ঢাকা সেনানিবাসে এনআইডি বিতরণ কার্যক্রম উদ্বোধন

আগের সংবাদ

যশোর বোর্ডের হিসাব থেকে আড়াই কোটি টাকা উত্তোলন : জালিয়াতির অভিযোগ চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে

পরের সংবাদ

পূজার সেকাল-একাল : ‘ধরন বদলেছে, আনন্দটা একই আছে’

প্রকাশিত: অক্টোবর ৯, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ৯, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ছোটবেলা পূজার সময়টা কেটেছে খুলনায়। পরে ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং
কলকাতাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় দুর্গাপূজা উপভোগ করার অভিজ্ঞতা হয়েছে তার। একুশে পদকপ্রাপ্ত আবৃত্তিশিল্পী ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায় পূজার সেকাল-একাল নিয়ে মেলা’র সঙ্গে কথা বলেছেন। শুনেছেন : শাহনাজ জাহান

আমার ছোটবেলা কেটেছে খুলনা শহরে। আমরা থাকতাম ধর্মসভা মন্দিরের কাছে। ঢাকায় যেমন ঢাকেশ্বরী মন্দির বিখ্যাত খুলনায় তেমন ধর্মসভা মন্দির। কয়লাঘাটা কালীবাড়ি, শিববাড়ি, সেনপাড়া, মির্জাপুর শিববাড়ি, শীতলাবাড়ি- এ রকম বেশ কয়েকটা জায়গায় খুব ভালো ভালো পূজা হতো। সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ পূজা ছিল বারোয়ারিদের পূজা। ব্যবসায়ী হওয়ার সুবাদে তাদের পূজার ধরনটাই ছিল আলাদা। তাদের পূজা দেখতে ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে চলে যেতাম। ওরা প্রসাদ দিত প্যাকেট করে। একদম খাঁটি গাওয়া ঘিয়ের তৈরি বুন্দিয়া। যত মানুষ যাবে সে যে ধর্মেরই হোক না কেন গেট থেকে বের হওয়ার সময় সবার হাতে থাকত সেই প্যাকেট। আহ কি স্বাদ ছিল বুন্দিয়ার। আমার বাড়ির পাশে যে ধর্মসভা মন্দির ছিল সেখানে পূজার আগে থেকে প্রায় প্রতিদিনই যেতাম, কারণ মূর্তি তৈরির প্রক্রিয়া আমায় অদ্ভুতভাবে টানত। প্রথমে খড়ের কাঠামো, তারপর কাদামাটির একের পর এক প্রলেপ শেষে অদ্ভুত সুন্দর প্রতিমা হয়ে যেত। প্রতিটা অঙ্গ আলাদা করে বানিয়ে কি নিখুঁত করে জোড়া দিত। তারপর শুকিয়ে এলে রং চাপাত। এই যে একের পর এক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রতিমা তৈরি হতো, সেটা আমার শৈশবের সবচেয়ে ভালো লাগার বিষয় ছিল। কিন্তু বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই আনন্দটা কমে এলো। যখন একটু বুঝতে শিখেছি তখন আনন্দটা অন্যদিকে মোড় নিল। আমরা তিন ভাই ছিলাম। বাবা টেইলারের দোকানে নিয়ে গিয়ে এক রঙের একই ডিজাইনের কাপড় বানিয়ে দিতেন। এখনকার মতো এত কাপড় বা ডিজাইন তখন ছিল না এবং সেটা হতো এক সেট কি দুই সেট। এখনকার ছেলেমেয়েরা তো প্রতি বেলায় জামা পাল্টায়। আমরা ওই এক জামা পেয়েই খুশি ছিলাম। আসলে একটার বেশি জামার চাহিদাও ছিল না। আমাদের কাছে শুধু আনন্দটাই মুখ্য ছিল। