বিজিএমইএ সভাপতি : বন্ধ মিল চালু হলে ফেব্রিক্সের চাহিদা মেটানো সম্ভব

আগের সংবাদ

খাদ্য নিরাপত্তাই প্রধান চ্যালেঞ্জ : সরকারি হিসাব মতে, দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, তবুও চালসহ খাদ্যপণ্য আমদানি করতে হয়

পরের সংবাদ

সমকালীন বেতাল বিংশতি

প্রকাশিত: অক্টোবর ৮, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ৮, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আয়কর রিটার্ন দাখিলের মৌসুম চলছে। ৩০ নভেম্বর জাতীয় আয়কর দিবসের সময়সীমা সমাপ্ত হবে। গত ১৯ মাস ধরে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো করোনা সংক্রমণ মোকাবিলা করে চলেছে। এমনিতেই স্বাভাবিক অবস্থায়ও আমাদের দেশে ট্যাক্স আদায় করা একটি জটিল সমস্যা। উপরন্তু চলতি অর্থবছরের জন্য যে বাজেট দেয়া হয়েছে তাতে করোনার প্রভাবে রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে আরো সমস্যা মোকাবিলা করতে হবে। আমরা এখনো করোনার অর্থনীতিতেই আছি। গত ১৯ মাসে অর্থনৈতিক সেক্টরে অচলাবস্থা, অনুৎপাদনশীলতা এবং অস্থিতিশীলতার যে পরিস্থিতি তা সরাসরি রাজস্ব আদায়ের ওপর প্রভাব ফেলছে। মানুষের যদি আয় কম হয় তাহলে বেশি পরিমাণে কর দিতে পারবে না। এটা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না যে, করোনার কারণে বেশিরভাগ মানুষের স্বাভাবিক আয়-রোজগার কমে গেছে। আমাদের দেশের আমদানি-রপ্তানি আয় কমে গেছে। আমদানি-রপ্তানি আয় কমে যাওয়ার অর্থই হলো রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ কমে যাওয়া। অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমে গেছে। করোনার কারণে গত বছর রাজস্ব আদায় কমে গেছে, চলতি অর্থবছরেও এর প্রভাব অব্যাহত থাকবে বলেই মনে হচ্ছে। রাজস্ব আদায়ের যেসব খাত এখনো ট্যাক্স নেটওয়ার্কের বাইরে আছে তাদের যদি ট্যাক্স নেটওয়ার্কের মধ্যে নিয়ে আসা যায় তাহলে এই অবস্থা থেকে কিছুটা হলেও উত্তরণ ঘটানো সম্ভব হতে পারে। ব্যক্তি পর্যায়ে এখনো বহু মানুষ কর প্রদান করেন না। দেশ থেকে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ বাইরে পাচার হয়ে যাচ্ছে। যে টাকা দেশের বাইরে পাচার হচ্ছে তার ওপর নির্ধারিত হারে কর প্রদান করা হচ্ছে না। অর্থাৎ কর প্রদান ছাড়াই এসব অর্থ বিদেশে প্রত্যাবাসন কিংবা পাচার করা হচ্ছে। অর্থনীতিতে এখনো বিরাট একটি বৈষম্য বিরাজ করছে। সমাজে বিদ্যমান বৈষম্য কীভাবে দূর করা যায় সে দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। যাদের ওপর কর প্রযোজ্য তাদের কাছ থেকে তা সঠিকভাবে আদায় করার মাধ্যমে অর্থনীতিতে বিদ্যমান বৈষম্য কিছুটা হলেও দূর করা সম্ভব। এটা করা গেলে অর্থনীতিতে কিছুটা হলেও গতিশীলতা সৃষ্টি হতে পারে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কালো টাকার উপস্থিতি সর্বজনবিদিত। কালো টাকার উৎস নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা হবে না এ ধরনের এমনেস্টি দেয়া থাকলে কালো টাকার উৎপত্তি ও উপস্থিতি বাড়বে বই কমবে না। অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনের, আত্মসাতের, দুর্নীতির সুযোগ রেখে দিয়ে কালো টাকা সাদা হবে না। কালো টাকা কালো হয়ে বসে থাকে না, দেশের অর্থনীতিতে বিরাট বৈষম্য সৃষ্টি করে, নীতিনৈতিকতাকে কলুষিত বা বাধাগ্রস্ত করে, ক্ষমতার অপব্যবহারকে অবারিত করে তোলে। চোরকে চুরি করে পালিয়ে যেতে দিয়ে চোর ধরার নাটক শুরু হয়। চোরকে চুরি করতে দিয়ে চোর ধরার সময় ক্ষেপণের মধ্যেই দেশের ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও কম হওয়ার অন্যতম কারণ নিহিত। শর্ত শিথিল করে ট্যাক্স প্রদানের মাধ্যমে কালো টাকা সাদা করার পেছনে যুক্তি দেখানো হয়, এতে কালো টাকা অর্থনীতির মূল স্রোতে চলে আসবে। অথচ কালো টাকা এমনিতেই অর্থনীতিতে আছে। কালো টাকা সাদা করার ক্ষেত্রে শর্ত শিথিলের ফলে দেশের অর্থনীতি নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রথমত, ন্যায্য কর প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হওয়াসহ জবাবদিহিতার বাধ্যবাধকতার অবর্তমানে বৈধ কর দাতারা নিরুৎসাহিত হয়। তাদের দেখাদেখি অন্যরাও কালো টাকা তৈরির জন্য উৎসাহিত হতে পারে। কারণ তাদের মনে একটি ধারণা সৃষ্টি হতে পারে যে, কালো টাকা তৈরি করলেও কিছু হবে না। রাষ্ট্র বা সরকার তাদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে না। বরং তাদের এক সময় কম ট্যাক্সের বিনিময়ে এবং বিনা ব্যাখ্যায় দুর্নীতিজাত কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হবে। এতে অনৈতিকতার চর্চা উৎসাহিত হতে পারে। এর মাধ্যমে পরোক্ষভাবে বৈধ ট্যাক্সদাতাদের নিরুৎসাহিত করা হয়। আর অনৈতিকভাবে কালো টাকার মালিকরা উৎসাহিত হয়। যে ব্যক্তি তার উপার্জিত অর্থের ওপর নির্ধারিত হারে কর প্রদান করছেন এবং যিনি কর প্রদান করছেন না তারা উভয়ে যদি একই অর্থনীতিতে ব্যবসা-বাণিজ্য করেন তাহলে যিনি কর প্রদান করছেন তিনি বৈষম্যের শিকার হবেন। তিনি বাজার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবেন না। কারণ যিনি বৈধভাবে কর প্রদানের মাধ্যমে পণ্য উৎপাদন ও বিপণন করছেন তার খরচ বেশি পড়বে। আর যিনি কর না দিয়েই পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করছেন তার উৎপাদন ব্যয় কম হবে। কাজেই যিনি কর পরিশোধ করছেন না তার সঙ্গে নিয়মিত কর পরিশোধকারী প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবেন না। তারা নিরুৎসাহিত হবে। ভবিষ্যতে কর আদায় কমে যাবে। কর দানযোগ্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে করের নেটওয়ার্কের আওতায় আনার যে প্রচেষ্টা তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। করোনাকালে যেহেতু দেশের অর্থনীতির অধিকাংশ ক্ষেত্রই সচল নেই, এই সময় কালো টাকার মালিকদের কাছ থেকে বরং যৌক্তিক হারে কর আদায়ের ওপর জোর দিতে পারলে রাজস্ব আদায় কিছুটা হলেও বৃদ্ধি পেত।
বাংলাদেশের ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও সার্ক দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম। বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং আশপাশের দেশগুলোর অর্থনীতির বড় চরিত্রগত পার্থক্য হচ্ছে, এখানে সরকার অনেক আগে থেকেই ব্যবসায়-বান্ধব হওয়ার নামে ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের কর প্রদানের ক্ষেত্রে বড় বড় ছাড় দিয়েছে। প্রতিবেশী দেশগুলোতে সব খাতে প্রতিযোগিতা ঠিক রাখার জন্য সবাইকেই নির্ধারিত হারে কর ধার্যের বিধান আছে। বাংলাদেশে বড় বড় ব্যবসায়, বড় বড় অবকাঠামোগত নির্মাণকাজের জন্য কর রেয়াত দেয়া আছে। কর শুধু রাজস্ব আহরণের হাতিয়ার নয়। কর একই সঙ্গে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার একটি উপায়ও বটে। কেউ যদি কর প্রদান করেন তাকে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি অবলম্বন করে তা দিতে হয়। এ জন্য প্রয়োজনীয় হিসাবপাতি করতে হয়, রাখতে হয়। অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়। করের হিসাব করতে গেলে প্রতিষ্ঠানটির কত টাকা আয়, কত টাকা ব্যয়, টাকা কোত্থেকে এলো- এসব বিষয় উল্লেখ করতে হয়। ফলে কোম্পানিকে একটি শৃঙ্খলার মধ্যে থাকতে হয়।
