তিতাস গ্যাস কর্মচারী ইউনিয়ন : পূর্ণ প্যানেলে জয়ী কাজিম-আয়েজ পরিষদ

আগের সংবাদ

যুদ্ধাপরাধ বিচারে স্থবিরতা ; বাকি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এগিয়ে নিতে সরকারের আগ্রহ নিয়ে সংশয়! ট্রাইব্যুনালেও জনবল সংকট

পরের সংবাদ

করাল কোভিডে বন্দি দুর্গা

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৩, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ১৩, ২০২১ , ১:০১ পূর্বাহ্ণ

সালটা ১৯৭১। কলকাতার ৭০ মাইল পরেই যুদ্ধ চলছে। মুহুর্মুহু মেশিনগান আর গোলাবর্ষণের আওয়াজ। বর্ষা এবার হচ্ছে জমিয়ে। জলকাদামাঠে মুক্তির ‘পোলারা’ নাকানি-চোবানি খাওয়াচ্ছে পাক পাঞ্জাবিদের। বর্ডার ক্রস করে যাচ্ছে আর বিশালদেহী পাঞ্জাবিদের ডেরায় বোমা ফেলে ভ্যানিশ হয়ে যাচ্ছে মুহূর্তেই। ফিরে আসছে এপারে রসদ আর গোলাবারুদের জন্য। বর্ডারজুড়ে শুধু সারি সারি ক্যাম্প। রিফিউজিরা এখানে অপেক্ষায় যুদ্ধ থামার। ভলান্টিয়াররা ব্লিচিং ছড়াচ্ছে প্রতিদিন, ক্লোরিন মেশানো পানির ব্যবস্থা করছে, খিচুড়ি বণ্টন করে চলেছে তুমুল উৎসাহে। সে এক মানবেতর জীবন। ক্যাম্পে কোনো ধর্ম নেই। হিন্দু সমবয়সির গায়ে পা তুলে ঘুমোচ্ছে মুসলমান বালক। জড়াজড়ি করে শুয়ে আছে হরিপ্রিয়া দাসী ও সালমা খাতুন। কেউ স্বামী হারিয়েছেন, কেউ পুত্র আবার কেউ বা সব। ততদিনে মুজিবনগর সরকার তৈরি হয়ে গেছে, অ্যালেন গিনসবার্গ সেপ্টেম্বর ইন যশোর রোড লিখছেন, ইন্দিরা গান্ধী দেশে দেশে ঘুরছেন পাক রিরংসার বিরুদ্ধে জনমত গঠন করতে, শেখ মুজিব অন্তরীণ তার খোঁজ কেউ জানে না। এর মধ্যে আসছে দুর্গাপূজা। খবর এসেছে ঢাকা কালীবাড়ি, রমনা কালীবাড়িসহ সব হিন্দু ধর্মীয় আঙ্গিনা পাক হানাদারেরা ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। মা দুর্গার বরণ হবে না ওপার বাংলায়। সেবারে অর্থাৎ একাত্তরের সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে পূজা। বর্ষা পুরোপুরি যায়নি। তার মধ্যে পূজা এলো। মা দুর্গা সপরিবারে এলেন মণ্ডপে। নাহ, কোনো রোশনাই নেই, নেই আলোকসজ্জা, নেই ভোগ খাওয়ানোর ধূম। দানবাক্স আছে। যে যা পারেন, দান করুন। আপনার দান ত্রাণ হয়ে যাবে ওপারে, মুক্তিযুদ্ধে। মানুষ এলেন, দান করলেন সোৎসাহে। মুক্তি চাই, মুক্তি চাই। বাংলাদেশ চাই। শেখ মুজিবের মুক্তি চাই। দেবী দুর্গা বন্দি হলেন পশ্চিম ও পূর্বের যুদ্ধে।
