তিতাস গ্যাস কর্মচারী ইউনিয়ন : পূর্ণ প্যানেলে জয়ী কাজিম-আয়েজ পরিষদ

আগের সংবাদ

যুদ্ধাপরাধ বিচারে স্থবিরতা ; বাকি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এগিয়ে নিতে সরকারের আগ্রহ নিয়ে সংশয়! ট্রাইব্যুনালেও জনবল সংকট

পরের সংবাদ

বুড়িগঙ্গার তীর নিয়ে টানাপড়েন : সদরঘাট সরাতে বিআইডব্লিউটিএকে ঢাকা দক্ষিণ সিটির চিঠি > যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে সংকট হতে পারে

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৩, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ১৩, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

রাশেদ আলী : বুড়িগঙ্গা তীরের বিভিন্ন প্রকল্প ও স্থাপনাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মধ্যে টানাপড়েন তৈরি হয়েছে। দুই সংস্থাই নদীর তীরে প্রায় একই ধরনের উন্নয়নকাজ করতে চায়। এর আগে সিটি করপোরেশনের আপত্তির মুখে প্রস্তাবিত কয়েকটি প্রকল্প থেকে সরে এসেছিল বিআইডব্লিউটিএ। কাটছাঁট করেছিল ওয়াকওয়ে নির্মাণ প্রকল্পেও। তবে সম্প্রতি ডিএসসিসি আহসান মঞ্জিল, লালকুঠি ও রূপলাল হাউসের সামনে থেকে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালের জেটিসহ অন্যান্য স্থাপনা সরিয়ে নিতে বলায় জটিলতা ভিন্ন দিকে মোড় নিয়েছে। এতে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে সংকট দেখা দেবে বলে মনে করছে বিআইডব্লিউটিএ। আর সিটি করপোরেশন বলছে, ঐহিত্য সংরক্ষণে এর কোনো বিকল্প নেই।
গত ২৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস পুরান ঢাকার লালকুঠি ভবন পরিদর্শনে যান। এর পরের দিনই দুটি চিঠি দেয়া হয় বিআইডব্লিউটিএকে। অতিরিক্ত সচিব ফরিদ আহমেদ স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে ‘অনতিবিলম্বে’ লালকুঠি, রূপলাল হাউস ও আহসান মঞ্জিলের সামনে থেকে সদরঘাট টার্মিনাল ও অন্যান্য স্থাপনা সরানোর অনুরোধ জানানো হয়। মেয়র গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বরও লালকুঠি ভবন পরিদর্শনে গিয়ে সদরঘাট টার্মিনালের কিছু অংশ অপসারণের কথা বলেছিলেন।
চিঠিতে বলা হয়, মোঘল নির্মাণশৈলী ও কৌশল অবলম্বনে ১৮৭২-১৮৭৯ সালে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে হ্যারিটেজ ভবন নর্থব্রুক হল (লালকুঠি) নির্মিত হয়। ১৯৬২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি এ ভবনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ঢাকা পৌরসভার পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। এক সময় এ ভবনের সৌন্দর্য নদী থেকে দেখা যেত। কিন্তু স্থাপনা নির্মাণের ফলে এখন আর সেটি দেখা যায় না। পার্শ্ববর্তী রাস্তা, ভাসমান হকার, কুলি ও মালামাল বহনকারী পরিবহনের কারণে এর পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। লালকুঠি সংস্কারে একটি প্রকল্প নেয়া হয়েছে জানিয়ে এতে বলা হয়, শিগগিরই ভবনের চারপাশে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হবে। ভবনটি নদী থেকে দৃশ্যমান হওয়ার জন্য বিআইডব্লিউটিএর টার্মিনালসহ অন্যান্য স্থাপনা অপসারণের