দেশে বড় বড় প্রকল্প এবং অনেক খাতই কর রেয়াতের আওতায় রয়েছে। ব্যবসায়ীরা যেহেতু নীতিনির্ধারকের নিকটবর্তী উন্নয়নের সহযোগী পরিচয়ে তারা তাদের সুবিধা মতো ভ্যাট বা কর রেয়াত নিয়ে নিচ্ছে। গরিব মানুষ কোনো কর রেয়াত পায় না। এখন বড় বড় ব্যবসায়ীরা কর রেয়াতসহ আর্থিক প্রণোদনা নিচ্ছেন। প্রয়োজনে কর আদায়ের পর তাদের ভর্তুকি দেয়া যেতে পারে। কিন্তু কর আদায় করতেই হবে। যে কোনো প্রতিষ্ঠান সরকারি নিয়ম মোতাবেক কর প্রদান করলে সেই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীলতা বৃদ্ধি পায়। বড় বড় প্রকল্পের কর রেয়াত দেয়া হয় ব্যয় সীমিত রাখার অজুহাতে। কিন্তু সরকার যদি এসব প্রকল্প থেকে কর আদায় করত তাহলে সরকারের রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি পেত। সেই রাজস্ব থেকেই প্রকল্পে ব্যয় নির্বাহ করতে পারত। প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি শুধু করের জন্য হয় না। এর পেছনে আরো অনেক কারণ রয়েছে। সেগুলোকে আমাদের অ্যাড্রেস করতে হবে। সরকারি বড় প্রকল্প থেকে কর আদায় করা হলে তাদের হিসাব সুনির্দিষ্ট সিস্টেমের মধ্যে চলে আসত। ফলে এক ধরনের স্বচ্ছতা সৃষ্টি হতো। যেহেতু এসব প্রকল্পের জন্য কর দিতে হয় না, তাই তারা স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতার ব্যাপারে উদাসীন থাকা চলে। বড় বড় প্রকল্পে বিদেশি ঠিকাদার, কনসালটেন্ট এসে ব্যবসা করে যাচ্ছে কিন্তু তারা কর দিচ্ছে কিনা তার খবরদারি করা যায় না।
তৈরি পোশাকশিল্পের জন্য বিভিন্ন ধরনের আর্থিক প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। এ খাতে এসব সুযোগ কাজে লাগিয়ে কেউ কেউ বিদেশে অর্থ পাচারের মতো কাজ করেছেন কিনা তা দেখার অবকাশ রয়েছে। কেউ আন্ডার ইনভয়েসিং-অভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাচার করছেন কিনা তা ধরার চেষ্টা চলছে। তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের আর্থিক প্রণোদনা দেয়ার পাশাপাশি তাদের রপ্তানি কার্যক্রম যদি সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করে আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে প্রকৃত রপ্তানি আয় কম দেখিয়ে বিদেশে টাকা রেখে দেয়ার প্রবণতা প্রতিরোধ করা প্রয়োজন। সঠিকভাবে কর প্রদানের পরই কেবল একটি প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক প্রণোদনা দেয়া যেতে পারে। এটা করা হলে তারা সঠিকভাবে কর প্রদান করত। কারণ কর প্রদান করা না হলে আর্থিক প্রণোদনা পাওয়া যাবে না। কোনো খাতের জন্য কর রেয়াত দেয়ার আগে ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করে নেয়া প্রয়োজন।
বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উন্নীত হতে যাচ্ছে এটা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত আনন্দের একটি ঘটনা। কিন্তু এখানে একটু বিভ্রান্তি রয়েছে। কারণ আমরা ইতোমধ্যেই উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় রয়েছি। উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে একটি গ্রুপ আছে স্বল্পোন্নত দেশ বা এলডিসি। এলডিসি দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশ বের হয়ে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়। আগামীতে ধাপে ধাপে বাংলাদেশ ২০২৪ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। এটা এখন দুই বছর পিছিয়ে ২০২৬ সাল নির্ধারণ করা হয়েছে। অর্থাৎ ২০২৬ সালে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। আগামীতে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার পর বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। অর্থনীতিকে সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। যদি আগামীতে সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে না পারা যায় তাহলে সাফল্য নিয়ে সমস্যায় পড়তে হতে পারে।
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : কলাম লেখক, সাবেক সচিব ও সাবেক চেয়ারম্যান- এনবিআর।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়