এ ছিল শুধু একাত্তরের কাহিনী। তারপর থেকে দেবী দুর্গার পূজা ক্রমে ক্রমে পরিণত হলো কার্নিভালে। বিজ্ঞাপন ও বিপণনের রমরমার সাথে দুর্গাপূজা পরিণত হলো শারদীয়া দুর্গোৎসবে। মুছে গেল ধর্মের ব্যবধান। কি দু¹ি দেখলাম চাচা গানকে বিদায় জানিয়ে উস্তাদ রশীদ খানের কণ্ঠে ‘আজি শঙ্খে শঙ্খে মঙ্গল গাও জননী এসেছে দ্বারে’ সঙ্গীতে আবাহন হলো দেবী দুর্গার। সে এক অদ্ভুত সুখের সময়। কিন্তু শাস্ত্রে আছে ‘চক্রবৎ পরিবর্তন্তে দুঃখানি চ সুখানি চ’। কালচক্রের আবর্তনে সুখ দুঃখ দুই পরস্পরবিরোধী পরিস্থিতি অন্তরাল থেকে প্রভাবান্বিত করে চলে আমাদের জীবন চলার পথ… আজ বড় যন্ত্রণার সময়… করাল করোনা এলো গত বছর। ছিনিয়ে নিল একগুচ্ছ প্রাণ।
গত বছর শারদোৎসব পরিণত হলো নিছক নিয়মরক্ষার দুর্গাপূজায়। উৎসবের আশ্চর্য গন্ধ যেন অন্তর্হিত হয়ে গেল একলহমায়। দাঁতে দাঁত চেপে কাটল আরেক বছর। এবারেও শরৎ এলো। আকাশ আঁকল পূজার ক্যানভাস। এই আবেশের ক্যানভাসে শরতের তুলো-মেঘ থাকে, বাতাসে জ্বরতপ্ত সুখের মতো শিরশিরানি থাকে, বোনাসের প্রতীক্ষা থাকে, কাচের শোকেসের এ-পারে অপার আগ্রহ থাকে ও-পারের প্রতি। কিন্তু তারই সঙ্গে যোগ হয় কুমোরটুলির কাদামাখা বাঙালি ব্যস্ততা, পাড়ার মোড়ে বাঁশের কাঠামোর আনন্দ আশ্বাস, মধ্যবিত্ত মার্কেটে উপচে পড়া ভিড়। একদিন ভোরবেলায় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের সুগম্ভীর আহ্বান মহাকাশের অতল থেকে ভেসে আসবে, সেই অপেক্ষায় সুটকেস গোছাতে থাকেন উমারাও। তাদের সন্তানরা অপেক্ষায় থাকে স্কুলের দরজায় তালা পড়ার। সাবেক বাড়ির একলা কার্নিশ অথবা দিগন্ত বিস্তৃত টইটই প্রান্তর কৈশোরের দিকে দুহাত বাড়িয়ে দেয় প্রবল অথবা প্রচ্ছন্ন উচ্ছ¡াসে। কিন্তু চোখে কেন লাগছে নাকো নেশা? স্কুলের দরজায় তালা পড়েছে সেই কবে। এখন কেবল খোলার জন্য হা-পিত্যেশ। পলেস্তারা খসা কড়িবরগায় বহু মাসের ঝুল। না ঘোরা পাখায় বাসা বেঁধেছে পাখি। ক্লাস পালানো ছেলেমেয়ের প্রিয় বারান্দায় খেলে বেড়াচ্ছে শূন্যতার হাহাকার। মাঠের ঘাস লম্বা হয়ে ঢেকে ফেলেছে খেলাধুলো। ‘ছুটি’ থেকে ছুটি চাইছে শিক্ষাঙ্গন। দেড় বছর আগে ব্ল্যাকবোর্ডে করা শেষ অঙ্কটা এখন কেবল ধূসর কয়েকটি সংখ্যায় এসে ঠেকেছে। সেই অনড়, জং ধরা অসুখ-সংখ্যার যেন শেষ নেই।
