যুক্তরাষ্ট্রে অগ্নিকাণ্ডে এক বাংলাদেশি কিশোরীর মৃত্যু

আগের সংবাদ

আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের সভা : সিরাজগঞ্জ-৬ আসনে মেরিনা ১০ পৌরসভায়ও প্রার্থী চূড়ান্ত

পরের সংবাদ

যে কারণে সাংসদদের বিরুদ্ধে দুদকের তদন্ত শেষ হয় না

প্রকাশিত: অক্টোবর ৭, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ৭, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

এস এম মিজান : সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, খাস জমি দখল, ঘুষ নেয়া, চাঁদাবাজি, অবৈধ ব্যবসা, অর্থ পাচারসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে দীর্ঘদিন ধরে বর্তমান ও সাবেক মিলিয়ে অন্তত ২২ সংসদ সদস্যের (এমপি) বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধান চলমান রয়েছে। অনেকের বিরুদ্ধে ছয় থেকে সাত বছর ধরেও চলছে অনুসন্ধান। ২২ সাংসদের মধ্যে সরকারি দল আওয়ামী লীগের ১১ জন, জাতীয় পার্টির একজন, বিকল্প ধারার একজন, বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির একজন, অন্যান্য দল ও স্বতন্ত্র থেকে তিন জন এবং বিএনপির পাঁচ জন রয়েছেন। দুই-একজনের বিরুদ্ধে মামলা হলেও চার্জশিট জমা না দেয়ায় তা বিচার পর্যন্ত গড়ায়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুদক স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না বলেই সাংসদদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হলেও শেষ হওয়ার খবর পাওয়া যায় না। তবে এ ধরনের অভিযোগ মানতে নারাজ দুদকের শীর্ষ কর্তারা।
ঠিক দুই বছর আগে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে সারাদেশে ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান শুরু হলে সে সময় কয়েকজন সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধেও জুয়া সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ওঠে। দুদক তখন চিহ্নিত শতাধিক ক্যাসিনো হোতার পাশাপাশি ৫০ জন সাবেক ও বর্তমান সংসদ সদস্যের বিষয়েও তথ্য সংগ্রহে মাঠে নামে। এ ছাড়া সাবেক কয়েকজন এমপির বিরুদ্ধেও তদন্ত শুরু হয়েছিল অন্তত তিন বছর আগে থেকে। এর আগে সমসাময়িক আরো অনেকের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হলেও সেগুলোর বেশ কিছু অভিযোগ চাপা পড়ে গেছে বা পরিসমাপ্তি করে ফেলেছে। বর্তমানে ২২ জনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের তথ্য পায় সংস্থাটি। এর মধ্যে সাত জনের বিদেশে থাকা সম্পদের তথ্যও আসে দুদকের হাতে। আওয়ামী লীগের তিন এমপির বিদেশ গমনেও রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। দুদকের পক্ষ থেকে অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ অথবা সম্পদের তথ্য জমা দেয়ার নোটিসও দেয়া হয়।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক

দুদকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, এখন পর্যন্ত বর্তমান ও সাবেক মিলিয়ে যেসব সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলমান রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থায় যাবে দুদক। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, অধিকাংশের বিরুদ্ধেই এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যপ্রমাণ অনুসারে মামলা হতে পারে। তবে কোভিড সংক্রমণের কারণে গত দেড় বছর যাবৎ অনুসন্ধান ও তদন্তকাজ এগিয়ে নেয়া কঠিন ছিল। তারপরও আমরা বসে নেই। মানুষের প্রত্যাশা পূরণে চেষ্টা করে যাচ্ছি।
জানা যায়, অনুসন্ধানাধীন থাকা সংসদ সদস্যদের মধ্যে ১১ জন বর্তমান এবং ১১ জন সাবেক সংসদ সদস্য। এর মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ১১ জন, বিএনপির পাঁচ জন এবং অন্যান্য দল ও স্বতন্ত্র থেকে ছয় জন এমপি রয়েছেন। তাদের যোগ্যতা, দক্ষতা ও সর্বোপরি ভালো চরিত্র জেনে মনোনয়ন দিয়েছিল রাজনৈতিক দলগুলো। মনোনয়ন পেয়ে ভোটে জয়লাভ করে সাংসদও নির্বাচিত হয়েছেন। এরপরই তারা আখের গোছাতে শুরু করেন। সরকারি-বেসরকারি মিলে সবকটি খাত থেকেই ভাগবাটোয়ারা নিতে থাকেন। অর্থ পাচার করে বিদেশে বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্যে বিনিয়োগ করেন। যা বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট ও দুদকের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।
দুদক সূত্র জানায়, শুধু সাংসদই নয়, তাদের পরিবারের সদস্য এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে আত্মীয়স্বজনের বিরুদ্ধেও অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এসব কারণে এমপিদের আত্মীয়স্বজনের বিরুদ্ধেও অনুসন্ধানের পাশাপাশি নজরদারি বাড়িয়েছে দুদকের গোয়েন্দা ইউনিট। সাংসদদের অনিয়ম দুর্নীতির বিষয়ে অনুসন্ধানকাজে সংশ্লিষ্ট দুদক কর্মকর্তারা বলছেন, দুদক কার্যালয়ে জমা দেয়া সংসদ সদস্য ও তাদের স্ত্রী-সন্তানদের সম্পদ বিবরণী এবং অনুসন্ধানী কর্মকর্তাদের পাওয়া তথ্যে গরমিল থাকার পাশাপাশি দুর্নীতি, অনিয়ম ও অবৈধ সম্পদের তথ্যউপাত্ত পাওয়া গেছে। এ ছাড়া তাদের বিরুদ্ধে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, খাসজমি ইজারায় দুর্নীতি, সার ডিলার নিয়োগে অনিয়ম, স্কুল-কলেজে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়মসহ অন্তত ১৫/২০ ধরনের অনিয়ম দুর্নীতির তদন্ত হচ্ছে। অনুসন্ধান শেষে খুব শিগগিরই ওই সব সাংসদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবে কমিশন।
যাদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে অনুসন্ধান চলছে তারা হলেন- সুনামগঞ্জ-১ আসনের মোয়াজ্জেম হোসেন রতন, ভোলা-৩ আসনের নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন, চট্টগ্রাম-১২ আসনের সামশুল হক চৌধুরী, নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের নজরুল ইসলাম বাবু, বরিশাল-৪ আসনের সংসদ সদস্য পঙ্কজ দেবনাথ, রাজশাহী-১ আসনের ওমর ফারুক চৌধুরী, মুন্সীগঞ্জ-১ আসনের মাহী বি চৌধুরী, ভোলা-৪ আসনের আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব, ঢাকা-৭ আসনের সাংসদ হাজী সেলিম, ল²ীপুর-৪ কাজী সহীদ ইসলাম পাপুল ও তার স্ত্রী সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদ সেলিমা ইসলাম। এর মধ্যে সর্বশেষ দুজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও শরীয়তপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য বিএম মোজাম্মেল হক, নরসিংদী-২ আসনের সাবেক স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য কামরুল আশরাফ খান পোটন, যুবলীগ নেতা ও নরসিংদী-৩ আসনের সাবেক স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য সিরাজুল ইসলাম মোল্লা, আওয়ামী লীগ নেতা চাঁদপুর-৪ আসনের সাবেক এমপি শামসুল হক ভূঁইয়া ও পিরোজপুর-১ আসনের এ কে এম এ আউয়াল। এর মধ্যে সর্বশেষ জনের বিরুদ্ধে পৃথক পাঁচটি মামলা করে দুদক। বিএনপি নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন নাটোর-২ আসনের রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, লালমনিরহাট-৩ আসনের আসাদুল হাবিব দুলু, নোয়াখালী-৪ আসনের মো. শাহজাহান, বগুড়া-৩ আসনের আব্দুল মোমিন তালুকদার ও ঝিনাইদহ-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মো. শহিদুজ্জামান ইসলাম বেল্টু। এ ছাড়া জাতীয় পার্টির সাবেক মহাসচিব ও পটুয়াখালী-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করছে দুদক।
এ বিষয়ে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আইন অনুযায়ী দুদকের অনেক ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু দুদক সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করছে বলে মনে করি না। দুদক নিজের মতো করে এক ধরনের সীমারেখা অঙ্কন করে নিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেই সীমারেখার বাইরে তারা যেতে চায় না। এর বাইরে গেলে তাদের হাত পুড়ে যাবে, এরকম মানসিকতা বিরাজ করছে। এ কারণে এমপিদের সম্পদ অনুসন্ধানে দুদকের মাঠে নামাটা লোক দেখানো বলেই মানুষ মনে করে। এক প্রশ্নের জবাবে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এমপিদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান তদন্তের উদ্যোগ মানুষের মধ্যে আশার সঞ্চার করে সত্য, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধি বা রাজনৈতিক প্রভাবশালী মহলের কারো ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পেরেছে, এরকম দৃষ্টান্ত বিরল। এগুলো অনেকটা লোক দেখানো বিষয়ে পরিণত হয়েছে। দুদকের ওপর মানুষের প্রত্যাশা ও চাপ আছে, সেই জায়গা থেকে দুদক কিছুটা আনুষ্ঠানিকতার মতো অনুসন্ধান বা একটা প্রক্রিয়া শুরু করে, বাস্তবে বেশি দূর যায় না। এ কারণে একদিক থেকে মানুষের মধ্যে হতাশার সঞ্চার করে। অন্যদিক দিয়ে দুদকের প্রতি মানুষের আস্থার সংকটকে আরো ঘনীভূত করে।
এদিকে দুদক কমিশনার মো. জহুরুল হক দাবি করেছেন, তারা কারো মুখ দেখে অনুসন্ধান চালান না কিংবা কারো কথায় পাত্তাও দেন না। তিনি বলেন, কোনো অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে ব্যক্তির পেশাগত, সামাজিক বা অন্য কোনো পরিচয় কমিশনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। রাজনৈতিক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে কোনো বাধা আছে কিনা- এ প্রশ্নের জবাবে দুদকের এই কমিশনার বলেন, এগুলো গতানুগতিক কথা। টিআইবি সবসময় এসব কথা বলে, আমরা কারো কথায় পাত্তা দেই না। আমরা আমাদের মতো আইন অনুযায়ী কাজ করি। সাংসদদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শেষ করায় দেরির বিষয়ে তিনি বলেন, এখন খুব বেশি দেরি হচ্ছে না। আগের চেয়ে এখন অনুসন্ধান-তদন্তের গতি বেড়েছে। আগে বছরের পর বছর থাকত, এখন মাসকে মাস থাকে। যার কারণ হলো, প্রায় সাত হাজারের মতো মামলা এখানে আছে। এত মামলা তদন্ত করার মতো যতটুকু সাপোর্ট থাকা দরকার তা নেই। লোকবলের খুবই অভাব। বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, যেখানে লোকের দরকার, সেখানে নেই। যেখানে লোকের দরকার নেই, সেখানে বেশি আছে। এ সমস্যা আমাদের দেশে আছে। এ ছাড়া আমাদের লোকদেরও (দুদক কর্মকর্তা) কিছু গাফিলতি বিভিন্ন সময় ছিল। বর্তমানে আমরা এসব সমস্যা অনেকখানি কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। এ ছাড়া আগে বছরে দুই-চারটা মিটিং হতো। এখন আমরা প্রতি মঙ্গলবার মিটিং করছি। যেসব সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলছে, আশা করছি, কমিশনের দেয়া নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে অনুসন্ধান শেষ করে কর্মকর্তারা প্রতিবেদন দিতে পারবেন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়