তিতাস গ্যাস কর্মচারী ইউনিয়ন : পূর্ণ প্যানেলে জয়ী কাজিম-আয়েজ পরিষদ

আগের সংবাদ

যুদ্ধাপরাধ বিচারে স্থবিরতা ; বাকি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এগিয়ে নিতে সরকারের আগ্রহ নিয়ে সংশয়! ট্রাইব্যুনালেও জনবল সংকট

পরের সংবাদ

দুর্গাপূজা ও নারী জাগরণ

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৩, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ১৩, ২০২১ , ১:০১ পূর্বাহ্ণ

‘কোনো জাতির প্রগতির শ্রেষ্ঠ মাপকাঠি হচ্ছে নারীর প্রতি তার মনোভাব’- সমাজ ও প্রগতি সম্পর্কে বিশ্ববিশ্রæত স্বামী বিবেকানন্দের এ উপলব্ধি-প্রসূত উক্তি বর্তমান বিশ্বের চিন্তাশীল ব্যক্তিগণের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচিত ও গৃহীত হয়। নারীর প্রতি কি দৃষ্টিভঙ্গি হওয়া উচিত?- এ প্রসঙ্গে স্বামীজী বলছেন, ‘স্ত্রী-পুরুষ-ভেদ মন থেকে মুছে ফেলে যতদিন না মানবিকতার সাধারণ ভিত্তি-ভূমিতে পরস্পর মেলামেশা করতে পারছ, ততদিন তোমাদের নারী-সমাজের যথার্থ উন্নতি হবে না’। যে কোনো সমাজের সার্বিক উন্নয়নের জন্য নারীর অংশগ্রহণ ও নারী-উন্নয়ন অত্যাবশ্যক- এটা বর্তমান চিন্তাশীল ব্যক্তি মাত্রেরই স্বীকার করে থাকেন। স্বামীজীর উল্লিখিত মানবিকতার ভূমিতে বিচরণ করতেও মানবীয় মূল্যবোধের যথেষ্ট উৎকর্ষ প্রয়োজন, এটা অনস্বীকার্য; এবং এজন্য অত্যাবশ্যক নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা।
স্বামী বিবেকানন্দের প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সমাজ-দর্শন থেকে জানা যায়, পাশ্চাত্যে নারিত্বের ভাবটি কেন্দ্রীভূত জায়ারূপে, প্রাচ্যের সাধারণ মানুষের কাছে- নারিত্বের সমগ্র শক্তি ঘনীভূত মাতৃত্বে। পাশ্চাত্যে স্ত্রীই গৃহকর্ত্রী, প্রাচ্যগৃহকর্ত্রী জননী। প্রাচ্যে জননীই আদর্শ নারী, মাতৃভাবই এর প্রথম ও শেষ কথা।
সনাতন শাস্ত্র বলছেন, সব নারীই ভগবতীর বিগ্রহ। ‘নারী’ শব্দ সনাতন জীবন-সংস্কৃতিতে মাতৃত্বকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা ঈশ্বরকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করে করে থাকেন এবং মাতৃরূপে পূজা করে থাকেন। শ্রীশ্রী দুর্গাপূজা ঈশ্বরের মাতৃভাব ও মাতৃরূপের উপাসনা। দুর্গাপূজায় দুর্গাপ্রতিমা ও নবপত্রিকা-প্রতিমায় ঈশ্বরীয় মাতৃভাব ও মাতৃরূপই প্রতিফলিত হয়। ‘নারীর প্রতি মাতৃদৃষ্টি ও নারীর মাতৃভাব’ স্বামী বিবেকানন্দের প্রত্যাশিত ‘নারী-পুরুষ’ সমদৃষ্টির সঙ্গে আপাতদৃষ্টিতে যেন সঙ্গতিপূর্ণ নয়, এরূপ মনে হয়। কিন্তু একটু গভীরভাবে বিবেচনা করলে দেখব, উক্ত ‘মাতৃদৃষ্টি ও মাতৃভাব’ সমাজে নারীর মর্যাদা ও সম্মান অক্ষুণ্ন রেখে নারীর উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে এবং নারী নির্যাতন ও নারীর প্রতি ব্যভিচার নামক ভয়াবহ সামাজিক রোগ থেকে সমাজকে রক্ষা করতে পারে। একই লক্ষ্যে (নারীর উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা) পৌঁছার ক্ষেত্রে ‘নারীর মাতৃভাব ও নারীর প্রতি মাতৃদৃষ্টি’ এবং ‘নারী-পুরুষ’ সমদৃষ্টি পরস্পরের পরিপূরক বললে অসঙ্গত হবে না।