দুবছর আগেও পূজা আমাদের কাছে ‘শারদোৎসব’ ছিল। পুরাণ, প্রতিমা ছাপিয়ে ‘উৎসব’ যখন সবার হয়ে যায়, তখন তাতে কেবল আনন্দের চর্চা হয়, অন্য কিছু নয়। আবার আমাদের শ্রেষ্ঠ আনন্দ-সময় গৃহের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। আমাদের উঠোনে তার স্থিতি মাত্র দিন-চারেকের। কিন্তু তার পথ চেয়ে থাকার সময়টা অনেকখানি। ক্যালেন্ডারে ‘কুড়ি’ এ বার ‘একুশ’ হয়েছে। বাকি আর কিছু বিরাট আঙ্গিকে বদলায়নি। যুক্তি দেখানো যেতেই পারে, শরীরে বিঁধে যাওয়া দুই প্রতিষেধকের, খানিক নেমে যাওয়া গ্রাফ-চিত্রের। প্রতিযুক্তি মনে করিয়ে দেবে দ্বিতীয় তরঙ্গের বিভীষিকার কথা। অক্সিজেন সিলিন্ডার তখন বেহুলার শেষ ভেলা। ভাসতে না পেরে ভেসে গিয়েছে লাখ লাখ সংসার। আনন্দের উদ্যাপন বল্গাহীন হলে অসুখ কী ভাবে তার শোধ নেয়, আমরা দেখেছি। চিকিৎসকরা একমত হয়ে বারংবার বলেন, ‘সেরা প্রতিষেধক হলো মুখাবরণী’। শুধু নাক আর মুখটুকু ঢেকে রাখতে হবে। তাতেই জীবাণুর জীবননাশের ক্ষমতা অর্ধেকের চেয়ে বেশি কমে যায়। আমরা কি সেই আপ্তবাক্য স্মরণে রাখি? গত বারে ‘পূজার বাজার’-এর যতগুলো ছবি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে, আর একবার অ্যালবামটি খুলে দেখা যেতে পারে। নতুন জামার এ-ধারে, ও-ধারে কত জন মানুষের মুখে মাস্ক ছিল? কোভিড-সচেতনতা কেবল পোস্টার হয়ে দেয়ালে ঝুলেছিল বহু বাজারে। মাস্ক ছিল ক্রেতা বা বিক্রেতার পকেটে কিংবা থুতনিতে। সেই প্রবণতা এখনো পথঘাটে সর্বত্র। প্রতিষেধককে মানুষ প্রতারকের পর্যায়ে এনে ফেলছেন কোভিড-সতর্কতাকে নস্যাৎ করে দিয়ে। কড়া সরকারি ফরমান যদি গত বারের মতো জারি না হয়, তা হলে মানুষ তার আনন্দকে আগল দেবেন কি? অথচ, এটা আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন।
যে বিপন্নতার হিসাব নেই তা হলো মানুষের জীবিকা হারানো। অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মীরা প্রাণপণে জীবিকা বদল করে নিজেদের বাঁচানোর চেষ্টা করছিলেন। খবরের কাগজ যিনি দিতেন, মাছ-বিক্রেতা হয়ে গেলেন তিনি। আনাজ-ফেরিতে লেগে গেলেন কারখানার মজদুর। সেই জায়গাটা এখন আরো ছোট হয়ে গিয়েছে।
এখন নাভিশ্বাস চটকল, কারখানা, গ্রামে না-কাজ-পাওয়া ছোট দোকানের কর্মীর। এরা সবাই বসেছিলেন শহরের চাকাগুলো নড়ে ওঠার জন্য। আমরা কি জানি, এদের কত জন আত্মহত্যা করেছেন, অনাহারে-অপুষ্টিতে মারা গিয়েছেন, কাদের স্ত্রীরা গৃহসেবিকার বৃত্তি নিলেন? কী হলো যৌনকর্মীদের, তাদের সন্তানদের, যখন স্পর্শের বৃত্তে আর এলেন না খরিদ্দাররা? অতিমারির মোকাবিলা মানে কি জনসংখ্যার দুর্বলতম অংশকে ঘরে বন্দি করে রেখে দেয়া? যে দিন তালা খোলা হবে জীবন অবশিষ্ট থাকবে তো? চাষির খেতে ফসল নেই, দিনমজুরের কাজ নেই, পরিযায়ী শ্রমিকের আয় কমে গিয়েছে। অনেকে কাজ না জোটায় বাড়ি ফিরে এসেছেন। তাই মানুষের কাছে পূজা আসার আনন্দ এ বার একেবারেই ফিকে।
