তিতাস গ্যাস কর্মচারী ইউনিয়ন : পূর্ণ প্যানেলে জয়ী কাজিম-আয়েজ পরিষদ

আগের সংবাদ

যুদ্ধাপরাধ বিচারে স্থবিরতা ; বাকি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এগিয়ে নিতে সরকারের আগ্রহ নিয়ে সংশয়! ট্রাইব্যুনালেও জনবল সংকট

পরের সংবাদ

দুর্গাপূজার আহ্বান

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৩, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ১৩, ২০২১ , ১২:৫৮ পূর্বাহ্ণ

দুর্গাপূজা হিন্দুদের প্রধান উৎসব। হাজার হাজার বছর ধরে পৃথিবীর মানুষ শক্তিপূজা করে চলেছে। হরপ্পা, মহেঞ্জোদারোর প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে বর্তমান যুগ পর্যন্ত এর প্রভাব সুস্পষ্ট। সভ্যতার সূচনায় যে অগ্নি ছিল মূল আরাধ্য সেই অগ্নিই দেবীদুর্গা। বিভিন্ন শাস্ত্রে দেবীদুর্গাকে অগ্নির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। পৃথিবীতে হিন্দুরাই ঈশ্বরের নারী রূপের সর্বপ্রাচীন পূজাকারী। সমস্ত নারীর প্রতীকও দেবীদুর্গা। হিন্দুরা শুধু নারীকে শ্রদ্ধাই করে না বরং ঈশ্বরের শক্তিরূপ দেবীদুর্গাকে ভগবতী রূপে পূজা করে। দেবীদুর্গা সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের শক্তির প্রকাশ বা প্রতিরূপ। মা কালীসহ সকল দেবমূর্তিই সেই এক পরমব্রহ্মের শক্তির প্রতীকী প্রকাশ।
শক্তির সৃষ্টি বা ধ্বংস নেই। এ কথা বিজ্ঞান বলছে। তাহলে সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা কি শক্তি সৃষ্টি করতে পারেন? কেউ কেউ বলবেন, তিনি ইচ্ছাশক্তিতেই সব সৃষ্টি করতে পারেন। বিজ্ঞান বলে, শূন্য থেকে পূর্ণ সৃষ্টি হতে পারে না। বেদ বলে, ‘ওঁ পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে। পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে\’ (ঈশোপনিষদ) অর্থাৎ ‘পরব্রহ্ম পূর্ণ, নামরূপ ব্রহ্মও পূর্ণ; পূর্ণ থেকে পূর্ণ উদ্গত হন; পূর্ণের পূর্ণত্ব বিদ্যাসহায়ে গ্রহণ করলে পূর্ণই (পরব্রহ্মই) অবশিষ্ট থাকেন।’ এক পূর্ণ ব্রহ্ম থেকেই পূর্ণ বিশ্বজগৎ সৃষ্টি। শক্তি অবিনাশী। তবে তার রূপান্তর সম্ভব। অর্থাৎ সর্বশক্তিমান নিজেকেই মহাবিশ্বের সকল শক্তি ও পদার্থ রূপে বিস্তৃত করেছেন। বেদের ভাষায় ‘একোহং বহুস্যাম্’। তাই তিনি সর্বত্রই বিরাজিত। আধুনিক বিজ্ঞান বলছে শক্তি ও পদার্থ মূলত অভিন্ন। অর্থাৎ শিব ও শক্তি (দুর্গা) বা পুরুষ ও প্রকৃতি মূলত এক। ‘বাসুদেব সর্বমিতি’-গীতা।
যুগের পরিক্রমায় শক্তিময়ী দেবীদুর্গাকে আজ আমরা ঘরের মেয়ে বলে মনে করি। ভিখারি স্বামীর ঘরে কন্যার দুঃখের জীবন। অন্তত কয়েকদিন বাপের বাড়িতে এসে ঘুরে যাক মেয়েটা! সেই কন্যাপ্রেম থেকেই উমাকে বাপের বাড়িতে করা হয় আবাহন। পুত্র-কন্যাসহ ঘরের মেয়ে দুর্গা আসেন আমাদের গৃহে। সারা বছরের প্রতীক্ষা শেষে শরতের স্নিগ্ধতা নিয়ে ঘটে কন্যার বাবার বাড়িতে আগমন। মা এলে আমাদের আর আনন্দের সীমা থাকে না। কয়েকদিন আমাদের উৎসবে, আনন্দে ভাসিয়ে আবার বিদায় নেন।
আসলে কি মা দুর্গা আসেন? যিনি ঈশ্বর তিনি তো সবসময়ই সর্বত্র বিরাজিত! তার আবার আসা কিংবা যাওয়ার কী প্রয়োজন? তার থেকেই এই জগতের উৎপত্তি। তারই তো সব, তিনিই তো সব। তবুও ঈশ্বরকে নিয়ে ভক্তদের কতই না বিচিত্র চিন্তন!