পূজার অঙ্গ হিসেবে ‘দুর্গাপ্রতিমা’ কেবল ‘নারীর প্রতি মাতৃদৃষ্টি ও নারীর মাতৃভাব’ প্রকাশ করে তা নয়, নারীর শক্তি-সামর্থ্যরে ব্যাপারও আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। মাতৃপ্রতিমা একদিকে যেমন নারীর পবিত্রতা, দয়া, সহিষ্ণুতা, ভালোবাসা, ক্ষমা ইত্যাদি ভাবের প্রতিমূর্তি; তেমনি অন্যায়-অবিচারসহ জীবনের যে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায়ও নারী প্রস্তুত, প্রতিমায় দৃষ্ট দেবী ও অসুরের যুদ্ধ যেন সেই ভাবেরই প্রতিভূ। ‘ভগবতীই সর্বজীবে বুদ্ধিরূপে, শক্তিরূপে, কান্তিরূপে, বৃত্তিরূপে ইত্যাদি বিভিন্ন রূপে অবস্থিতা ও প্রকাশিতা’ -দুর্গাপূজার এ শাস্ত্রীয়-দর্শন ভাবনা নারীর শরীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিকসহ সার্বিক ব্যক্তিত্ব বিকাশে এবং নারীকে সমাজে যোগ্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে গড়ে তুলতে প্রেরণা জোগায়।
দুর্গাপূজা-প্রক্রিয়ার অন্তর্নিহিত তাৎপর্যের দিকে দৃষ্টি দিলে স্বামী বিবেকানন্দের নারী-পুরুষ সমদৃষ্টির ভাবটি আমরা প্রত্যক্ষ করে থাকি। ধূপ-দীপ-ফুল-ফল নৈবেদ্যাদি দিয়ে পূজা স্থ’ূল ব্যাপার, এর পশ্চাতে রয়েছে পৌরাণিক আখ্যান ও সূ² দর্শন। ষষ্ঠীর কল্পারম্ভ ও বোধন থেকে শুরু করে দশমীর বিসর্জন পর্যন্ত ক্রিয়াবহুল এ পূজার প্রতিটি অঙ্গানুষ্ঠান তাৎপর্যমণ্ডিত। পূজার অঙ্গানুষ্ঠান বোধন প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে আসা যাক।
পুরাণে আছে দুষ্ট রাবণ বধ এবং শ্রীরামচন্দ্রকে অনুগৃহীত করার জন্য পুরাকালে ব্রহ্মাদি দেবতারা শরতে দেবীর বোধন করে পূজা করেছিলেন। দেবরাজ ইন্দ্র দেবীদুর্গাকে সংবোধিত করে হারানো স্বর্গরাজ্য ফিরে পেয়েছিলেন। শ্রীরামচন্দ্র যেরূপ রাবণকে নিধন করেছিলেন, অধুনা বিবিধ উপচারে সম্পাদিত বোধন ক্রিয়ায় পূজারীর অভিপ্রায় ও চিন্তন- সেরূপ রাবণরূপী শত্রæদের বধ করা। এরূপ আখ্যান অবলম্বনে পূজার পশ্চাতে কি দর্শন রয়েছে তা ভেবে দেখা যেতে পারে।
শাস্ত্র ও আচার্যগণের উক্তি থেকে জানা যায়, ঈশ্বরই এক ও অভিন্ন চৈতন্যসত্তারূপে সর্বজীবে বিরাজিত। কিন্তু, সাধনার প্রাথমিক স্তরে আমরা নিজেদের চৈতন্যস্বরূপ বোধ না করে নারী-পুরুষ, ছোট-বড়, ধনী-দরিদ্র, স্থূল-কৃশ, এরূপ বোধ করে থাকি। কেন এরূপ হয়ে থাকে? শাস্ত্রীয় দর্শন বলছে, অজ্ঞান উপহিত চৈতন্য থেকে সমগ্র জগত সৃষ্টি। শাস্ত্র ও যুক্তির নিরিখে বলা যেতে পারে, আমাদের চৈতন্যস্বরূপ সত্তার ওপর অজ্ঞান (স্বরূপ সম্পর্কে) এবং এর পরিণাম- দেহবোধের আবরণের জন্য নারী-পুরুষ ইত্যাদি ভেদ-দৃষ্টি হয়ে থাকে। দেহবোধ থেকেই স্বার্থপরতা, মোহ, ঈর্ষা, লোভ, হিংসা ইত্যাদি অশুভভাভের উদ্ভব- এটা বিচারশীল মন নিয়ে চিন্তা করলে বোঝা যায়। শ্রীরামকৃষ্ণের কথায় আছে- মন যেন মাটি মাখানো ছুঁচ, ঈশ্বর চুম্বক পাথর, মাটি না গেলে চুম্বক পাথরের সাথে যোগ হয় না। পূজা-উপাসনায় এবং ঈশ্বরের প্রতি ভালোবাসা, অনুরাগ ও অনুতাপের অশ্রæজলে ছুঁচের মাটি ধুয়ে যায় অর্থাৎ কাম ক্রোধ, লোভ, পাপবুদ্ধি, বিষয়বুদ্ধি দূরীভূত হয়। মাটি ধুয়ে গেলেই ছুঁচকে চুম্বক পাথর টেনে নেয়- অর্থাৎ ঈশ্বর দর্শন হয়। অন্তরে দেহবোধ ও কাম-ক্রোধাদি অশুভভাবরূপী রাবণবিনাশই রামচন্দ্ররূপী পূজারীর প্রয়াস। পৌরাণিক ভাষায় ও রূপক ছলে বলা হয়ে থাকে রাবণ বিনাশে সীতা উদ্ধার কিংবা অসুর বিনাশে দেবরাজ ইন্দ্রের স্বর্গপ্রাপ্তি, এর মানে অন্তরে দেহবোধ লোপ ও চৈতন্যসত্তার উপলব্ধি। সূ²দৃষ্টিতে দেখলে, এরূপ উপলব্ধিতেই নারী-পুরুষে যথার্থ সমদৃষ্টি সম্ভব।
