সারাদেশে পূজামণ্ডপে হামলা : চাঁদপুরে সংঘর্ষে নিহত ৩

আগের সংবাদ

বিশ্বকাপে বাংলাদেশের টার্গেট কী? প্রথম ম্যাচে মাহমুদউল্লাহ-সাকিবের মাঠে নামা নিয়ে দোটানা

পরের সংবাদ

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের ষড়যন্ত্র : বিশিষ্টজনের মতে, কুমিল্লার ঘটনা ও পরবর্তী সময়ে মন্দির-মণ্ডপে হামলা পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র > আইনের কঠোর প্রয়োগ ও শাস্তি নিশ্চিতের তাগিদ

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৫, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ১৫, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ঝর্ণা মনি : কুমিল্লায় পূজামণ্ডপে কথিত ‘পবিত্র কুরআন অবমাননার’ ঘটনা সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। ওই ঘটনাকে ইস্যু করে দেশের বিভিন্ন স্থানে মন্দিরে হামলা ও ভাঙচুরের মাধ্যমে দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করতে চায় তারা- এমন অভিমত দেশের সচেতন মহলের। তাদের মতে, ইসলামের নামে উগ্র সাম্প্রদায়িক-রাজনৈতিক শক্তি এই অপকর্মের সঙ্গে জড়িত। কঠোর আইন প্রয়োগের মাধ্যমে এদের মুখোশ উন্মোচিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের তাগিদ দিয়ে বিশিষ্টজনরা বলেন, বিদ্যমান পরিস্থিতি উত্তরণে প্রয়োজন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সর্বস্তরে সামাজিক সচেতনতা। দরকার সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক ঐক্য। অপশক্তির বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ। সরকারের পাশাপাশি সর্বস্তরের মানুষকে ঐক্যবদ্ধভাবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার আন্দোলনে সামিল হওয়ারও আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
প্রসঙ্গত, বুধবার সকালে কুমিল্লায় নানুয়া দিঘীরপাড় পূজামণ্ডপে কথিত ‘কুরআন অবমাননার’ অভিযোগ তুলে বেশ কিছু মন্দিরসহ শহরের সালাউদ্দীন রোড কালীগাছতলা ও কাপুড়িয়া পট্টির মণ্ডপেও হামলা হয়। পরে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে শহরে বিজিবি মোতায়েন করা হয়। এর জেরে গাজীপুর, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও মৌলভীবাজারে বেশ কিছু মন্দির ও পূজামণ্ডপেও হামলা-ভাঙচুর হয়। চাঁদপুরে হামলাকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে প্রাণহানিও ঘটে। পরে সেখানে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলায় মন্দিরে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগে ১৮ জনকে আটক করেছে পুলিশ। বান্দরবানের লামা উপজেলায় মিছিল করে এসে মন্দির ও হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা করা হয়েছে। এ সময় দুইপক্ষের সংঘর্ষে ১২-১৩ জন আহত হন। সংঘর্ষ থামাতে গিয়ে একজন এসআইসহ তিন পুলিশ সদস্যও আহত হন।
কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্মকে ব্যবহার করে যারা সহিংসতা সৃষ্টি করছে তাদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হবে বলে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, যেখানে যেখানে যারাই এই ধরনের কোনো ঘটনা ঘটাবে সঙ্গে সঙ্গে তাদের খুঁজে বের করা হবে। আমরা অতীতেও করেছি, ভবিষ্যতে আমরা করতে পারব এবং যথাযথ শাস্তি তাদের দিতে হবে। এমন শাস্তি- যেন ভবিষ্যতে আর কেউ সাহস না পায়, সেটাই আমরা চাই।
পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র : কুমিল্লার ঘটনাকে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র হিসেবেই দেখছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তাদের মতে, এর পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়ে একটি মহল সব সময় গুজব রটনার কাজে লিপ্ত এবং তারা গুজব রটিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে দেশের সম্প্রীতি, শান্তি বিনষ্ট করার অপকর্মে সব সময় লিপ্ত। শিগগিরই সঠিক তথ্য বেরিয়ে আসবে। ‘সাম্প্রদায়িক উসকানি দিয়ে’ যারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে, তাদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, সারাদেশে প্রতিটি পূজামণ্ডপে শান্তিপূর্ণভাবে পূজা হচ্ছে বলে যাদের গাত্রদাহ, তারা দেশকে পিছিয়ে দিতে চায়। তাদের অপকৌশলের একটি হচ্ছে হিন্দু-মুসলমানের বৈরিতা সৃষ্টি করা। শেখ হাসিনার সরকার এই অপশক্তিকে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে দেবে না। যে কোনো সাম্প্রদায়িক উসকানির বিরুদ্ধে আমাদের সচেতন হতে হবে। দলের নেতাকর্মীরা সতর্ক অবস্থানে থাকবে জানিয়ে তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী বেশ কয়েকটি জায়গায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার পাঁয়তারা করছে।
দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, অতীতে যারা পদ্মা সেতু নিয়ে নানা ধরনের গুজব রটিয়েছে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে দেশ ও মানুষের কল্যাণের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে, সেই একই মহল এবারের ঘটনা ঘটিয়েছে। যারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে এবং একে ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ নানাভাবে গুজব রটনা করেছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে সরকার বদ্ধপরিকর। তিনি বলেন, গত কয়েক বছরের ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এগুলোর পেছনে হীন উদ্দেশ্য ছিল, যেগুলো সরকার কঠোর হস্তে দমন করেছে। কুমিল্লায় নানুয়া দিঘীরপাড়ে অত্যন্ত শান্ত একটি পরিবেশে হিন্দু, মুসলিম ভাইয়েরা মিলে শান্তিপূর্ণভাবে যুগ যুগ ধরে বসবাস করছেন, সেখানে রাতের বেলায় মন্দির বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। কোনো মানুষ ছিল না, বাতিও বন্ধ ছিল। সেই পরিস্থিতিতে কে বা কারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে, সেটি পুলিশ তদন্ত করছে। আমি নিশ্চিত, কারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে, সেটি খুব সহসা বের হবে এবং তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হবে।
এদিকে কুমিল্লার পূজামণ্ডপে ঘটে যাওয়া ঘটনায় কয়েকজনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। ইতোমধ্যে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৪৩ জনকে আটক করার কথা জানিয়েছে পুলিশ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানান, স্বার্থান্বেষী মহলের উদ্দেশ্যমূলক কাজ এটি। জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কেউ উসকানি দিলে তাকেও আইনের আওতায় আনা হবে। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও গুজব ছড়ানো হচ্ছে। যারা এসব অপচেষ্টা করছে ও করবে, তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে।
মণ্ডপ পরিদর্শনে গিয়ে জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, দেশ যখন এগিয়ে যাচ্ছে তখন একটি চক্র অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। এটা ষড়যন্ত্র তা স্পষ্ট। আমি দেশবাসীকে অনুরোধ করব আপনারা শান্ত থাকুন, কোনো উসকানিতে কান দেবেন না। এসব ঘটনা যারা ঘটিয়েছে তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে। আপনারা আস্থা রাখুন।
প্রয়োজন আইনের কঠোর প্রয়োগ : সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্ঠান্তমূলক শাস্তির দাবি করেছেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। তাদের মতে, দেশের হাজার বছরের সংস্কৃতির ওপর আঘাত প্রতিহতে আইনের কঠোরতার বিকল্প নেই। সেই সঙ্গে প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন। এই ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে এর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। তিনি বলেন, ইতোপূর্বেও আমরা লক্ষ্য করেছি, বিভিন্ন অজুহাতে মন্দির আক্রমণ, প্রতিমা ভাঙচুর এখন ব্যাপকভাবেই ঘটছে, এমনকি লক্ষ্য করা যাচ্ছে, সাম্প্রদায়িক বিভিন্ন ঘটনায় যুক্ত ব্যক্তিরা নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবেও প্রতিদ্ব›িদ্বতা করছে। সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি সৃষ্টির কৌশল হিসেবে কিছু গোষ্ঠী বারবার দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করছে। এই সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানাচ্ছি।
অশুভ শক্তি যাতে মাথাচাড়া দিয়ে না উঠতে পারে- এজন্য সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান ভোরের কাগজকে বলেন, সমাজে কিছু অশুভ শক্তি প্রায়ই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, যারা ধর্মীয় সহাবস্থানকে নষ্ট করার প্রয়াস করে। তবে আখেরে তারা টেকে না। যারা উৎসবপ্রিয় তারা অশুভ শক্তিকে প্রতিহত করে। বাঙালির বৈশিষ্ট্য অসাম্প্রদায়িকতা। আমাদের সবাইকে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়তে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপউপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ ভোরের কাগজকে বলেন, এদের আইনের আওতায় আনা ও সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতের বিকল্প নেই। এদের মুখোশ উন্মোচন প্রয়োজন। পরস্পরের সঙ্গে মেলামেশা, সচেতনতা তৈরি প্রয়োজন। সবাই রক্ত দিয়ে এ দেশ স্বাধীন করেছে। হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানের রক্ত লেগে আছে পতাকায়। এই সত্য সবাইকে মানতে হবে। একাত্তরে হিন্দুরা সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। এই সত্যি যেন আমরা ভুলে না যাই। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বাড়াতে হবে। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার বিকল্প নেই।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ ভোরের কাগজকে বলেন, আইনের কঠোর প্রয়োগ ছাড়া এদের ঠেকানো সম্ভব নয়। পরিকল্পিতভাবে যারা এ ধরনের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র করে, তাদের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ করতে হবে। সাংস্কৃতিক-সামাজিকসহ সব পেশাজীবী সংগঠনকে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করতে হবে।
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নির্মল চ্যাটার্জি ভোরের কাগজকে বলেন, পরিকল্পিতভাবে এই ষড়যন্ত্র। কোনো কারণ ছিল না। সবকিছু স্বাভাবিক ছিল। একটা গোষ্ঠী পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে এসব করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দোষীদের প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন, দোষীদের শাস্তি দিতে আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়