বিজিএমইএ সভাপতি : বন্ধ মিল চালু হলে ফেব্রিক্সের চাহিদা মেটানো সম্ভব

আগের সংবাদ

খাদ্য নিরাপত্তাই প্রধান চ্যালেঞ্জ : সরকারি হিসাব মতে, দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, তবুও চালসহ খাদ্যপণ্য আমদানি করতে হয়

পরের সংবাদ

আমাদের সহজ শিক্ষক

প্রকাশিত: অক্টোবর ৮, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ৮, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বাংলা বিভাগে অধ্যাপক আহমদ কবির স্যার চার দশক কাজ করেছেন। এর এক দশক জুড়ে ছিলাম আমরা।
আশির দশকের গোড়ায় আমরা যখন বাংলা বিভাগের পড়তে এলাম তখন পেলাম বেশ ক’জন মধ্যবয়সি শিক্ষক। তাদের মধ্যে সবচাইতে অকালে হারিয়ে গেলেন নরেন স্যার। তারপর সাইদুর রহমান ভূঞা স্যার, লুৎফর রহমান স্যার। অবসর ভোগী হয়ে আবু জাফর স্যার দীর্ঘদিন কঠিন ব্যাধিতে ভুগছেন। আবুল কাশেম ফজলুল হক স্যার আর চলতে পারছেন না। এই অতিমারিতে চলে গেলেন আনিসুজ্জামান স্যার।
হারাবার পালায় যোগ হলেন আমাদের প্রিয় আহমদ কবির স্যার। করোনার অতিমারিতে আমাদের ছেড়ে যেত হলো। শেষবারের মতোও প্রিয় স্যারকে দেখতে যেতে পারলাম না।
আহমদ কবির আমাদের সহজ স্যার। আমরা এই সহজ মানুষটির আপন হয়ে ওঠেছিলাম সহজেই। কবির স্যারের অমন শীতল বাকভঙ্গিমা আমাদের কাছে টেনে নিয়েছিল। তারপর সব রকম ভাবনা-দুর্ভাবনা শেয়ার করার ফুসরত করে দিয়েছিলেন আন্তরিক মানুষটি।
অমন না হলে কী আর প্রিয় শিক্ষক হয়ে ওঠা যায়। তো নিজের অজান্তেই কবির স্যার আমার শিক্ষকতা জীবনের আদর্শ হয়ে গেছেন। উচ্চাকাক্সক্ষার পীড়ন নেই। অফুরান ক্ষুধা নেই। বিত্ত খায়েশ নিয়ে হাপিত্যাশ নেই।
একজন শিক্ষক কি বিদ্যা ঢেলে দেবেন? অমন মুক্তির দীক্ষা তো দিয়েছেন। সেটিই তো শিক্ষার্থীর জন্য পরম পাওয়া।
কেবলই পুত্রস্নেহেই পরিত্রাণ নয় ছাত্রকে কতটা ভালোবাসা যায় তার ছবক নির্মোহ কবির স্যারের কাছ থেকেই নিয়েছি। তার একটা ঘটনার উল্লেখ করা যায়। আমি ‘বাংলাদেশে নজরুল চর্চা : প্রসঙ্গ ও পরিপ্রেক্ষিত’ শিরোনামে এমফিল করছিলাম। ড. রাজীব হুমায়ূন স্যারের তত্ত্বাবধানে। কিন্তু ইতোমধ্যে দৈনিক পত্রিকায় যোগ দিয়ে কাজে যারপরনাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। ডিগ্রি দিয়ে কী হবে? গবেষণাপত্র ‘সাপ্তাহিক খবরের কাগজে’ কভার স্টরি হিসেবে ছেপে পরিত্রাণ নিয়েছি। স্যারকে সেসব চেপে গেছি। কিছুকাল পর আমার তত্ত্বাবধায়ক শিক্ষক ছিলেন ড. রাজীব হুমায়ূন ভাষাতত্ত্ব বিভাগে মাইগ্রেট করলেন। হঠাৎ একদিন দুপুর ১টার দিকে পত্রিকা অফিসে ডিপার্টমেন্ট থেকে কবির স্যারের টেলিফোন। ‘আফজাল, আজ তোমার এমফিল ভাইবা, তুমি এলে না কেন?’ আমার মুখে কোনো রা নেই চোখ জলে ভিজে গেল। এ ঘটনাটি মনে এলে আপনিতেই আমার চোখ আজো ভিজে যায়।
তারপর অনেকদিন স্যারের কাছে ধরা দেইনি। ১৯৯২-এর মার্চ মাসে একদিন স্যারের কাছে গিয়ে ধরা দিয়েছি। সে ঘটনা বিপজ্জনক। তখন আমি বাংলাবাজার পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক। ব্যক্তিত্ব পাতা চালু করেছি, সেখানে দেশের বিশিষ্টজনদের পূর্ণপাতা সাক্ষাৎকার ছাপা হতো। আমার বাংলা বিভাগের অনুজ মেহজাবিন খান তখন ‘বাংলাবাজার পত্রিকা’য় আমার সহকর্মী। মেহজাবীনকে নিয়ে বিশিষ্টজনদের মুখোমুখি হই। গোটা দিন বা দুদিনে তিনদিনে একজন ব্যক্তিমানসের ইতিবৃত্ত তোলে আনি। তারপর হুমায়ূন আহমেদ প্রায় আমাদের এক সপ্তাহ খেয়ে ফেললেন। হুমায়ূন আহমেদ তখন থাকতেন হাতিরপুল সেন্ট্রাল রোড মোরের টাওয়ারটাতে। মেহজাবীনের গাড়ি ছিল সেটা সামাল দেয়া গেল কিন্তু সাক্ষাৎকার ছাপা হবার পর মহাবিপদ ‘আদালত অবমাননার মামলা’। সাক্ষাৎকারে হুমায়ূন আহমেদ তার ‘দরজার ওপাশে’ উপন্যাসের প্রসঙ্গ তুলেছিলেন। যেখানে একজন জেল ফেরত মাস্তান তাচ্ছিল্যভঙ্গিতে বলছেন, ‘(অমুক)রা তো ঘুষ খাওয়ার জন্য কাতলা মাছের মতো হা করে থাকে।’ এটা নিয়ে আমাদের চারজনের নামে আদালত অবমাননা মামলা হলো। পহেলা আসামি হুমায়ূন আহমেদ, ২য় আসামি আফজাল রহমান, ৩য় আসামি মেহজাবীন খান, ৪র্থ আসামি সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী। মামলার প্রেক্ষিতে মিডিয়ায় প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে তিনি সেই মাস্তানের বক্তব্য ডিফেন্ড করলেন তো পরদিন আরো একটা মামলা হলো। হুমায়ূন আহমেদ পাগলামি শুরু করলেন গুরুতর বিষয়টি নিয়ে, আমরা তো ভয় পেয়ে গেলাম। আমি আর মেহজাবীন আমরা দুই আসামি উকিল নিলাম ড. রফিকুর রহমানকে। হুমায়ূন আহমেদ নিয়ে গাজীউল হককে। মতিভাই নিলেন ড. কামাল হোসেনকে। সেদিন শাহবাগ আজিজ মার্কেটে ‘উত্থানপর্ব’এ আহমদ ছফা ভাই আরো ভয় ধরিয়ে দিলেন। ভয় পেয়ে সেদিনই মেহজাবীনকে সাথে নিয়ে স্যারের বাসায় গেলাম। ধরা দিলাম আহমদ কবির স্যারের কাছে।
স্যার তো সব শুনে যারপরনাই সিরিয়াস হলেন। সিরিয়াস হলে স্যারের মুখমণ্ডল লাল হয়ে যেত। সেদিন ততোধিক লাল হয়ে গেল। আমি যখন বললাম স্যার, ছফা ভাই বলেছেন হুমায়ূন যদি একদিন কয়েদবাসেরও সুযোগ পায় সেটা সে লুফে নেবে। কেন নেবে জানো। কয়েদখানায় ফ্লোরের এক কোনায় একটা নালা থাকে যেখান দিয়ে কয়েদিরা মূত্র ত্যাগ করে। হুমায়ূন কয়েদখানায় যাবার আগেই বাংলা বাজারের পাবলিশাররা হোমিওপ্যাথির খালি শিশি নিয়ে সেখানে ভিড় জমাবে। কয়েদি হুমায়ূন আহমেদের মূত্র শিশিজাত করে বিক্রি করবে। তার ক্রেতার অভাব হবে এদেশে।’ ছফা ভাইয়ের সে কথায় বাঙালির মনন চর্চার অধোগতির ইশরা আছে সেটা স্যারও বুঝেছেন তবুও তা শুনে আরো পেরেশান হলেন, আবু জাফর স্যারকে ফোন দিলেন। জাফর স্যারের সাথে আমাদের বৃত্তান্ত সংক্ষেপে আলোচনা করে আমাদের নিয়ে বসলেন। বললেন, আহমদ ছফা যা বলেছেন হুমায়ূন সাহেবের অবস্থাটা এখন এ রকমই। আরো নানা রকম পাগলামি করবে কিন্তু তোমরা ওর সাথে জড়িয়ে মহাবিপদে পড়ে গেলে যে। স্যার বেশ ক’বার উঠলেন ভিতরে গেলেন আবার এসে বসলেন। বোধহয় সংকটটার ভেবে কিনারা করতে পারছিলেন না। আমি বেশ ক্ষাণিকটা অসহায় বোধ নিয়ে স্যারের দিকে তাকালাম, মুখমণ্ডল লাল হয় যেন রক্ত ছিটে বের হবে। আরো দু’একজনের সাথে ফোনে পরামর্শ করতে চেয়েছিলেন, ফোনে পাননি কিন্তু পত্রিকার কাজ করে আমাদের কলিজার জোর বেশ কিছুটা বেড়েছে। স্যারকে অভয় দিয়ে সুস্থির করতে পারছিলাম না। তখন বঙ্গভবনে বিচারপতি শাহাবুদ্দিন। স্যার বোধকরি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মহামান্য রাষ্ট্রপতির কোন নিকটাত্মীয়কে খোঁজ করছিলেন। স্যার আমাদের দুজনের বাসার টেলিফোন নাম্বার লিখে নিলেন। মেহজাবীন বলল, ‘স্যারের অবস্থা আপনি খারাপ করে দিয়েছেন, এখন চলেন।’ আমরা ওঠে আসার আগে স্যার বললেন, কখন কি হয় আমাকে জানাবে কিন্তু। আমাদের প্রিয় শিক্ষক সহজ মানুষটিকে প্রবল উৎকণ্ঠায় রেখে সেদিন আমরা বেরিয়ে আসলাম।
তারপর অনেক কিছু ঘটল আমাদের জীবনে। আমরা দুই আসামি জীবন বাঁধলাম ভালোবাসার দৃঢ় বন্ধনে। আমরা শিক্ষকতায় যোগ দিলাম। উচ্চ আদালতের মামলা থেকে অব্যাহতি পেলাম তথাপি নতুন ঝড় এলো। বিপন্নতারা আবার এলো। তিন বছর পর সেই সহজ মানুষ আমাদের কবির স্যারের কাছে এলাম। স্যার বিস্মিত হলে, ব্যথিত হলেন, হিসাব মিলাতে চেষ্টা করলেন। পেরেশান হলেন। অমন করে পেরেশান করতে বারবার গেছি যে প্রিয় শিক্ষকের কাছে, তিনি তো আর তখন শিক্ষক থাকেননি, হয়েছেন পিতা, হয়েছেন পরমাশ্রয়। অমনি করে আজ আমি অনেক শিক্ষার্থীর বিপন্নতায় পাশে দাঁড়াই পিতার মতো।