দুর্গাদেবীর মানসপূজায় অনহংকার, অরাগ (অনাসক্তি), অমদ, অমোহ, অদম্ভ, অদ্বেষ…… এরূপ ১৫টি শুভভাবের পুষ্পমেখলা মা-কে নিবেদনরূপ মানসক্রিয়া পুজারীর অন্তরে শুভভাবের উৎকর্ষের প্রয়াস। স্বচ্ছ জলাশয়েই সূর্যের প্রতিবিম্ব স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। শুভভাবের উৎকর্ষে চিত্ত শুদ্ধ হলে সাধকের পক্ষে হৃদয়ে উপাস্য জগজ্জননীর দর্শন অর্থাৎ চৈতন্যস্বরূপ সত্তার উপলব্ধি সম্ভবপর হয়। মানসপূজায় বস্ত্রকে আকাশতত্ত্বরূপে, চন্দনাদি গন্ধদ্রব্য-গন্ধতত্ত্বরূপে, এরূপে সমগ্র সৃষ্টিতত্ত্ব দেবীকে নিবেদন ক্রিয়া পূজারীর দেহবোধ থেকে চৈতন্যবোধে উত্তরণের প্রয়াস। বলি ও হোম প্রক্রিয়াও একই প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়।
মাটির তৈরি উট, পাখি, হাতি, ঘাড়া শিশুর দৃষ্টিতে ভিন্ন ভিন্ন হলেও জ্ঞানীব্যক্তি যেমন উক্ত বৈচিত্র্যসমূহে এক মাটিই দেখেন। জ্ঞানীভক্তও নিজ হৃদয়ে ও ভিন্ন-ভিন্ন নারী-পুরুষে সর্বব্যাপী এক অভিন্ন চৈতন্যই দর্শন করেন যাকে তিনি মাতৃরূপে উপাসনা করেন। উক্ত সমদৃষ্টি বজায় রেখে তিনি যথাযোগ্য ব্যবহার করে থাকেন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের সাথে। কাউকে নির্যাতন কিংবা বঞ্চনা করা, সেজন্য তার পক্ষে অসম্ভব।
স্বামী বিবেকানন্দের উল্লিখিত সমাজ দর্শনের আলোকে বলা যেতে পারে- আমাদের প্রত্যাশিত প্রগতিশীল-সভ্য সমাজে নারীরা পরমুখাপেক্ষী না হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াবে; দেশ ও সমাজের সকল উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখবে ও সাফল্যের অংশীদার হবে; কোনোরূপ বঞ্চনা বা নির্যাতনের শিকার হবে না এবং মর্যাদার সাথে সমাজে অবস্থান করবে। তথ্য ও উপাত্ত দিয়ে আমরা হয়তো নারীদের শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের কিছুটা অগ্রগতি দেখাতে সমর্থ হবো, সন্দেহ নেই। সমাজে নারী বঞ্চনা ও নিগ্রহের খবর যখন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়, তখন সে সমাজের প্রগতির সূচক যে খুব একটা বেশি, তা বলা যাবে না। এ সূচক বৃদ্ধিতে ও নারী সমাজের উন্নয়নকল্পে নারী-পুরুষ সমদৃষ্টি অপরিহার্য-এটা বলা বাহুল্য।
আমাদের প্রাচ্য জীবন-সংস্কৃতিতে ধর্মের স্পষ্ট প্রভাব লক্ষণীয়। ধর্মকে কেন্দ্র করেই যেন দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালিত হয়। আমাদের প্রত্যাশিত সমাজ বিনির্মাণ ও এর অগ্রযাত্রায় চিন্তাশীল ব্যক্তিগণের সমাজভাবনার পাশাপাশি অধ্যাত্ম বিষয়ের তাৎপর্য ও আদর্শের ভাবনা এবং পরিবার ও সমাজ জীবনে উক্ত আদর্শের চর্চ্চা গুরুত্বপূর্ণ। দুর্গাপূজার অন্তর্নিহিত ভাবাদর্শ নারী-উন্নয়ন ও নারীর প্রতি যথার্থ মনোভাব পোষণেরই প্রেরণা প্রদান করে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়