বিজিএমইএ সভাপতি : বন্ধ মিল চালু হলে ফেব্রিক্সের চাহিদা মেটানো সম্ভব

আগের সংবাদ

খাদ্য নিরাপত্তাই প্রধান চ্যালেঞ্জ : সরকারি হিসাব মতে, দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, তবুও চালসহ খাদ্যপণ্য আমদানি করতে হয়

পরের সংবাদ

জলবায়ু পরিবর্তনে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে, বিস্তার ঘটছে ডেঙ্গুর >> বিশ্বব্যাংকের গবেষণা : প্রভাব পড়ছে মানসিক স্বাস্থ্যেও

প্রকাশিত: অক্টোবর ৮, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ৮, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কাগজ প্রতিবেদক : বাংলাদেশে ষড়ঋতুর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য অনেকটাই বিলুপ্ত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই এমনটা হচ্ছে। আর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে জনস্বাস্থ্যের ওপর। আগামী দিনগুলোতে এই প্রভাব আরো প্রকোট হবে বলে আভাস দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। বিশ্বব্যাংক বলছে, জলবায়ু বদলে যাওয়ার প্রবণতা যত দ্রুত হচ্ছে, স্বাস্থ্যের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাবও ততই বাড়ার শঙ্কা দেখা যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে সংক্রামক রোগের বিস্তারে। এর ফলে ডেঙ্গুসহ বাহকবাহিত রোগের প্রকোপ বাড়বে। বাড়ছে মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। বিরূপ প্রভাব পড়ছে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও। সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে শিশু ও বয়স্করা এবং যারা ঢাকা-চট্টগ্রামের মতো বড় শহরে বাস করে। আর শুকনো মৌসুমে এসব শহরে বাড়ছে শ্বাসতন্ত্রের রোগ, যাতে মূল ভূমিকা রাখছে বায়ুদূষণ।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব সংক্রান্ত বিশ্বব্যাংকের এই গবেষণার ফলাফল গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে ওয়েবিনারে তুলে ধরা হয়। অনুষ্ঠানে সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী, পরিবেশবিদ সেলিমুল হক, বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ ও ভুটানের কান্ট্রি ডিরেক্টর মার্সি টেম্বন বক্তব্য রাখেন। বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র অপারেশন অফিসার ইফফাত মাহমুদ অনুষ্ঠানে গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মৌসুম হোক বা না হোক, ডেঙ্গুর মতো বাহকবাহিত রোগের প্রকোপ শহর এলাকায় বাড়ছে। আর্দ্রতা কমে আসার পাশাপাশি তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের মাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভবিষ্যতে ঢাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ আরো বাড়তে পারে।
প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ১৯৭৬ সাল থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশে গণ তাপমাত্রা বেড়েছে শূন্য দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর তার ফলে ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছে ঋতুভেদে আবহাওয়ার বৈচিত্র্য। প্রতি বছর গ্রীষ্মের সময়টা একটু একটু করে বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে গরম। ক্যালেন্ডারে যে