আমরা ভগবানকে ঘরের মানুষ, আপন মানুষ মনে করে তাকে খাওয়াই-পরাই! যিনি আমাদের খাওয়ান-পরান তাকেই আমরা খাওয়ানো-পরানোর দুঃসাহস দেখাই! এটাই ভক্তি। তাকে আমরা আবাহন করি, আবার বিজয়া দশমীতে বিদায় দিই! ঈশ্বরকে নিয়ে এমন দুঃসাহস দেখানোর ভক্তির সামর্থ্য একমাত্র হিন্দুদেরই আছে। হ্যাঁ এটাই হিন্দুধর্ম! এটাই সনাতন সংস্কৃতি। আমরা কেবল ভালোবাসায় বিশ্বাস করি, হিংসায় নয়। আমরা কেবল সৃষ্টিতে বিশ্বাস করি, ধ্বংসে নয়। আর এটাই প্রকৃত সনাতন হিন্দুধর্ম।
দুর্গাপূজাকে মহাপূজা বলা হয়। দুর্গাপূজাকে অশ্বমেধ যজ্ঞের সঙ্গে তুলনা করা হয়। দুর্গাপূজায় সকল দেবতার পূজা করা হয়ে থাকে। গণেশ, কার্তিক, ল²ী, সরস্বতী, শিব, বিষ্ণু, সূর্যাদি দেবতা অর্থাৎ ঈশ্বরের সমস্ত বিভূতির অর্চনা করা হয়ে থাকে। বিভিন্ন মানবেতর প্রাণী (সিংহ, সর্প, ময়ূর, ইঁদুর, পেঁচা, হংস ইত্যাদি) এবং উদ্ভিদকে (নবপত্রিকা অর্থাৎ ৯ প্রকার উদ্ভিদসহ বিভিন্ন উদ্ভিদ) শ্রদ্ধা জানানোর মাধ্যমেও ভগবানের অর্চনা করা হয়ে থাকে। এভাবেই দুর্গাপূজা হয়ে ওঠে অনন্য বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত মহোৎসব। পৃথিবীর সমস্ত জীবকে কৃতজ্ঞতা ও সম্মান জানানোর এমন উৎসব শুধু হিন্দুরাই করে থাকে। বিশ্বমাতৃকা এবং দেশমাতৃকার রূপই দেবীদুর্গার রূপ। ঈশ্বরই প্রকৃতি অর্থাৎ গর্ভধারণকারী মাতা আবার ঈশ্বরই বীজ বপনকারী পিতা। ঈশ্বরই সমস্ত কিছুর উৎস। -গীতা
দুর্গাপূজা তথা শক্তিপূজাকেন্দ্রিক উৎসবের বর্তমানের এইরূপের প্রচলন করেছিলেন বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার তাহিরপুরের রাজা কংসনারায়ণ। আজ সেই দুর্গাপূজাই বাঙালি হিন্দুর প্রাণের উৎসব, প্রধান উৎসব। বাঙালি হিন্দুর সমাজ জীবনের কেন্দ্রবিন্দু দুর্গোৎসবের চার দিনের এই আনন্দ যজ্ঞ।
দুর্গাপূজার একটি বিরাট বৈশিষ্ট্য হলো সকল সম্প্রদায়ের মানুষের অংশগ্রহণ। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্রের মহামিলনের নাম দুর্গোৎসব। সর্বজনীন দুর্গাপূজায় কোনো ভেদাভেদ নেই। একই মন্দিরে পাশাপাশি বসে সবাই মাতৃবন্দনায় মেতে ওঠে, ঈশ্বর আরাধনায় ব্যস্ত থাকে। ধনী-গরিব, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার অংশগ্রহণে দুর্গোৎসব রূপ নেয় মহামিলন মেলায়।
দুর্গাপূজার আহ্বান : বর্তমানে অনেক স্থানে পূজার নামে করা অসভ্যতাগুলো অত্যন্ত দুঃখজনক। যা সর্বশ্রেষ্ঠ সনাতন ধর্মের ভাবমূর্তিকে নষ্ট করছে। তাই এই উৎসব পালনে আমাদের আরো যতœশীল ও সচেতন হওয়া প্রয়োজন। আপনি শুধু আপনার এলাকারই অভিভাবক নন, বরং হিন্দু জাতি ও সনাতন ধর্মের একজন সুযোগ্য নেতা ও দায়িত্বশীল প্রতিনিধি। তাই আপনার দায়িত্বও অত্যন্ত মহান। আপনার কাছে আমরা বিনীতভাবে কিছু আহ্বান নিবেদন করতে চাই।
ক্স সকল অবৈদিক ও তামসিক অপসংস্কৃতি পরিহার করে সাত্ত্বিক পূজার আয়োজন করুন। অযথা ব্যয় কমিয়ে গরিব শিক্ষার্থীকে শিক্ষাবৃত্তি প্রদান করুন। এলাকার অভাবগ্রস্তদের সহায়তা করুন, তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিন। পূজার বাজেট থেকে বাজে খরচটুকু বাদ দিয়ে সেই টাকাটা পাড়ার/গ্রামের সবচেয়ে গরিব হিন্দুকে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বনের জন্য বিনাসুদে ঋণ প্রদান করুন, যা তিনি সহজশর্তে কিস্তিতে পুনরায় পূজা কমিটিকে ফেরত দেবেন। পরের বছর আবার কাউকে ঋণ দিন। এভাবে উত্তরোত্তর ঋণ তহবিল বৃদ্ধি পাবে। সেইসঙ্গে দারিদ্র্যমুক্ত হিন্দু সমাজও গঠিত হবে।