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পূজার চারটি দিন সেই আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতাম। পূজার গেটের সামনে বসত মেলা। কামার-কুমোর, তালপাখা, মাটির তৈরি বিভিন্ন খেলনা, মুড়ি-মুড়কির দোকান, পুতুল নাচ, যাত্রাপালা, বাউল গান, জারি-সারি, ভাটিয়ালি গান- কি নেই পূজায়। সবাই আনন্দ নিয়ে মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে বেড়াতাম আর ফেরার পথে মুড়ি-মুড়কি, ছোট ছোট মাটির খেলনা কিনে নিয়ে আসতাম। মায়েরা দা-বঁটিসহ সংসারের সরঞ্জাম কিনে নিয়ে আসত। আর নাগরদোলায় চড়া ছিল অন্যরকম আনন্দের। নাগরদোলায় চড়া মানেই ছিল ভীষণ মজার। পুতুল নাচ দেখার জন্য মুখিয়ে থাকতাম। বাউল গান, যাত্রাপালা- সব মিলিয়ে একটা উৎসবের আমেজ থাকত। মন্দিরে তখন গান হতো। রবীন্দ্রসংগীত, শ্যামাসংগীত, ভাটিয়ালি গান শুনতাম। বিয়ের পর চট্টগ্রামে গিয়ে অন্যরকম অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সেখানে পূজাতে পুঁথি পাঠ হতো। অন্যরকম একটা সুরে পুঁথি পাঠ করা হয়। এটা শুধু চট্টগ্রামের পূজাতেই হয়। আর কোথাও দেখিনি। ১৯৮৭ সাল থেকে প্রতি বছরই আমরা চট্টগ্রামের রাওজানে পূজাতে যাই। কারণ আমাদের একমাত্র মেয়ে সেখানে পূজাতে যাওয়াটা খুবই উপভোগ করে। মাঝে কয়েক বছর কলকাতাতে ছিলাম। সেখানে তখন পূজার আনন্দ উপভোগ করেছি। খুলনার পূজাতে বাড়ি বাড়ি নাড়–সহ নানা রকম নিরামিষ রান্না হতো। দু-একটা বাড়িতে আমিষ মানে মাছ-মাংসও রান্না হতো। বিজয়া দশমীর দিনে আমরা বড়দের প্রণাম করতাম। দশমীর পরদিন খুলনায় আরেকটা বিষয় হতো, সেটা অন্য জায়গায়ও বোধহয় হতো। দশমীর পরদিন এটাকে ‘একাদশী’ বলে। পাড়া-প্রতিবেশীদের বাড়িতে লুচি-তরকারি রান্না করা হতো। এটা খাওয়া-দাওয়ার একটা আনন্দ আয়োজন। সেখানে খাদ্য তালিকায় থাকত সন্দেশ, দই, রসগোল্লা, লুচি-তরকারি, চাটনিসহ অনেক কিছু।
এখন এসে শৈশবের সেই পূজার দিনগুলোর কথা খুুব মনে পড়ে। ইচ্ছা হয় সেই স্কুলজীবনে আবার ফিরে যেতে। ঠিক তেমনি মনে হয়, যদি আবার সেই ছোটবেলার পূজার দিনগুলোতে ফিরতে পারতাম। ঢাকায় তো থাকছি প্রায় ৪৭ বছর হতে চলল। ঢাকায় এখন পূজা দেখি। ঢাকায় বিভিন্ন মন্দিরে যে পূজা হয়, সেখানে কিন্তু বাঙালি যে ব্যাপার সেটা বেশ দেখা যায়। আবার বিভিন্ন জায়গায় সবাই চাঁদা তুলে পূজার আয়োজন করে। সেখানে দেখা যায়, ব্যান্ডের গানসহ নানা আয়োজন। এসব জায়গায় বাঙালির চর্চাটা কম থাকে। বনানীর পূজাতে রবীন্দ্রসংগীত, শ্যামাসংগীত হয়। আবার টাকা খরচ করে পাশ্চাত্য ধাঁচের অনুষ্ঠানও করা হয়। এই পরিবর্তন এখনকার পূজাতে এসেছে, তবে আনন্দটা খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। আগেও সবাই আনন্দ করেছি। এখনো সবাই আনন্দ করে। এই আনন্দ কিন্তু সার্বজনীন। শুধু হিন্দু না সব ধর্মের মানুষের আনন্দে দুর্গাপূজা পালিত হয়। যুগের সঙ্গে চাহিদা পাল্টেছে। সবাই এখন পূজায় তারকা শিল্পীদের পরিবেশনা দেখতে চায়। এজন্য পূজা কমিটির লোকজন পয়সা খরচ করে তারকা শিল্পীদের নিয়ে আসে। আগের মতো পূজার গেটে মেলাও তেমন দেখা যায় না কিন্তু আনন্দটা আগের মতোই আছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়