বিজিএমইএ সভাপতি : বন্ধ মিল চালু হলে ফেব্রিক্সের চাহিদা মেটানো সম্ভব

আগের সংবাদ

খাদ্য নিরাপত্তাই প্রধান চ্যালেঞ্জ : সরকারি হিসাব মতে, দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, তবুও চালসহ খাদ্যপণ্য আমদানি করতে হয়

পরের সংবাদ

গোলাম সামদানী কোরায়শী : মানবমুক্তির সারথি

প্রকাশিত: অক্টোবর ৮, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ৮, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সাহিত্যিক-শিক্ষাবিদ গোলাম সামদানী কোরায়শী ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার বীরআহাম্মদপুর গ্রামে তার মাতুলালয়ে। নেত্রকোনার চন্দ্রনাথ হাই স্কুলে ছাত্র হিসেবে এক বছর পর ফিরে আসেন গৌরীপুরে; অতপর নেত্রকোনার মদন উপজেলার বাস্তায় মাদ্রাসা জীবন শুরু; ময়মনসিংহে ও ঢাকায় শিক্ষাগ্রহণ এবং টাইটেল ডিগ্রি লাভ; টাইটেলে তিনি মোমতাজুল মোহাদ্দেসীন এবং স্বর্ণপদক লাভ করেন। মাদ্রাসার ছাত্রজীবনে তিনি মাঠের রাখালের দায়িত্বও পালন করেন। শেষ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন; নিজেকে প্রস্তুত করে নেন মুক্তচিন্তার একজন মানুষ হিসেবে। মানুষের মুক্তিচিন্তায় জীবন উৎসর্গ করেন। মানুষ সম্পর্কে তার চিন্তার প্রতিফলন দেখি নিচের কবিতায়-

ষাট বছরে পা রেখেছি যেই
অমনি ওরা বললো এসে, ‘মানুষ’ তুমি,
গলায় মালা দেবো তোমাকেই।

শুনে ওদের কথা
বুকের মাঝে প্রশ্ন হয়ে বাড়লো নীরবতা।

তাহলে কী পেরিয়ে অনেক গলি
ঝেরে ঝুরে পুরনো সব কথামালার থলি
যে মানুষের খোঁজে আমি এখনো পথ চলি
সেই মানুষই আছে আমার মাঝে?
ষাটটি বছর বৃথাই গেলো মানুষ খোঁজার কাজে?

বললো ওরা, নয় তা বৃথা নয়
মানুষ খোঁজো বলেই তোমার ‘মানুষ’ পরিচয়।
এই না বলে পরিয়ে দিলে মালা
মনে মনে বুঝতে পেলাম মানুষ হবার জ্বালা।

‘মানুষ’ সেতো পরশমণি ভাই
আমি আজো মানুষ খুঁজি তাই।
(মানুষ \ গোলাম সামদানী কোরায়শী)