ক্স প্রতি বছর মন্দির উন্নয়নে কিছু কিছু ব্যয় করুন। মন্দিরের সুরক্ষিত স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ করুন। দুর্বৃত্তরা যেন প্রতিমা ভাঙচুর করতে না পারে সে লক্ষ্যে সুরক্ষা প্রাচীর অগ্রাধিকারভিত্তিতে অবশ্যই নির্মাণ করবেন। মন্দির সংস্কার ও উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে অনেকগুলো প্রণামি বাক্স তৈরি করে বিভিন্ন নিরাপদ স্থানে রাখতে পারেন, যাতে সকলে সহজেই নিয়মিত দান করতে পারেন।
ক্স ধর্মীয় চেতনার উন্মেষ ঘটে এমন কার্যক্রম হাতে নিন। পবিত্র বেদ, উপনিষদ, গীতা, চণ্ডীসহ বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থাদি বিতরণ করুন।
ক্স একমাত্র শাস্ত্রানুমোদিত সাত্ত্বিক পূজার মাধ্যমে জগন্মাতার কৃপা প্রার্থনা করুন। পূজায় ধর্মীয় ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করুন। পূজার মাহাত্ম্য ও সনাতন ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করুন। ধর্মীয় কুইজ প্রতিযোগিতা ও গীতা বা চণ্ডীপাঠ প্রতিযোগিতার আয়োজন করুন।
ক্স দেবী দুর্গা স্বয়ং সমস্ত দেবতার সম্মিলিত শক্তিরূপা। দুর্গাপূজা মানেই সংঘশক্তির পূজা। সংঘশক্তি ছাড়া বিজয়, সাফল্য, সমৃদ্ধি সম্ভব নয়। তাই সংঘচেতনায় সবাইকে উজ্জীবিত করুন। দলাদলি তথা বিভেদ-বিদ্বেষ পরিহার করে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে ঐক্য গড়ে তুলুন। শত্রæভাব ত্যাগ করে সহযোগিতার মনোভাব, অন্তত কোনোপ্রকার ক্ষতি না করার মনোভাব বজায় রাখুন।
ক্স পবিত্র শাস্ত্রের তথা ধ্যানমন্ত্রের বর্ণনানুসারে মায়ের প্রতিমা জগজ্জননী রূপে তৈরি করুন এবং অবশ্যই আধুনিকতার নামে রুচিহীন ও দৃষ্টিকটু প্রতিমা তৈরি করা থেকে বিরত থাকুন। নিজের ধর্ম ও উন্নত সংস্কৃতিকে অন্যদের কাছে হাস্যকর করবেন না।
ক্স অশালীন গান, মাত্রাতিরিক্ত শব্দদূষণ ও ডিজে ব্যবহার বন্ধ করুন। ধর্মীয় সংগীত, ঐতিহ্যবাহী ধুনচিনৃত্য ও ঢাকের ব্যবহারকে উৎসাহিত করুন। সকলকে সনাতন ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিধান করতে উৎসাহিত করুন। পূজার দিনগুলোতে সকলকে অঞ্জলি প্রদানে উৎসাহিত করুন। কোভিড স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রসাদ বিতরণ থেকে শুরু করে যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করুন।
ক্স পূজার তিথিগুলোতে সকল ধরনের মাদকদ্রব্য সেবন থেকে বিরত থাকুন। মায়ের প্রতিমা নিরঞ্জনের সময় আবেগঘন পবিত্র পরিবেশ বজায় রাখুন এবং সর্বপ্রকার অশ্লীলতা দমন করুন।
ক্স এবারের পূজায় সংকল্প করুন, সন্তানদের ধর্মশিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য পাড়ায় গীতা শিক্ষা স্কুল গড়ে তুলবেন।
ক্স আপনার প্রতিবেশী ধর্মান্তরিত কিংবা দেশান্তরিত হলে নিশ্চয়ই আপনার ভালো লাগবে না। প্রত্যেক হিন্দুর সুবিধা-অসুবিধায় পাশে থাকুন। আপনার শত্রæও যেন ধর্মান্তরিত বা দেশান্তরিত না হয়, সেটা আপনার জন্যই সবচেয়ে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। এ বিষয়ে নজর রাখুন। শত্রæর জন্যও মঙ্গল কামনা করুন। মহান সনাতন ধর্ম তো এটাই শেখায়- সর্বে ভবন্তু সুখিনঃ। মাতা দুর্গা আমাদের সহায় হোন। শক্তিপূজার মাধ্যমে আপনার সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল ও উত্তরোত্তর শক্তি বৃদ্ধি কামনা করি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়