আমি ময়মনসিংহে থাকি স্যারের কাছে তখন খুব যাওয়ার সুযোগ হতো না। ছোটবোন শায়লা নাসরিন সবসময় লেগে ছিল স্যারের সাথে। গবেষণার কাজও স্যারের সাথেই করেছে। শায়লা (ওর বন্ধুদের শীলা) কিছুদিন আনন্দ মোহন কলেজে আমাদের সাথে কাজ করেছে। পারিবারিক ঘনিষ্ঠতা নিয়েছিল, তখন ওর কাছেই স্যারের খোঁজ পেতাম।
তার প্রায় দশ বছর পর ময়মনসিংহের কোন এক কর্মসূচিতে সৈয়দ আকরম স্যারকে নেয়ার জন্য বিভাগে গেলাম। চেয়ারম্যান অফিসের সামনে কবির স্যারের সাথে দেখা। স্যার হাতে ধরে রুমে নিয়ে গেলেন। সেদিনও সব খোঁজখবর নিলেন সেই অমøান আন্তরিকতা নিয়েই। আমি বললাম স্যার ‘রবীন্দ্র কাব্য : উপমা ও প্রতীক’ বইটার এত সংস্করণ হচ্ছে কোনো একবার দু-চার পাতা নতুন কিছু জুড়ে দিয়ে কিছুটা কলেবর বাড়াতে পারতেন। সেই স্বভাবসুলভ নির্মোহ উত্তর। আর ওসব দিয়ে কি হবে। অমন নির্মোহ মানুষ আমাদের কালে খুব বিরলপ্রজ।
কবির স্যারের আন্তরিকতা, ঔদার্য, পরিমিতিবোধ, শীতল¯িœগ্ধতা, নির্মলতা, নির্মোহতা সাহিত্যের পাঠের চেয়েও জরুরি ছিল আমার কাছে। তাই তো জীবন যাপনে নির্মোহতার শাসন সক্রিয় রাখতে আমি মরমি জীবন ধারায় চলে যেতে পেরেছি।
শিক্ষকতা করে আমিও জীবনের এক প্রান্তে পৌঁছে গেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে যাবার প্রয়োজন আমাদের জীবদ্দশায় ফুরোবে না। জীবনের সংকটও ফুরোবে না। কিন্তু আজ এই ভেবে বিপন্ন বোধ করছি- বাংলা বিভাগে গেলে আমার আর কোনো শিক্ষক কি আছেন ডেকে রুমে নিয়ে যাবেন? ডেকে নিয়ে জানতে চাইবেন আমার বেঁচে থাকা।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়