কোনোমতে পেট চলছে সরকারি বিনা পয়সার রেশনে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এই বিষয়টিকেই সামনে তুলে ধরেছেন। গত বছর কোভিড এবং লকডাউনের কারণে এই শিল্পীদের রুজি-রুটি যাতে বন্ধ না হয়, তার জন্য বিভিন্ন পূজা কমিটিকে ৫০ হাজার টাকা করে দেয়ার কথা বলেছিলেন তিনি। এ বছরও তার ব্যত্যয় হয়নি। ফের পূজা কমিটিগুলোকে ৫০ হাজার করে টাকা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। মুখ্যসচিব আরো এক কাঠি এগিয়ে লাইসেন্স ফি বাতিল করে দিয়েছেন এবং বিদ্যুতের খরচ অর্ধেক করে দেয়ার কথা বলেছেন। দুর্গাপূজা যতই উৎসব হোক, তার সঙ্গে পূজা জুড়ে আছে। পূজা কমিটিগুলো শৈল্পিক মণ্ডপ বানিয়ে যতই মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা করুক, তার ভিতরে পূজা হয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের সরকার কি কোনো একটি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে এভাবে করের টাকা দান করতে পারে? আদৌ কি এ কাজ সাংবিধানিক? কে জানে।
দার্জিলিং পাহাড় জুড়ে মহালয়ায় শুরু হওয়া ফুলপাতি উৎসবে শক্তির আরাধনা হয়। সেই জন্য কম উচ্চতার দুর্গা প্রতিমা দেদার বিক্রি হয় শিলিগুড়ির বিধান মার্কেট ও তার আশপাশে। কম উচ্চতার প্রতিমা হলে পাহাড়ে দুর্গাকে নিয়ে যেতে সুবিধে! এবারে সব দুর্গার উচ্চতাই ছোট হয়ে গেছে। কারণ মণ্ডপে ঢুকে দুর্গা প্রতিমা দর্শনে নিষেধ আরোপ করেছে। নিরাপদ দূরত্ব থেকে খালি অঞ্চলে দাঁড়িয়ে প্রতিমা দর্শন করতে হবে। তিন দিক খোলা রাখুন প্রতিমার। কিন্তু থিম পূজার প্রাবল্যে সে কথা মনে রাখেনি পূজা উদ্যোক্তারা। কাজেই আদালতের নির্দেশে দুর্গা বন্দি থিমের মণ্ডপে। কালের করাঘাতে দুর্গা বন্দি কোভিডের নিয়ম বৃত্তে। রিপ ভ্যান উইঙ্কলের গল্প মনে আছে তো? সে যখন ঘুমিয়েছিল, তার দেশ তখন অন্যের উপনিবেশ। যখন সে জেগে উঠল, তখন দেখল তার চেনা জগৎ অনেক বদলে গিয়েছে বটে, কিন্তু সে এখন স্বাধীন দেশের বাসিন্দা। আমরাও চাইছি এই দুঃস্বপ্ন থেকে জেগে উঠি। করাল কোভিডে বন্দি দুর্গাকে মুক্ত করে নতুন করে উৎসবে মাতি। কিন্তু তার আগে পেট ভরে একটু যেন খেতে পাই। তাহলেই দুর্গাকে বলতে পারব দুর্গতিনাশিনী, না হলে বলতেই হবে মা তুমিও…।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়