বিজিএমইএ সভাপতি : বন্ধ মিল চালু হলে ফেব্রিক্সের চাহিদা মেটানো সম্ভব

আগের সংবাদ

খাদ্য নিরাপত্তাই প্রধান চ্যালেঞ্জ : সরকারি হিসাব মতে, দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, তবুও চালসহ খাদ্যপণ্য আমদানি করতে হয়

পরের সংবাদ

আমার বাবার যাপিত জীবন

প্রকাশিত: অক্টোবর ৮, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ৮, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

‘আধেক ঘুমে নয়ন চুমে স্বপন দিয়ে যায়
শ্রান্ত ভালে যূথীর মালে পরশে মৃদু বায়
বনের ছায়া মনের সাথি, বাসনা নাহি কিছু
পথের ধারে আসন পাতি, না চাহি ফিরে পিঠু
বেণুর পাতা মিশায় গাথা নীরব ভাবনায়’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই গানটি আমার আব্বার খুব প্রিয় একটি গান। অসম্ভব গান পাগল মানুষ ছিলেন আমার আব্বা অধ্যাপক আহমদ কবির। আব্বা হয়ে যাবেন অতীত, আর আমি আজ উনাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করব- এ আমার জন্য ভয়ংকর মনোকষ্টের। প্রতিটি নিঃশ্বাসে যিনি বিরাজমান তাকে চিত্রিত করা ভীষণ রকমের দুষ্কর এবং দুঃসাহসের। আব্বার যাপিত জীবনের কিছু স্মৃতি নিয়ে এই লেখা।
আব্বার কাছ হতেই শোনা তার ছোটবেলার কথা। গ্রামের স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন এবং ওই স্কুলের সেরা ছাত্রদের একজন উনি। আব্বাই সর্বপ্রথম মিঠাছরা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রথম বিভাগ প্রাপ্ত ছাত্র এবং একই সাথে প্রথম অ্যালামনাই যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছেন। পরবর্তীতে উনার পরিবারের আরো কিছু সদস্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষী ইতিহাসের সাথে আমাদের পরিবারের রয়েছে এক সুনিবিড় সম্পর্ক। আব্বার মেজো ফুফা অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুস সোবহান বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালে ১৯২১ সালে আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে অধ্যাপনা করতেন। তিনি আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের পাস, পরবর্তীতে অক্সফোর্ডে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন। পর্যায়ক্রমে আব্বা, তার ভ্রাতুষ্পুত্র এবং এর ধারাবাহিকতায় আমরা তিন বোন বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপনায় যুক্ত হই।
তারাশঙ্কর, মানিক কিংবা জীবনানন্দের উপন্যাস। আর রবীন্দ্রনাথ তো আছেই। আব্বাই হাতে তুলে দেন হোমারের ‘ইলিয়াড’, ‘ওডিসি’, গিবনের ‘ফল অফ দ্য রোমান এম্পেরর’ কিংবা তলস্তয়ের ‘ওয়ার এন্ড পীস’, কালিদাসের মেঘদূত (প্রথমে বুঝতে পারিনি, পরে আব্বা বুঝিয়েছিলেন), গ্রিক পুরাণ, হিন্দু পুরাণ… অসীম এই তালিকা। আব্বা আমার মাঝে আগ্রহ তৈরি করেছেন, সাহিত্যের রস বুঝিয়েছেন এবং বিজ্ঞানের ছাত্রী হয়েও মনে প্রাণে সাহিত্যের প্রতি চরমভাবে আসক্ত করেছেন। জানা এবং জানানো এটাই আমার আব্বার সারাজীবনের ব্রত ছিল। আমাদেরকেও এ ব্যাপারে নিরন্তর উৎসাহিত করেছেন।
