সারাদেশে পূজামণ্ডপে হামলা : চাঁদপুরে সংঘর্ষে নিহত ৩

আগের সংবাদ

বিশ্বকাপে বাংলাদেশের টার্গেট কী? প্রথম ম্যাচে মাহমুদউল্লাহ-সাকিবের মাঠে নামা নিয়ে দোটানা

পরের সংবাদ

বন্ধু, পিতা, শ্রদ্ধা-ভালোবাসা এবং দাদুভাই

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৫, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ১৫, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

৮০ সাল। তখন কিশোর বাংলা পত্রিকার ভরা যৌবন। দাদুভাইকে এটা দীর্ঘ চিঠি লিখলাম। দাদুভাই প্রতি সংখ্যায় কিছু বাছাই চিঠির উত্তর দিতেন। ছোট ছোট উত্তর। কিন্তু অসাধারণ তাৎপর্যময়। একদিন কথাচ্ছলে দাদুভাই বলেছিলেন, একটা ছেলে, একটা মেয়ে এভাবে, আমি চিঠির উত্তর দিয়ে থাকি। চিঠি লেখার সেসব দিন এখন হারিয়ে গেছে। উত্তরে দাদুভাই বলেছিলেন- একদিন কিশোর বাংলা কার্যালয়ে এসে দেখা করো। সেই প্রথম দাদুভাইয়ের হৃদয়-দুয়ারে প্রবেশ করলাম। আমি হয়তো লেখক হয়ে উঠিনি। কিন্তু লেখালেখির আগ্রহ উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা আমি বিস্তর পেয়েছিলাম দাদুভাইয়ের কাছ থেকে। দাদুভাই মাত্রাতিরিক্ত প্রশ্রয় দিয়েছিলেন আমাকে। পেছন পানে তাকাই যখন দেখি লাখ লাখ স্মৃতিখণ্ড মেঘের মতো উড়ে বেড়াচ্ছে আকাশে। দাদুভাই ছিলেন শিশুর মতো হৃদয়বান। চেতনায় বলিষ্ঠ। শিশুসাহিত্যের উজ্জ্বল সম্পাদক। আশ্চর্য নিপুণ ছড়াকার। অবিশ্বাস্য নাট্যকার। আর বিখ্যাত সংগঠক। ‘চাঁদের হাট’ আপনার অস্তিত্বের আলোক দিশারী। পত্রিকায় ছোটদের জন্য যে বিভাগ থাকে তাকে আপনি আধুনিকতায় রূপান্তরিত করেছেন। আপনার স্নেহধন্য ও আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে যারা জীবনপথের আলোকযাত্রী হয়েছেন তাদের সংখ্যা অগণন ইমদাদুল হক মিলন, আফজাল হোসেন, ফরিদুর রেজা সাগর, এনায়েত রসুল, রোকেয়া খাতুন রুবী, আবদুর রহমান, সাইফুল আলম, শাহ আলমগীর, মুনা মালতী, আলীমুজ্জামান, লুৎফর রহমান রিটন, নাসরীন জাহান- এরকম থোকা থোকা উজ্জ্বল নামের দীর্ঘ তালিকা তৈরি করা যায়। দাদুভাই দৃঢ়চেতা উদ্যোগী কর্মী পুরুষ। দীর্ঘকায় ব্যক্তি। মুখ ভরা হাসি। হৃদয়ভরা ভালোবাসা। দাদুভাইয়ের চুম্বক-ব্যক্তিত্বের আকর্ষণে বিমুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। সেই কিশোরকালে দাদুভাই কিশোর বাংলা থেকে হেঁটে হেঁটে মতিঝিলে হোটেল ডি বাদশাহতে নিয়ে গেলেন। আমি তখন ক্লাস টেনের ছাত্র। তখন বেলা ১১টা। বাদশাহ হোটেলে গরম সিঙ্গাড়া আর গরম চা। দাদুভাইয়ের প্রিয় আরো কেউ কেউ ছিল।