এভাবেই গোলাম সামদানী কোরায়শী নিজেকে প্রস্তুত করেন জীবনযুদ্ধের জন্য। আমাদের সাহিত্যাঙ্গনে গোলাম সামদানী কোরায়শী এমন এক নাম, যাকে আমরা সবসময়ই শিক্ষক হিসেবে মান্যতা দিই। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তার পদচারণা আমাদের মুগ্ধ করে- ঋদ্ধ করে। তিনি প্রবন্ধ লিখেছেন, গল্প লিখেছেন, উপন্যাস লিখেছেন, নাটক লিখেছেন, গান লিখেছেন এবং অনুবাদ করেছেন। বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে বলা যায়, একদিকে তার অনুবাদ কর্ম, প্রবন্ধ এবং সিমেটিক মিথভিত্তিক উপন্যাসগুলো আমাদের সাহিত্যে অমূল্য সম্পদ হয়ে আছে; সাথে যোগ হয়েছে অন্যান্য অনুষঙ্গ। গোলাম সামদানী কোরায়শীর আরো একটি বড় কাজ বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ‘আঞ্চলিক ভাষার অভিধান’ রচনায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সাথে দায়িত্ব পালন। আমাদের বাংলা ভাষায় প্রচুর আরবি-ফার্সি শব্দ একীভূত হয়ে আছে, প্রধানত আমাদের আঞ্চলিক ভাষা থেকে সেইসব প্রায় অচেনা শব্দকে খুঁজে নেবার প্রয়োজনে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ গোলাম সামদানী কোরায়শীর শরণাপন্ন হন; তার আরবি ও ফারসি ভাষার ওপর দখল তাকে এ কাজে সম্পৃক্ত হতে সহযোগিতা করেছে। তার প্রতি ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর আস্থার বিষয়টি নিশ্চিত হই, তার আত্মজৈবনিক রচনা ‘সিন্ধুর এক বিন্দু’ পাঠে। গোলাম সামদানী কোরায়শী তার কর্মজীবন শুরু করেছিলেন বাংলা একাডেমিতে বহু ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর অধীনে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তখন বাংলা একাডেমিতে ‘আঞ্চলিক ভাষার অভিধান’ সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করছেন। কবি সৈয়দ আলী আহসান তখন বাংলা একাডেমির পরিচালক (বর্তমানে পদবি মহাপরিচালক)। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ যখন সৈয়দ আলী আহসানকে প্রস্তাব করেন, সামদানী কোরায়শীকে সহকারী সম্পাদক হিসেবে নিয়োগ দিতে, তখনই ঘটে বিপর্যয়। আসুন আমরা গোলাম সামদানী কোরায়শীর বয়ানে শুনে নিই ঘটনাটি-
‘এর মধ্যে আবার রফিকের পোস্টকার্ড এসে উপস্থিত। সংবাদটি হলো, তোর চাকরি হয়ে গেছে।
আমার গাঁটরী বাঁধাই ছিল। পরদিনই ঢাকা গিয়ে উপস্থিত হলাম। সে দিনটি ছিল ২৬ ফেব্রুয়ারি। রফিককে সাথে নিয়ে বিকালে গেলাম ডক্টর সাহেবের ওখানে। তিনি দেখেই বললেন, কালই একাডেমিতে এসো, তোমার নিয়োগপত্র দেয়া হবে। আমি নীরবে সম্মতি জানিয়ে বেরিয়ে এলাম। পথে রফিককে বললাম, কী হয়েছিল রে? হঠাৎ এমন নিয়োগপত্র দেয়া হচ্ছে!
রফিক বললো, বুড়ো রাগ করে পদত্যাগপত্র দাখিল করেছিলেন। তাই সৈয়দ সাহেব বুড়োর রাগ থামানোর জন্য তোকে চাকরি দিতে বাধ্য হয়েছেন।
পরদিন ২৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬১ সন, আমি বাংলা একাডেমির আঞ্চলিক ভাষার অভিধান প্রকল্পের সহকারী সম্পাদক হিসেবে আমার নিয়োগপত্র পেলাম। আমার বেতন নির্দিষ্ট হলো ৬০০ টাকা। (সিন্ধুর এক বিন্দু \ গোলাম সামদানী কোরায়শী)
বাংলা একাডেমিতে চাকরি পাওয়াটা ছিল তার জীবনে নতুন বাতিঘর পাবার ঘটনা, সেখানেই তিনি ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য পেলেন জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর। সেখানে চাকরিকালেই তিনি তার জীবনের উল্লেখযোগ্য অনুবাদকর্মগুলো সম্পাদন করেন। আমরা যদি তার অনুবাদ সম্ভারের দিকে তাকাই তাহলে দেখবো তিনি অনুবাদ করেছেন-
