বিজিএমইএ সভাপতি : বন্ধ মিল চালু হলে ফেব্রিক্সের চাহিদা মেটানো সম্ভব

আগের সংবাদ

খাদ্য নিরাপত্তাই প্রধান চ্যালেঞ্জ : সরকারি হিসাব মতে, দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, তবুও চালসহ খাদ্যপণ্য আমদানি করতে হয়

পরের সংবাদ

শিক্ষাগুরু স্মরণে

প্রকাশিত: অক্টোবর ৮, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ৮, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

শিক্ষকতা কোনো পেশা নয় বরং একটি ব্রত। কোনো কোনো শিক্ষকের ব্যক্তিত্ব ছাত্রের জীবনে প্রভাব ফেলে। ছাত্র সেই শিক্ষকের আদর্শ অনুসরণ করে এবং তার প্রিয় শিক্ষকের মতো হতে চায়। শিক্ষকের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সে তার জীবনের লক্ষ্য স্থির করে নেয়। কোনো কোনো শিক্ষকের কথা ক্লাসে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোনে ছাত্রছাত্রীরা। আমিও শুনেছি। অধ্যাপক আহমদ কবির স্যার ছিলেন একজন শিক্ষাবিদ ও গবেষক। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সাহিত্যতত্ত্ব, সাহিত্যের রূপরীতি ও মধ্যযুগীয় সাহিত্যের ওপর পাঠদান ও গবেষণা করেছেন। সমাজ ও সাহিত্য বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনায় তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। সৃজনশীল আধুনিক বাংলা সাহিত্যচর্চা ও সম্পাদনায় তিনি অসাধারণ অবদান রেখে গেছেন। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাপিডিয়া ও ‘হিস্ট্রি অব বেঙ্গল’ গ্রন্থের ভাষা সম্পাদনা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর মানববিদ্যা গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালকও ছিলেন। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশনা সংস্থার পরিচালকের দায়িত্বও পালন করেন তিনি।
অধ্যাপক আহমদ কবির স্যারের সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ দেখা ১৯৯৭ সালে। সে বছর আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য সাক্ষাৎকারে অংশগ্রহণ করতে যাই। কলা ভবনের নিচতলায় একটি কক্ষে আমার সাক্ষাৎকার চলছিল। ভর্তি কমিটির শ্রদ্ধেয় স্যারেরা আমি কোন বিষয়ে ভর্তি হতে চাই সেটি জানতে চেয়েছিলেন। ভর্তি পরীক্ষার মেধাতালিকায় সিরিয়াল নাম্বার পেছনে হওয়ার কারণে আমার কাক্সিক্ষত বিষয় ইংরেজি এবং অর্থনীতি আমি পাইনি, যার কারণে মনটা খুবই বিষণ্ন ছিল। কোন বিষয়ে ভর্তি হবো যখন এই সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না, ঠিক সে সময় দেবদূতের মতো আমার সামনে এলেন অধ্যাপক আহমদ কবির স্যার। তখন পর্যন্ত আমি স্যারকে চিনতাম না। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন আমি কোন বিষয়ে পড়তে চাই। বলে নেয়া ভালো- ইতিমধ্যে আমি সরকারি বি এল কলেজ খুলনাতে অর্থনীতি বিষয়ে পড়ছিলাম। স্যারকে বিষয়টি বললে তিনি আমাকে বললেন যে অতীত ভুলে যাও, তোমার সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে, তুমি বাংলা বিষয়ে পড়তে পারো। কী সিদ্ধান্ত নেব বুঝতে পারছি না। যখন দ্বিধাদ্ব›দ্ব মন নিয়ে আমি বিপাকে তখন অধ্যাপক আহমদ কবির স্যার আমার সব সমস্যার সমাধান করে দিলেন। কী মনে হলো জানি না, এক মিনিটও আর অপেক্ষা না করে সাক্ষাৎকারে গিয়ে ফরম পূরণে স্পষ্ট লিখে দিলাম বিষয় বাংলা।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েই বাংলা বিষয়ের প্রতি এক ধরনের ভীতি জন্মে গিয়েছিল। যদি শুধুমাত্র একটি কারণে আমি অধ্যাপক আহমদ কবির স্যারকে আজীবন স্মরণে রাখি তা হলো তিনি বাংলার প্রতি এই ভীতি শুধু দূর করেছিলেন তাই নয়, বরং এর প্রতি এক ধরনের আগ্রহ সৃষ্টি করিয়ে দিয়েছিলেন। তখন থেকেই স্যারকে চিনি, বিভাগের শিক্ষক হিসেবে। একপর্যায়ে তা আরো প্রগাঢ় হয়। যখন অনার্স তৃতীয় বর্ষের ক্লাস করি। গুরুগম্ভীর বাংলার অধ্যাপক, চেহারায় জ্ঞানের গভীরতার ছাপ স্পষ্টতই অনুভব করা যায়। বাংলা ক্লাসে পড়ানোর সময় বিষয়ের গভীরে ঢুকে যে রসবোধের সৃষ্টি করেন তা না দেখলে কখনোই বোঝা যেত না গুরুগম্ভীর অধ্যাপকের ভেতরটা কতটা সাহিত্যরসে ভরপুর। স্যার যখন ক্লাসে ঢুকতেন আমরা দেখতে পেতাম কখনো একরঙা ধূসর বাদামি বা কখনো লাল রঙের শার্ট বা ফতুয়া পরিহিত পঞ্চাশোর্ধ এক যুবক ক্লাসে প্রবেশ করছেন। যার কর্মে ক্লান্তি বা অবসাদের রেখাচিহ্ন বিন্দু পরিমাণও পরিলক্ষিত হতো না। শিক্ষাদানই যেন তার পরমব্রত। এমন স্টাইলিশ ব্যক্তিত্ব আজকাল সচরাচর খুব একটা দেখা যায় না। স্যার আপাদমস্তক একজন সংস্কৃতিবান মানুষ।