তাদের কথা আজ মনে পড়ছে না। দাদুভাই আমার মাথায় কলমের টোকা মেরে বললেন, আমীরুল তোমার মাথায় আরেকটু বুদ্ধি পুরে দিলাম। যেন তোমার কলম শিশুসাহিত্যের সোনার কলম হয়। আমরা ছোটমোট লেখক কি হতে পেরেছি? দাদুভাইয়ের আশীর্বাদ অনুযায়ী আমাদের কলম সোনার কলমে রূপান্তরিত হয়নি। কিন্তু দাদুভাইয়ের কথার সেই প্রেরণায় আমরা আজো লিখে চলেছি। দাদুভাই দুর্দান্ত চরিত্রের অধিকারী। খুব নাটকীয় ঢঙে কথা বলেন। চোখে-মুখে দ্যুতি খেলা করে। মজা করে কথা বলেন।
দাদুভাই রক্ত-মাংস-মজ্জায় একজন প্রকৃত ছড়াকার। তার মধ্যে কোনো ভেজাল নেই। শব্দ, ছন্দ ও বিষয় ভাবনায় তিনি আপাদমস্তক ছড়ামিশ্রিত ব্যক্তিত্ব। প্রায় ৭০ বছর ধরে একটানা ছড়া লিখেছেন। এত দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে আর কেউ ছড়া চর্চা করেছেন কিনা জানা নেই।
কৈশোরে খেলাঘর পাতায় দৈনিক সংবাদে তিনি প্রচুর ছড়া লিখেছেন। পঞ্চাশের দশকের ইতিহাস। খেলাঘর সম্পাদক অধুনা বিস্মৃত প্রায় কবি ও শিশুসাহিত্যিক হাবীবুর রহমান। বনে বাদাড়ে, লেজ দিয়ে যায় চেনা বা বনমোরগের বাসার অমর স্রষ্টা- দাদুভাই বলেন, হাবীবুর রহমান আমার দীক্ষাগুরু।
কৈশোরে হাবীবুর রহমানের শিক্ষা তাকে সারাজীবন প্রভাবিত করেছে। অকপটে দাদুভাই সেই স্মৃতিচারণ করেন। সৌভাগ্যক্রমে হাবীবুর রহমান আমার আপন চাচা। তাকে আমরা বড় আব্বা বলে জেনেছি। আমার লেখক হয়ে ওঠার গল্পও অনেকটা হাবীবুর রহমানের কারণে। ছোটবেলায় তার বই পড়েই মনে হয়েছিল আমিও শিশুসাহিত্য চর্চা করব।
দাদুভাই গভীর শ্রদ্ধাপোষণ করেন হাবীবুর রহমানের প্রতি। সেই কারণে ছোটবেলায় লেখালেখির সূত্রে আমিও একটু বাড়তি প্রশ্রয় পেলাম দাদুভাইয়ের কাছে।
কিশোর বাংলায় ছড়া, কবিতা, গল্প, ফিচার যা পাঠাতাম দাদুভাই সস্নেহে তা ছেপে দিতেন। লেখা ভালো না হলে কেটেকুটে ছাপার উপযোগী করে দিতেন।
কিশোর বাংলায় সবচেয়ে কম বয়সে আমার উপন্যাস ছাপা হয়। তখন মাত্র কলেজের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। একটা বিদেশি রূপকথাকে টেনেটুনে লম্বা করে দেশি ঢঙে লিখলাম। নাম দিলাম অচিন জাদুকর। দাদুভাই ছেপে দিলেন। ছবি এঁকেছিলেন আজকের বিখ্যাত আফজাল হোসেন। তিনি বিশ্বাসই করেননি এত অল্প বয়সি আমীরুলের উপন্যাস ছাপা হচ্ছে। সেসব মধুর আনন্দময় দিন আজ স্মৃতি হয়ে গেছে। জীবনের উজ্জ্বল স্মৃতি। ভাবলে গর্বে বুকটা ভরে ওঠে। কারণ দাদুভাইয়ের সান্নিধ্যে আমাদের জীবনও হয়ে উঠেছিল বর্ণাঢ্য।
কিছু কিছু বিষয়ের কারণে দাদুভাই আমার কাছে নমস্য হয়ে আছেন। লোকছড়ার সুরে যে প্রকৃত খাঁটি ছড়ার সুর এটা দাদুভাই প্রথম আমাকে উপলব্ধি করতে বলেন। ছড়ার মধ্যে কবিত্ব দরকার। তাই ছড়াকারও একজন কবি। একথাও দাদুভাইয়ের মুখেই প্রথম শুনেছি। দাদুভাই আমাকে প্রথম অন্নদাশংকর রায়ের ছড়া মুখস্থ শুনিয়ে ছিলেন। ব্যাঙ বললো ব্যাঙাচ্চি/দাঁড়াও তোদের ঠ্যাঙাচ্ছি… এই ছড়াটা।