নিয়মিত রাখা হতো, এর সঙ্গে ছিল দেশ, রিডারস ডাইজেস্ট আর টাইমস। সারাজীবন আব্বার বিছানার অর্ধেকটাজুড়ে থাকত ম্যাগাজিন আর বই, আম্মা এটা মেনে নিয়েছিলেন সানন্দে। চলচ্চিত্র প্রসঙ্গে আসি : সকল বাঙালির মতো আব্বারও প্রিয় উত্তম-সুচিত্রা জুটি। সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় আব্বার খুব পছন্দের নায়িকা : তার স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয়ের জন্য, চরিত্রাভিনেতা হিসেবে ছবি বিশ্বাস, পাহাড়ি সান্যাল, উৎপল দত্ত আর গোলাম মোস্তফা। বলিউডে পছন্দ দিলীপ কুমার আর মীনা কুমারী, প্রিয় ছবি ‘বৈজু বাওয়া’, অসংখ্যবার দেখা আর মন্ত্রমুগ্ধের মতো গান শোনা। আব্বার চিরকালীন পছন্দ ‘হারানো সুর’ আর আমার ‘সপ্তপদী’, কতবার যে এই দুটো সিনেমার তুলনামূলক আলোচনা করেছি আমি আর আব্বা কিন্তু কোনোভাবেই ‘হারানো সুর’কে ‘সপ্তপদী’ হারাতে পারেনি! হলিউডে গ্রেগরী পেক সবার উপরে : ‘টু কিল আ মকিং বার্ড’, ‘মবিডিক’, ‘গানস অব প্রতিবেশীরা আম্মাকে সান্ত¡না দিচ্ছেন কারণ তাদের ধারণা হয়েছে আমাকে ছেলেধরা নিয়ে গেছে! এই হলো আমার আব্বা : জীবনকে প্রথাবিহীনভাবে আনন্দসহকারে উপভোগ করেছেন এবং অন্যকেও করিয়েছেন। অন্যের জন্য কল্পনার দ্বার খুলে দিয়েছেন।
খেলতেন ভালো। আমার মামা সাদউদ্দিন আহমেদ কিসলু বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন, উনাদের একে ওপরের প্রতিপক্ষ হয়ে খেলতে দেখেছি। আব্বার সাথে টেবিল টেনিস খেলেছি আমিও, শেষ খেলি ২০১৭-তে সিলেটে, তখনো আব্বার কনট্রোল অনেক এবং দারুণ স্পিন বল করে আমাকে বারংবার পর্যুদস্ত করেছেন।
মাঝে মাঝে ক্লান্ত হয়ে পড়তেন, তবে আমরা যখন পরিণত হয়েছি, সেই ভার কিয়দংশে আনন্দচিত্তে গ্রহণ করেছি। চৈত্র-সংক্রান্তিতে আম্মার হাতের পাঁচনের নেপথ্যে থাকতেন আব্বা : বাজারের যত প্রকার বিচিত্র সবজি এবং তার সাথে কাঁচা কাঁঠাল, শিমের বিচি, কাঁঠালের বিচি, সকল প্রকার ডাল, কঁচি বাঁশের কঞ্চি, কলার থোড়, থানকুনি, নাম না জানা আরো কত কি! খাওয়া চলতো চৈত্র-সংক্রান্তি থেকে পহেলা বৈশাখ পর্যন্ত।
শুধু নিজেরা খাব এ হবে না, বাটি ভর্তি করে প্রতিটি প্রতিবেশীর ঘরেও প্রেরণ করা হতো, একা খেয়ে তো আনন্দ নেই। ইলিশ মাছ, তপশে মাছ, লইট্যা শুঁটকি, ফাইস্যা শুঁটকি, চ্যাঁপা শুঁটকি আরো কত কি! এর সাথে দই, মিষ্টি, নাড়–, মোয়া, খৈ, চিড়া- আব্বার তালিকা যেন শেষ হয় না। শবেবরাতের হরেক রকম হালুয়া, সঙ্গে চালের আটার রুটি আর ঝাল ঝাল গরুর মাংস, এ না হলে কি চলে! করেছে।
সময় গড়াল, তখন আমরাই আয়োজন করতাম আমাদের মতো করে আমাদের পাঁচজনের সংসারে। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত এমনকি লকডাউনের সময়ও শেষ বিবাহবার্ষিকী আব্বা একইভাবে তার স্টাইলে পালন করেছেন: কেক কেটে, গান গেয়ে আর আম্মার লাল শাড়িতে। আমার আব্বা সারাজীবন যে রীতিতে চলেছেন, জীবনের যাত্রাও থামিয়েছেন সে রীতিতে : কাউকে না জানিয়ে, না বুঝিয়ে, না ঝামেলায় ফেলে, অনন্ত-অসীম জীবনবোধ নিয়ে নিভৃতে। এই তো আমার ব্যতিক্রমী আব্বা।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়