তিনি মানুষ হিসেবে মিশুক, আন্তরিক ও প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ছিলেন। কিন্তু তা কখনোই রাশভারী ছিল না। নিজের সম্মান বজায় রেখে চলতেন। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বিভাগের করিডোরে দেখা হলে নিজে থেকে হাসিমুখে কুশল জানতে চাইতেন। প্রথম দিনের ক্লাসের কথা মনে পড়ে। স্যার বিষয় নিয়ে তেমন কিছুই বললেন না, আমাদের সঙ্গে পরিচিত হলেন। বললেন নিজের কিছু কথা। বিনয় ঝরে পড়ছিল তার কথায়। সাধারণ কিছু কথা বললেন যাকে অসাধারণ বললেও খুব কম বলা হয়। আমাদের বলেছিলেন আত্মশক্তিতে বলীয়ান হওয়ার কথা। বলেছিলেন প্রতিটি মানুষই অমিত মেধা আর ক্ষমতা নিয়ে জন্মায় কিন্তু তার সঠিক প্রয়োগ করতে পারে না। বলেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে যা-ই কর না কেন লেখাপড়াটাই যেন হয় তোমাদের লক্ষ্য। তিনি বারবার আমাদের স্মরণ করিয়ে দিতেন যে বিশ্ববিদ্যালয় শুধু শেখার নয়, জ্ঞান সৃজনের একটি জায়গা। এখানে শিক্ষক যতটা না শেখাবেন তার চেয়ে বেশি তিনি শিক্ষার্থীদের নতুন নতুন জ্ঞানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবেন। স্যার ছিলেন অসম্ভব সৎ ও নির্লোভ একজন মানুষ- নীতির প্রশ্নে আপসহীন। স্যার অতি উচ্চ একটা মান স্থাপন করেছিলেন, যা হওয়া উচিত সবার অনুকরণীয়। মিশুক স্বভাবের গুণে তিনি ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বোঝাপড়ার ব্যাপারে অনন্য ছিলেন। অত্যন্ত রুচিশীল ও সৌখিন মানুষ ছিলেন তিনি।
স্যারকে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলাম বিএ অনার্সের তৃতীয় বছরে। তিনি ৩০২ নং কোর্স পড়াতেন। সাহিত্যতত্ত্ব বিষয়ক কোর্স ছিল এটি। প্রথম অংশে ছিল প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সাহিত্যতত্ত্ব। এতে ছিল প্লেটো, অ্যারিস্টটল, হোরেস ও লঙ্গিনুসের সাহিত্য ভাবনা। আমার এখনো মনে আছে প্লেটো সম্পর্কে তিনি আমাদের বলেন, ‘চারটি গ্রন্থে প্লেটো কথোপকথনের মাধ্যমে সাহিত্য ও শিল্পের আমূল মিশ্রণ ঘটিয়েছেন। যার প্রথম দুটিতে রয়েছে সাহিত্য ও শিল্পে অনুপ্রেরণা ও অনুকরণতত্ত্ব। পরের দুটি গ্রন্থে তিনি প্রমাণ করেছেন যে সাহিত্য ও শিল্প মানুষের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনীয়তা বহন করে কি না। এজন্যই প্লেটোকে বলা হয়ে থাকে ‘সাহিত্য চিন্তার পথিকৃৎ’। আর অ্যারিস্টটল সম্পর্কে পড়াতেন ‘সাহিত্য কাকে বলে, সাহিত্যের মধ্যে কী আছে, সাহিত্য থেকে আমরা কী শিক্ষা পাই, সাহিত্য কীভাবে শেখায়, পাঠকের মনে সাহিত্যের প্রভাব কেমন, সে সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের কিছু নিজস্ব মতামত কেমন ছিল। নিজের সেই অনুধাবনগুলো কীভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন ‘পোয়েটিক্স’ নামক বইতে। ‘সাহিত্যের তত্ত্বভিত্তিক প্রথম একক বই অ্যারিস্টটলের। তার বইয়ের মূল নাম পেরি পোইয়েতিফেস, ইংরেজিতে পোয়েটিকস এবং বাংলায় কাব্যতত্ত্ব। কী অসাধারণভাবে তিনি পঙ্ক্তিগুলো উচ্চারণ করতেন!
দ্বিতীয় অংশে ছিল সংস্কৃত সাহিত্যতত্ত্ব। এতে ছিল কবিতা সম্পর্কিত সংস্কৃত মতবাদসমূহ। ধ্বনিবাদ, রসবাদ, গুণবাদ, শব্দার্থবাদ, রীতিবাদ, অলঙ্কার তত্ত্ব, বক্রোক্তিবাদ প্রভৃতি পড়াতেন স্যার। বলতে দ্বিধা নেই, এ কোর্সটি পুরো অনার্সের চার বছরের সবগুলো কোর্সের মধ্যে কঠিনতম কোর্স ছিল। তবে স্যার বিষয়গুলো যথাসাধ্য সহজভাবে দৃষ্টান্ত দিয়ে বোঝাতেন। রস সম্পর্কে পড়াতে গিয়ে তিনি বলতেন, মানুষের মনের নয়টি ভাব থেকে নয়টি রসের জন্ম হয়। ‘সাহিত্যের জগত অলৌকিক মায়ার জগত’ কিংবা বিশ্বনাথের ‘বাক্যং রসাত্মকং কাব্যম’- রসাত্মক বাক্যই হলো কাব্য অথবা ‘বক্রোক্তিঃ কাব্যজীবিতম’- বক্রোক্তিই কাব্যের প্রাণ। বা আনন্দবর্ধনের উদাহরণ দিতেন,