‘কালিলা ও দিমনা’ : মূল ফার্সি, হুসায়ন আল কাশেফের ‘আনোয়ারে সুহায়েল’। প্রকাশক : বাংলা একাডেমি (১৯৬৫); ‘হেজাজের সওগাত’ : মূল ফার্সি মহাকবি ইকবালের ‘আরমুগানে হেজাজ’, কাব্য। প্রকাশক : ইকবাল একাডেমি (১৯৬৫); ‘তারিখ-ই-ফিরোজশাহী’ : মূল ফার্সি, জিয়া উদ্দিন বারানী। প্রকাশক : বাংলা একাডেমি (১৯৮২); ‘তোফা’ : মূল ফার্সি, শায়ুখ ইউসুফ গদা-এর ‘তুহফা-ই-নসাঈহ’। প্রকাশক বাংলা একাডেমি; ‘আল-মুকাদ্দিমা’: মূল আরবি, ইবনে খলদুন-এর ‘কিতাবুল ইবার’ প্রকাশক বাংলা একাডেমি (দুই খণ্ড ১৯৮১ ও ১৯৮২); ‘আইন আদালতের ভাষায় আরবি ফার্সি শব্দ’ : মূল ইংরেজি, ও’ জন বার্নস, প্রকাশক : বাংলা একাডেমি (১৩৭১); ‘অশাস্ত্রীয় পুরাণ’ : মূল ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়, প্রকাশক : বাংলা একাডেমি (১৩৭১); ‘শব্দাদর্শ অধ্যয়ন’ : মূল মুহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ, প্রকাশক : বাংলা একাডেমি (১৩৭২); ‘আমার অভিযোগ’ : প্রবন্ধ, মূল উর্দু, সাদাত হাসান মান্টোর ‘মুঝে ভি শেকায়েত নেহী’ : প্রকাশক : জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্র, ঢাকা (১৯৬৫); ‘ফতেহাবাদের আউলিয়া কাহিনী’; মূল সৈয়দ ইনায়েত হুসাইন রিযভী, প্রকাশক : বাংলা একাডেমি (১৩৬৮) ইত্যাদি। এছাড়াও তিনি বেশকিছু অনুবাদ করেছেন, যেগুলো বিভিন্ন সাময়িকী এবং পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। উল্লেখ করতে পারি- সাদাত হাসান মান্টোর ছোটগল্পের নাট্যরূপ : ভেজাল; যা নাসিরাবাদ কলেজ বার্ষিকীতে প্রকাশিত (১৯৭৮); ফার্সি রস রচনা : ‘চাটনি’ : সাপ্তাহিক ময়মনসিংহ বার্তা জেলা বোর্ড কর্তৃক ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত; ইত্যাদির নাম।
এসব গুরুত্বপূর্ণ অনুবাদকর্ম ছাড়াও তিনি লিখেছেন কয়েকটি সেমিটিক মিথোলজি নির্ভর উপন্যাস; স্বর্গীয় অশ্রæ (১৩৮০), মহাপ্লাবন (১৩৮৩), পুত্রোৎসর্গ (১৩৮৩) ইত্যাদি। তার উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগ্রন্থ : আরবি সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস (বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত); সাহিত্য ও ঐতিহ্য (মুক্তধারা ১৯৮১); ইসলাম ও আমেরিকা (জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী) ইত্যাদি। তার রচনার আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ- আত্মজীবনী : সিন্ধুর এক বিন্দু। আত্মজীবনীতে আমরা পাই তার জীবনের উত্থান-পতন, জীবন সংগ্রামের নিবিড়তম প্রিয়-অপ্রিয় নানান বাস্তবতা। আত্মজীবনী সিন্ধুর এক বিন্দু তাকে ঘনিষ্ঠভাবে জানার সুযোগ করে দিয়েছে। যদিও আত্মজীবনীতে তিনি ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে ১৯৯১-এর ১১ অক্টোবর, মৃত্যু পর্যন্ত সময়টা লিখে যেতে পারেননি। কিন্তু অসম্পূর্ণ আত্মজীবনীতে যে আলোর দিশা রেখে গেছেন তাও মহার্ঘ। বিরুদ্ধ সময়ে তিনি রচনা করেছেন ‘ছোটদের বঙ্গবন্ধু’ শিরোনামের বই (১৯৯০-এ শিশু একাডেমি থেকে প্রকাশিত)। লিখেছেন ‘ছোটদের দুদুমিয়া’র সংগ্রামী জীবনকথা (১৯৯০-এ শিশু একাডেমি থেকে প্রকাশিত)।
তার প্রকাশিত গ্রন্থেও যে তালিকা উপস্থাপন করা গেলো, তারচেয়ে দীর্ঘ তার অগ্রন্থিত রচনার তালিকা। বাংলা একাডেমির কর্মজীবন শেষে তিনি তার জীবনের দীর্ঘ একটা সময় ময়মনসিংহে অবস্থান করেন। ময়মনসিংহে অবস্থান কালে তিনি তার সাংগঠনিক কর্মতৎপরতা নিয়ে সামাজিক-সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অনেক বেশি অনিবার্য হয়ে উঠলেও নিজের সৃজন ও প্রকাশনার জায়গাটিতে কিছুটা পিছিয়ে পড়েন; বিশেষত সৃজনকর্ম এগিয়ে চললেও গ্রন্থ প্রকাশনার কাজটিতে পিছিয়ে পড়েন। এটি তার কোনো অপূর্ণতা নয়, বরং এও তার মানুষের সাথে নিবিড় হবার স্বপ্ন পূরণের এক বড় অধ্যায়। ময়মনসিংহের জীবনে তিনি গ্রামের বিচার সালিশ থেকে শুরু করে কবরস্থান প্রতিষ্ঠার কাজেও নিজের সময় ব্যয় করেছেন, ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। গণতন্ত্রের মুক্তির জন্য ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ তিনি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আহ্বায়ক হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং যাপিত জীবনের প্রতিদিন মানবতার মুক্তির জন্য সংগ্রাম করে গেছেন। এভাবেই তার জীবনের ব্রত হয়ে উঠেছে নিজের এবং প্রতিটি মানুষের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ জাগিয়ে তোলা। তার লেখা ‘মানুষ’ শিরোনামের ছোট্ট একটি কবিতার কথা আমরা আরো একবার স্মরণ করে নিতে পারি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়