে। প্রথমেই হামলা হয় স্থানীয় শীল পরিবারের বাড়িতে। ওই বাড়িতে হামলা চালিয়ে লুট করা হয় ৫০ হাজার টাকা ও ৫ ভরি স্বর্ণালঙ্কার। হামলায় গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন পরিবারের সদস্য সুমন চন্দ্র শীল। পরিবারের বয়োবৃদ্ধ নিমাই চন্দ্র শীল

বলেন, ‘আমরা কল্পনাও কইরতে পারিনাই এমন হামলা হইব। মণ্ডপে মাত্র দুইজন পুলিশ আছিলো। হেতারা হামলা দেখি দৌড়াই পালাই গেছে। আমার পোলারে পিডি পুরা শরীর পাঠাই পালাইছে। হেতে অহন হাসপাতালো। ঘরে পূজা করি যে হেই প্রতিমাও ভাঙ্গি শেষ করি হালাইছে। আমগো দুর্গা প্রতিমা ভাঙ্গি শেষ করি হালাইছে, আমরা বিসর্জনও দিতাম পারি নাই।’
শুক্রবার জুমার নামাজের পর একাধারে হামলা হয় বেগমগঞ্জ উপজেলার ১১টি মণ্ডপে। বাদ যায়নি নোয়াখালীর প্রধান ইসকন মন্দিরটিও। শুক্রবারের হামলার পর শনিবার সকালে এই ইসকন মন্দিরের পুকুরেই পাওয়া যায় প্রান্ত চন্দ্র দাস নামে এক ভক্তের লাশ। সেই সঙ্গে হামলায় গুরুতর আহত হন মন্দিরের তিনজন ভক্ত। হামলায় মন্দিরের অন্তত ৫০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। হামলায় পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে ইসকনের প্রতিষ্ঠাতা আচার্য শ্রীল প্রভুপাদের ভাস্কর্য। মন্দিরের উঠানে দুর্বৃত্তরা এক ভক্তের মাথার চুল কেটে দেয়। পরে পিটিয়ে মাথা ও পা ভেঙে দেয়। মন্দিরের উঠানে রক্তের দাগ দৃশ্যমান, পাশেই পড়ে ছিল কেটে ফেলা মাথার চুলের টিকি।
মন্দিরের অধ্যক্ষ রসপ্রিয় দাস আক্ষেপের সুরে বলেন, আমরা কোনো রাজনীতিতে নেই, আশপাশের সব ধর্মের ভাইদের নিয়ে মিলেমিশে থাকি, কারো সঙ্গে কোনো বিভেদ নেই। শান্তিপূর্ণভাবে আন্তর্জাতিকভাবে ধর্ম প্রচার করি। কোন দোষে এমন নৃশংস হামলার শিকার হলাম? আমাদের একটাই দাবি- প্রশাসন এর সুষ্ঠু তদন্ত করে বিচার করুক।
উদ্দেশ্য রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ও লুটপাট : ১২টি মন্দিরের সবকটির লোহার সিন্দুকই ভাঙা হয়েছে। লুট করা হয়েছে মূল্যবান সামগ্রী। যেটা নেয়া সম্ভব হয়নি সেটা বিনষ্ট করা হয়েছে। হামলার সময় মিছিলে পাঞ্জাবি পরিহিতরা নেতৃত্ব দিলেও হামলা ও লুটপাটে নেতৃত্ব দিতে দেখা যায় শার্ট-প্যান্ট পরিহিত কিশোর-যুবকদের। এ বিষয়ে নোয়াখালী হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক বিনয় কিশোর রায় বলেন, এটা কুমিল্লার ঘটনার রেশ। তবে এই হামলার পরিকল্পনা অনেক আগে থেকেই করা হয়েছে। কুমিল্লার ঘটনাকে পুঁজি করে আমাদের এখানে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতেই বিএনপি-জামায়াত-শিবির পরিকল্পনা করে এই হামলা করেছে। নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক এডভোকেট শিহাব উদ্দিন শাহীন বলেন, এটা নিঃসন্দেহে জামায়াত-শিবিরের কাজ।
নোয়াখালী পুলিশ সুপর (এসপি) মো. শহীদুল ইসলাম জানান, চৌমুহনীর পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। ১৮টি মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৯০ জনকে।
হামলা ঠেকাতে ব্যর্থ প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা : বেগমগঞ্জের ছয়ানী ইউনিয়নের মন্দিরে ও হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে হামলার পরদিন শুক্রবার বিজয়া দশমিতে বিকালে প্রতিমা বিসর্জন দেয়ার কথা থাকলেও পুলিশ প্রশাসন থেকে বেলা ১১টার মধ্যে তা শেষ করার কথা সব মণ্ডপে জানিয়ে দেয়া হয়। শুক্রবার জুমার নামাজের পর মুসল্লিদের সঙ্গে যেন মুখোমুখি অবস্থান তৈরি না হয় সে জন্য ওই সিদ্ধান্ত নেয় প্রশাসন। সে অনুযায়ী প্রতিমা বিসর্জনও হয়ে যায় ওই সময়ের মধ্যেই। এরপরও হামলা হয় মন্দিরগুলোতে। এ ঘটনাকে প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ব্যর্থতা হিসেবে দেখছেন হামলার শিকার মন্দিরগুলোর কর্তৃপক্ষ ও হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। নোয়াখালী হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক বিনয় কিশোর রায় বলেন, কুমিল্লা, চাঁদপুরের পর বেগমগঞ্জের ছয়ানীতে হামলার পর আমরা পুলিশের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তাদের পরামর্শে আমরা বিকালের পরিবর্তে সকালেই প্রতিমা বিসর্জন দিয়েছি। এরপর যখন হামলা শুরু হলো তখন আমরা পুলিশ ও এমপিকে টেলিফোন করে সহযোগিতা চেয়েছি। তারা আসছেন আসছেন করে তিন ঘণ্টা পার হয়ে যায়। এর মধ্যে আমাদের মন্দিরগুলোতে তিন দফা হামলা লুটপাট হয়।
এ বিষয়ে নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক এড. শিহাব উদ্দিন শাহীন বলেন, এটাকে আমরা ব্যর্থতা বলব না। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই হামলা চালানো হয়েছে। হামলার আগে আমাদের নেতাকর্মীদের আরো একটু সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের আগামীর জন্য প্রস্তুত হতে হবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়