রসবন্তি হি বস্তুনি সালংকারাণি কানিচিৎ।
প্রাযেণৈব পরাং ছায়াং বিভ্রাল্লক্ষ্যে নিরীক্ষতে।।

অর্থাৎ, কোনো কোনো রসযুক্ত কাব্যবস্তু অলঙ্কৃত হয়ে প্রায়ই উৎকৃষ্ট কান্তি ধারণ করে কাব্যে লক্ষিত হয়। চতুর্থ বর্ষে স্যারকে আবার পেয়েছিলাম কোর্স শিক্ষক হিসেবে। তিনি পড়াতেন ৪০১ সংখ্যক কোর্স- সাহিত্য সমালোচনার ধারা। এর দুটি অংশ ছিল। পাশ্চাত্য অংশ ও বাংলা অংশ। পাশ্চাত্য অংশে আমাদের পড়তে হয়েছে নিউ-ক্লাসিসিজম, রোমান্টিসিজম, রিয়ালিজম, নেচারালিজম, মার্কসিজম, ফ্রয়েডিজম, ফেমিনিজম, মডার্নইজম, পোস্ট-মডার্নইজম প্রভৃতি। কী সুন্দর করে তিনি মণীষীদের নামগুলো বলতেন! উইলিয়াম ওয়ার্ডস ওয়ার্থ, এস টি কোলরিজ, এমিল জোলা, সিগমুন্ড ফ্রয়েড, সিমন দ্য বেইভার প্রভৃতি। বাংলা অংশে পড়তে হয়েছে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রমথ চৌধুরী, মোহিতলাল মজুমদার, বুদ্ধদেব বসু, আবু সয়ীদ আইয়ুব, মুনীর চৌধুরী প্রমুখের প্রবন্ধ। সাহিত্য সম্পর্কে তাদের ভাবনা স্যার গুছিয়ে পড়াতেন। শুধু পড়াশোনার ব্যাপারেই নয়, তাদের ব্যক্তিগত কোনো সমস্যা দেখা দিলেও স্যার তার সমাধানে এগিয়ে আসতেন। এক কথায় স্যারের কাছে সাহায্য চেয়ে কেউ বিমুখ হয়েছে এমনটা আমার জানা নেই। আমি চিরদিন এই মহান শিক্ষকের কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকব। স্যার আমার কাছে ছিলেন বিশাল এক মহীরূহ। তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে অবদান রেখে গেছেন তার সেই অবদান জাতি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করবে। তার মৃত্যু উচ্চশিক্ষা বিশেষ করে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়