আমি পরবর্তী জীবনে অন্নদাশংকর রায়ের সমগ্র ছড়া গভীর মনোযোগ দিয়ে অধ্যয়ন করি এবং বিস্মিত হয়ে ছড়ার গতিপথ অনুসন্ধান করতে থাকি।
আল মাহমুদ যে খুব বড় ছড়া লেখক- এটাও আমি দাদুভাইয়ের আলাপ-আলোচনায় বুঝতে পারি। কিশোরবেলাতেই আমি বাংলা ভাষার তিন মহাছড়াকারকে তুমুলভাবে শনাক্ত করতে পারি দাদুভাইয়ের কল্যাণে। অন্নদাশংকর রায়, আল মাহমুদ এবং রফিকুল হক। আমি পরে অনেক ছড়া লিখেছি এই জীবনে এবং এই মহান ছড়াকার দ্বারা বারবার প্রভাবিত হয়েছি। আমার চেতনায় তাদের ছড়াই ঝংকৃত হয়েছে আজীবন। এ নিয়ে আমার কোনো গøানিবোধ নেই। আমি এখনো দাদুভাইয়ের সুস্থ ছড়ার ঘনিষ্ঠ ও একান্ত পাঠক। দাদুভাইয়ের ছড়ার দু-চারটে লাইন ভেঙে ভেঙে কিছু ছড়া লিখেও ফেলি তা নিয়ে আমার শরম হয় না। বরং আমি গর্ববোধ করি। ছেলে ঘুমালো বুড়ো ঘুমালো ভোলা দ্বীপের চরে… এই পঙ্ক্তিকে মাথায় রেখে কত ছড়া যে লিখেছি কে তার হিসাব রাখে।
ছোটদের পাতার মেকাপ, লেখার সম্পাদনা, ইলাস্ট্রেশনের ব্যবহার, লেখা ছাপার ট্রিটমেন্ট- এসব একান্তভাবেই দাদুভাইয়ের কছে ঘুরে ঘুরে শিখেছি। দাদুভাই সরাসরি কিছু জোর করে চাপিয়ে দিয়ে শেখাতেন না। সবার মতামতের প্রতি তিনি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। ছেলে বা বুড়ো কাউকে অসম্মান করতেন। না। কারো ভেতরে প্রতিভার ঝলক থাকলে দাদুভাই সযতেœ তার পরিচর্যা করতেন। আশ্চর্য মানুষ তিনি।
হৃদয়ের ঐশ্বর্য অনেক বড় না হলে ‘দাদুভাই’ হওয়া যায় না। দাদুভাইয়ের হাতের লেখা অতীব সুন্দর। গোটা গোটা মুক্তার মতো। দাদুভাই পান চিবুতে ভালোবাসতেন। দাদুভাই ছড়া শোনাতে ভালোবাসেন। দাদুভাইয়ের তরুণ তাজা হৃদয়। তরুণদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশতে পারেন। শিশুদের সঙ্গে শিশুর মতো হয়ে যান। এক আশ্চর্য জাদুকরী ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ তিনি। দাদুভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলেই আমাদের মন প্রসন্ন হয়ে ওঠত। দাদুভাইকে ঘিরে রাখি। কথা আমাদের ফুরায় না। দাদুভাইও যে কোনো আসর মাতিয়ে রাখতেন। প্রাণ খুলে কথা বলতেন, আড্ডার মধ্যমণি হয়ে উঠতেন মুহূর্তে। আমার পিতৃব্য কবি হাবীবুর রহমান প্রয়াত হয়েছেন ১৯৭৬-এ। আমার পিতা সাইফুর রহমান প্রয়াত হয়েছেন ২০০৭ সালে। বাবা-চাচার মৃত্যু আমার হৃদয়ে চিরস্থায়ী ক্ষত হয়ে আছে। কিন্তু যখন দাদুভাইয়ের সান্নিধ্যে পেতাম তখন এসব বিয়োগ-ব্যথা ভুলে যেতাম। আপনিও চলে গেলেন। আপনি আমাদের বন্ধু ছিলেন। আমাদের পিতা বা পিতৃব্য। আপনি সুহৃদ-স্বজন। শ্রদ্ধা-ভালোবাসা আপনার প্রতি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়