প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছেন মেয়র। তাই অবিলম্বে যেন সেগুলো স্থানান্তর বা অপসারণ করা হয়। আরেক চিঠিতে ১১ নম্বর ফরাশগঞ্জের রূপলাল হাউস ও সদরঘাটের পশ্চিমে আহসান মঞ্জিলের সামনের স্থাপনাগুলো সরিয়ে নেয়ার অনুরোধ জানানো হয়।
সিটি করপোরেশন যেসব স্থানের সামনে থেকে স্থাপনা সরাতে বলছে, ওই সব এলাকায় বিআইডব্লিউটিএর বেশ কয়েকটি ঘাট, পন্টুন, জেটি, বিশ্রামাগার প্রভৃতি রয়েছে। এছাড়া পুরান ঢাকার ব্যবসায়িক গুরুত্বপূর্ণ এলাকাও সেগুলো। সরজমিন গিয়ে দেখা গেছে, আহসান মঞ্জিলের ঠিক উল্টো দিকেই বুড়িগঙ্গার তীরে রয়েছে বিনয় সরকার বিনা স্মৃতি স্নানঘাট, একটি মসজিদ ও কয়েকটি খেয়াঘাট। পুরো এলাকাটিতে রয়েছে বাদামতলী পাইকারি ফলের আড়তসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। যেখানে বিআইডব্লিউটিএর ঘাট রয়েছে সেখানে অপেক্ষমান লঞ্চগুলো বেঁধে রাখা হয়। এছাড়া সেখানে একটি আরসিসি জেটি রয়েছে। যা স্থানীয়ভাবে এসপি ঘাট নামে পরিচিত। নদী থেকে আহসান মঞ্জিলকে দৃশ্যমান করতে হলে এসবের অনেক কিছুই অপসারণ করতে হবে।
সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালের মূল ভবনের উত্তর-পূর্বদিকে, রাস্তার ওপারে লালকুঠি ভবন অবস্থিত। লালকুঠির সামনের বুড়িগঙ্গায় রয়েছে সদরঘাট টার্মিনালের বর্ধিত অংশ। সেখানে বিআইডব্লিউটিএর পার্কিং ইয়ার্ড, যাত্রীদের ৩টি টিকেট কাউন্টার, যাত্রীদের লাউঞ্জ, কয়েকটি পন্টুন, গ্যাংওয়ে, স্পাড প্রভৃতি রয়েছে। সেখান থেকে চাঁদপুর, ইলিশা, বরিশাল (ডে-সার্ভিস) ও শরীয়তপুর রুটের যাত্রীবাহী লঞ্চ ছেড়ে যায়। এছাড়া বিআইডব্লিউটিসির খুলনাগামী স্টিমারও ছাড়ে লালকুঠি ঘাট থেকে। অন্যদিকে লালকুঠি ভবনের আশপাশে পেঁয়াজ, আদা-রসুনসহ বিভিন্ন পণ্যের পাইকারি আড়ত দেখা গেছে। এরও কিছুটা পূর্বে শ্যামবাজারের দিকে রূপলাল হাউজের অবস্থান। সেখানে বিআইডব্লিউটিএর কোনো স্থাপনা দেখা না গেলেও কয়েকটি পণ্য ওঠানামার ঘাট ও খেয়াঘাট রয়েছে। অসংখ্য ট্রাক, ভ্যান, রিকশা, ঠেলাগাড়ি আর ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড়ে ঐতিহাসিক এই ভবনটি খুঁজে পাওয়াই এখানে মুশকিল।
ডিএসসিসি সূত্র জানায়, নগরীর এই তিন স্থাপনার সৌন্দর্য, ইতিহাস ও ঐহিত্য সংরক্ষণে সিটি করপোরেশন বিশদ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। শিগগিরই এর আশপাশের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হবে। সেখানে ভূমি ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন করে জনগণের চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা তৈরি করা হবে।
অন্যদিকে নদীর তীরে বিআইডব্লিউটিএ প্রায় একই ধরনের কয়েকটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল বিভিন্ন সময়ে। ২০১৮ সালে সংস্থাটি ঢাকার চারপাশের বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালুর তীর রক্ষায় ওয়াকওয়ে নির্মাণ প্রকল্পের ২ ফেইজ বাস্তবায়ন শুরু করে। দখলদার উচ্ছেদের পর সংস্থাটি সেখানে সড়ক নির্মাণও শুরু করে। তবে সড়ক নির্মাণ বিআইডব্লিউটিএর কাজ নয় বলে এ নিয়ে আপত্তি জানায় ডিএসসিসি। এতে প্রকল্পের কয়েকটি স্থানে সংশোধন আনতে হয় বিআইডব্লিউটিএকে। একই সঙ্গে সদরঘাট থেকে বাবুবাজার পর্যন্ত বিনা স্নানঘাট, আহসান মঞ্জিলসহ ১ কিলোমিটার এলাকার উন্নয়নে একটি প্রকল্প ডিজাইন করেও সেখান থেকে সরে আসতে হয় তাদের। নদী তীরে এম্ফিথিয়েটার, বসার বেঞ্চ, সবুজায়নসহ বিভিন্ন সুবিধা তৈরির করতে চাওয়া হয়েছিল প্রস্তাবিত ওই প্রকল্পে।
বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেলের সৌন্দর্যবর্ধনে কামরাঙ্গীরচর এলাকায় একটি প্রকল্প ডিজাইন করেছিল বিআইডব্লিউটিএ। তবে পরিবেশবাদী কয়েকটি সংগঠন ও ডিএসসিসির আপত্তির কারণে সেটিও আর এগোয়নি। ফলে আদি বুড়িগঙ্গা চ্যানেল উদ্ধারের কাজে আর কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। আদি চ্যানেলের ৭৪টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের নামে গত ১৫ জুন মাত্র কয়েক ঘণ্টার উচ্ছেদ অভিযান চালাতে দেখা যায় ঢাকা জেলা প্রশাসন ও বিআইডব্লিউটিএকে। তখন কামরাঙ্গীরচরের লোহারপুল এলাকা থেকে ব্যাটারি ঘাট পর্যন্ত ১০টি ছোটখাটো স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। এরপর সেখানে সীমানা পিলার স্থাপন করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রতিনিধিরা। এরপর আর উচ্ছেদ কার্যক্রম দেখা যায়নি। শ্যামপুরে নদীর তীরে উচ্ছেদ করা জমিতে বিআইডব্লিউটিএর ইকোপার্ক নির্মাণ নিয়েও আপত্তি রয়েছে ডিএসসিসির।
এসব প্রসঙ্গে মেয়র ফজলে নূর তাপসের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে ডিএসসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাছের বলেন, বিআইডব্লিউটিএর কিছু স্থাপনার কারণে ঐতিহ্যবাহী আহসান মঞ্জিল, লালকুঠি ও রূপলাল হাউসের সৌন্দর্য নদী থেকে দেখা যায় না। উন্নয়নের নামে এমনটি করা ঠিক হয়নি। তাই আমরা সদরঘাট টার্মিনালের কিছু অংশসহ দৃষ্টিতে বাধাসৃষ্টিকারী স্থাপনাগুলো অপসারণ করতে বলেছি। যাত্রী সুবিধার জন্য বিআইডব্লিউটিএকে বিকল্প পথ খুঁজতেই হবে। কারণ বর্তমান মেয়র মহোদয় ঢাকার ঐতিহাসিক নিদর্শন সংরক্ষণের পাশাপাশি নান্দনিকতাকেও বেশ গুরুত্ব দিচ্ছেন।
অন্যদিকে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেক বলেন, আমাদের সব স্থাপনাই তৈরি করা হয়েছে মূলত যাত্রী পরিবহন ও পণ্য ওঠানামার সুবিধার জন্য। আইন অনুযায়ী ঘোষিত নদীবন্দরের সংরক্ষক বিআইডব্লিউটিএ। ফলে এসব সুবিধা তৈরি করা আমাদের দায়িত্ব। এ বিষয়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশনাও রয়েছে। এখন হঠাৎ করে সেগুলো অপসারণ করা হলে যাত্রী পারাপার ও ব্যবসা-বাণিজ্যে সংকট তৈরি হবে। তিনি বলেন, দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের যাতায়াতের অন্যতম মাধ্যম এই নৌপথ। সে কারণে প্রতি ঈদ ও উৎসবের ছুটিতে সদরঘাটে যাত্রীর চাপ সামলামে হিমশিম অবস্থা হয়। টার্মিনাল এলাকা সম্প্রসারণ করে আগের চেয়ে যাতায়াত অনেক সহজ করা সম্ভব হয়েছে। ঐতিহ্য সংরক্ষণে সিটি করপোরেশনের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান বলেন, কীভাবে করলে দুই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নই সহজ হয়- এখন সেটা ভাবতে হবে। তিনি জানান, এজন্য ঢাকা নদীবন্দরের কর্মকর্তার নেতৃত্বে একটি কমিটি করা হয়েছে। তারা ডিএসসিসির সঙ্গে কথা বলে বিষয়গুলোর সমাধান করবেন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়