সময়টায় শীত থাকার কথা, তখনো তাপমাত্রা তুলনামূলকভাবে বেশি থাকছে। সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে গড় বৃষ্টিপাত বেড়ে যাওয়ায় দীর্ঘায়িত হচ্ছে বর্ষাকাল। অথচ আগে যে সময়টায় অর্থাৎ জুন থেকে আগস্ট সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হত এখন সেই সময়ে গড় বৃষ্টিপাত কমে যাচ্ছে। এর ফল হচ্ছে অন্যরকম। এই সময়টায় যেসব রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়, তা আরো বেশি সময় ধরে ছড়ানোর মতো উপযুক্ত তাপমাত্রা ও বৃষ্টির পরিবেশ পাচ্ছে। ১৯৯০ সালের পর থেকে পুরো বিশ্বেই এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুর প্রকোপ প্রতি এক দশকে দ্বিগুণ হচ্ছে। বাংলাদেশে ২০১৯ সালে ডেঙ্গুর ব্যাপকতা দেখা দেয়। তখন সারাদেশে যত মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল তার অর্ধেকই ঢাকার। এছাড়া ঢাকাতেই ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হার ছিল ৭৭ শতাংশ। ওই বছর ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় ভারি বর্ষণের সঙ্গে পরের মাসগুলোর অনুকূল তাপমাত্রা আর আর্দ্রতা ডেঙ্গুর ব্যাপক বিস্তারে ভূমিকা রেখেছিল বলে মনে করছে সংস্থাটি।
বর্ষাকালের তুলনায় শুকনো মৌসুমে সংক্রামক রোগের প্রবণতা ১৯ দশমিক ৭ শতাংশ কমে আসে। ডেঙ্গু বা ম্যালেরিয়ার মতো মশাবাহিত রোগের ক্ষেত্রে এটা আরো বেশি প্রযোজ্য। এসব রোগে প্রতি বছর যে পরিমাণ মানুষ আক্রান্ত হয়, তার ২৫ শতাংশ হয় বর্ষাকলে, আর শীতকালে হয় ১৪ শতাংশ। এর মানে হলো, বর্ষাকালের সময় বাড়লে এসব রোগের মৌসুমও দীর্ঘ হবে।
গবেষণায় মানসিক স্বাস্থ্যর ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের উদ্বেগে ভোগার প্রবণতাও বেড়ে যায়। আর গ্রামের তুলনায় শহরের মানুষের ওপর এর প্রভাব বেশি পড়ে। নারীদের তুলনায় পুরুষরা বেশি মাত্রায় উদ্বেগে ভোগেন। তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা বাড়ার সঙ্গে শ্বাসকষ্টজনিত অসুস্থতা বাড়ে। তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে মানুষের শ্বাসকষ্টজনিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা ৫ দশমিক ৭ শতাংশ বেশি থাকে; আর্দ্রতা ১ শতাংশ বাড়লে শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ ধরা পড়ার আশঙ্কা ১ দশমিক ৫ শতাংশ বাড়ে।
বিশ্বব্যাংক বলছে, বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের ধারা যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে অবস্থা যদি সবচেয়ে বেশি খারাপ হয়, পৃথিবীর তাপমাত্রা যদি ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়ে যায়, তাহলে স্বাস্থ্য সমস্যা এতটাই বেড়ে যাবে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর এতটাই চাপ পড়বে- খাপ খাইয়ে নেয়ার ধারণা তখন আর কোনো কাজে আসবে না। সংস্থাটি বলছে, ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা ১ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যেতে পারে। আর ২১০০ সাল নাগাদ তা বেড়ে যেতে পারে ২ দশমিক ৪ ডিগ্রি পর্যন্ত। ২০৪০ থেকে ২০৫৯ সালের মধ্যে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বাড়তে পারে ৭৪ মিলিমিটার।
বিশ্বব্যাংকের চার সুপারিশ : প্রথমত, স্থানীয়ভাবে আবহাওয়ার পরিবর্তনের তথ্য সংগ্রহে আরো মনোযোগ দিতে হবে। মৌসুমি রোগের বিস্তারের ওপর নজরদারি বাড়াতে হবে। এজন্য আঞ্চলিক আবহাওয়া অফিসের সংখ্যা এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পর্যবেক্ষণ সক্ষমতা বাড়াতে হবে। দ্বিতীয়ত, আবহাওয়ার তথ্যের ওপর নির্ভর করে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের বিষয়ে আগাম সতর্কতা জারি বা পূর্বাভাস দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তৃতীয়ত, মশা নিয়ন্ত্রণে প্রজননস্থল ধ্বংসের মতো কাজে স্থানীয় বাসিন্দদের আরো বেশি মাত্রায় সস্পৃক্ত করতে হবে। চতুর্থত, নাগরিকদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে জরুরি ভিত্তিতে নজর দিতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন : ডেঙ্গুর ব্যাপকতা বাড়ার প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুই দশক ধরে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে এডিস মশা নির্মূল ও হাসপাতালে রোগী ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করছে সরকার। তবে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারায় প্রতি বছরই বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী। এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, ডেঙ্গুর ভয়াবহতা হতে পারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জরিপে এমন সতর্কবার্তা সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হলেও তা আমলে নেয়নি স্থানীয় সরকার বিভাগ। দীর্ঘদিন ধরে বলার পরও আধুনিক প্রযুক্তি এবং পরিকল্পনা সিটি করপোরেশনের নেই। তবে কিছু দায় স্বাস্থ্য বিভাগেরও আছে। এক পক্ষ অপর পক্ষকে দোষারোপ আর জনগণকে সচেতন হওয়ার দোহাই দিয়েই যাচ্ছে। কিন্তু জনগণ কী করবে? শুধু জমা পানি ফেলে দিলেই মশা নিয়ন্ত্রণ হবে না।
ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে ২০১২ সালেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটি সতর্ক বার্তা দিয়েছিল। সংস্থাটি বলেছিল, বিশ্বের শতকরা ৪০ ভাগ মানুষ ডেঙ্গু ঝুঁকিতে রয়েছে। এতে এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করে বলা হয়, ডেঙ্গু বৈশ্বিক উদ্বেগের বিষয় হলেও আক্রান্তের ৭৫ শতাংশ এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে। সংস্থাটি ২০১২ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে বৈশ্বিক কৌশলপত্র প্রকাশ করেছিল। তাতে এডিস মশা কিভাবে উৎপত্তি হয়, এর অবস্থানস্থল কোথায়, কখন কামড়ায়, কিভাবে রোগের লক্ষণ শুরু হয় এবং প্রতিকারের উপায় কি এসব নিয়ে দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছিল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক এক কর্মকর্তা ভোরের কাগজকে বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে হলে প্রথমেই এর বাহক এডিস মশা নির্মূল করতে হবে। প্রাপ্তবয়স্ক এডিস মশা চিহ্নিত করে তাদের মধ্যে ভাইরাস আছে কিনা পরীক্ষা করতে হবে। একই সঙ্গে মশা মারার জন্য যে ওষুধ দেয়া হয়, তা কতটুকু কার্যকর এবং এর বিপরীতে মশার শরীরে প্রতিরোধী ক্ষমতা জানতে হবে। শুধু লার্ভা ধ্বংস করে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। এডিস মশার উৎস ধ্বংসে রাসায়নিক প্রয়োগ করতে হবে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ মনে করেন, ডেঙ্গুর সঙ্গে নগরায়ণের একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, অনিয়ন্ত্রিত ও অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ে। সিটি করপোরেশন বা পৌরসভা অপেশাদারিত্বের সঙ্গে এ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। কীটতত্ত্ববিদ, রক্তরোগ, ভাইরোলজিস্টসহ বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ পরামর্শক দল নিয়ে পরিকল্পনামাফিক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা না গেলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়