বাংলাদেশকে জমি লিজ দিতে চায় আফ্রিকা

আগের সংবাদ

যে কারণে সাংসদদের বিরুদ্ধে দুদকের তদন্ত শেষ হয় না

পরের সংবাদ

সঞ্চয়পত্রে মুনাফার পরিবর্তন যেভাবে করা যেত

প্রকাশিত: অক্টোবর ৬, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ৬, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সরকার সম্প্রতি সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার কমিয়েছে। এর আগে ২০১৫ সালেও এই হার কমানো হয়েছিল। ২০১৯ সালে মুনাফার হার না কমালেও উৎসে করের হার ৫ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ করায় উপকারভোগীর প্রকৃত সুবিধা কমে গিয়েছিল। অর্থাৎ সঞ্চয়পত্রের সুবিধা ক্রমাগত কমছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ কর্তৃক জারিকৃত গত ২১ সেপ্টেম্বরের প্রজ্ঞাপনে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগের সুবিধা অব্যাহত রেখে ধাপ অনুযায়ী মুনাফার হার কমানো হয়েছে। ১৫ লাখ টাকার বেশি ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত মুনাফা কমবে ১ শতাংশ হারে, আবার ৩০ লাখ টাকার ঊর্ধ্বে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মুনাফা কমবে ২ শতাংশ হারে। প্রজ্ঞাপন জারির পর যারা সঞ্চয়পত্র ক্রয় করবেন তাদের বেলায় এই হ্রাসমান হার কার্যকর হবে। পুরনো সঞ্চয়পত্রের মালিকরা মেয়াদ শেষে পুনরায় বিনিয়োগ করতে গেলে তাদের ক্ষেত্রে নতুন হার প্রযোজ্য হবে। সরকারের সুদ বাবদ ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বলে জানানো হচ্ছে। অন্য আরেকটি কারণ হয়তো উহ্য আছে। সরকারের কঠোর পদক্ষেপের কারণে দেশের ব্যাংকগুলো তাদের ঋণদান কর্মসূচির সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনতে বাধ্য হয়েছে, যা করতে গিয়ে তারা আমানতের সুদহারও ব্যাপক কমিয়েছে। ভারসাম্য আনার জন্য তাদের পক্ষ থেকেও দাবি উঠেছিল সঞ্চয়পত্রে লাভের মাত্রা কমিয়ে আনার। এমন দাবি অবশ্য ব্যাংকের তরফ থেকে নতুন কিছু নয়, ব্যাংকের চেয়ে সঞ্চয়পত্রের মুনাফা বেশি থাকত বলে বরাবরই তারা সামঞ্জস্য বিধানের কথা বলে আসছে। অথচ আমানতের অভাবে কোনো ব্যাংক দেউলিয়া হয়েছে এমন নজির বাংলাদেশে নেই, দেউলিয়া হয়েছে আর্থিক কেলেঙ্কারি ও খারাপ ঋণের কারণে।
সঞ্চয়পত্র নিয়ে কথা বলতে গেলে একটা প্রশ্ন অবশ্য সামনে আসে। প্রশ্নটি হলো দেশের কত শতাংশ লোক এর সুবিধাভোগী? স্বীকার করতেই হবে সংখ্যায় তারা অতি নগণ্য, মোট জনসংখ্যার বিচারে শতাংশের ভগ্নাংশ হবে হয়তো। সমাজের খুব অসহায় শ্রেণির মানুষ না হলেও উপকারভোগীর গরিষ্ঠ অংশ বর্তমানে বয়োবৃদ্ধ-উপায়হীন, অবসরভোগী কিংবা উপার্জনহীন। সঞ্চিত কিছু টাকা সঞ্চয়পত্রে খাটিয়ে সংসারের ব্যয় নির্বাহ করেন, চিকিৎসার খরচ মেটান, পারিবারিক দায়িত্ব সারেন। এর বাইরে বিত্তবান কিছু মানুষও আছেন যারা এই খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী। তবে সীমারেখা দেয়া থাকার কারণে সুবিধার যথেচ্চ ব্যবহার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও করতে পারছেন না। পূর্বে নামে-বেনামে বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন উপায়ে সঞ্চয়পত্র ক্রয়ের সুযোগ থাকলেও এখন আর এমনটি করা সম্ভবপর হচ্ছে না কম্পিউটারায়ন করে কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণের কারণে। সীমার মধ্যে থাকতে হচ্ছে সবাইকে, নয়ছয় করার সুযোগ থাকছে না। বর্তমানে উপায়হীন ও সীমিত আয়ের মানুষের বিনিয়োগের নির্ভরযোগ্য উৎস হলো সঞ্চয়পত্র। তাদের হায় হায় কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে প্রতারণার শিকার হতে হচ্ছে না, কিংবা যেতে হচ্ছে না অনিশ্চিত শেয়ারবাজারেও। ক্রেতাদের বড় অংশ বয়োবৃদ্ধ, অবসরজীবী, বিধবা, গৃহবধূ অথবা এ ধরনের কেউ। এরা বড়জোর নিম্ন-মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত শ্রেণির। কর্মসূচিটিকে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের অংশ হিসেবে দেখা সঙ্গত হবে।
বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্রের ভেতর তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র, পেনশনার সঞ্চয়পত্র ও পরিবার সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকরা প্রাত্যহিক ব্যয় নির্বাহের জন্য স্কিমগুলোর মুনাফার ওপর নির্ভরশীল ধরে নেয়া যায়। ব্যতিক্রম হতে পারে পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র। এর গ্রাহকরা যেহেতু মুনাফার জন্য পাঁচ বছর অপেক্ষার সামর্থ্য রাখেন, সেহেতু ধরে নেয়া যায় যে তারা আর্থিকভাবে তুলনামূলকভাবে সফল। কাজেই বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকরা মুনাফা হ্রাসের অভিঘাত কিছুটা হয়তো সয়ে নিতে পারবেন; কিন্তু বাকিদের সওয়া কষ্টকর হবে। সুদের হার হ্রাসের প্রজ্ঞাপনে এ রকম ভিন্ন বাস্তবতা বিবেচনায় নেয়া হয়নি, যা পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। অন্তত তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র, পেনশনার সঞ্চয়পত্র ও পরিবার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার পূর্ববৎ রাখা যেতে পারে। প্রকৃতপক্ষে মুনাফা পরোক্ষ উপায়ে কমে গেছে আগেই। জীবনযাত্রায় এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে ব্যয় বাড়েনি। এমন প্রেক্ষাপটে উপায়হীন এই মানুষদের আয় কমানো মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হবে। করোনার অভিঘাতে গরিব মানুষের মতো এই শ্রেণিভুক্ত মানুষরাও দুর্বল হয়েছে, তারা দুর্বল হবে নতুন সিদ্ধান্তে।
সূত্রোক্ত প্রজ্ঞাপনে ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ডেরও মুনাফার হার কমানো হয়েছে। পুরনোরা পূর্বের হারই পাবেন, নতুন যারা এই বন্ড কিনবেন তারা মুনাফা পাবেন সঞ্চয়পত্রের মতোই হ্রাসকৃত হারে। বিদেশে যারা কাজ করেন কেবল তাদের জন্য এই বন্ড। নতুন নেয়া সিদ্ধান্তে বৈপরীত্য আছে। সরকার বিদেশে অবস্থানরতদের রেমিট্যান্সের ওপর ২ শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে, তাতে রেমিট্যান্সের পাল্লা ভারী হচ্ছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ডও প্রবাসীদের রেমিট্যান্সের অর্থ। এক্ষেত্রে মুনাফা কমানোর সিদ্ধান্ত দ্বিমুখী আচরণের শামিল। নীতিনির্ধারকদের মনে রাখা দরকার, প্রবাসীরা প্রবাস থেকে ফিরে আয়বর্ধক কিছু একটা করতে গিয়ে হিমশিম খান। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা সফল হন না। এই বন্ডই তাদের প্রধান ভরসা হয়ে ওঠে। এতে হাত দেয়া সঙ্গত কিনা পুনর্বার ভেবে দেখা উচিত।
সঞ্চয়পত্র ও বন্ডের ক্রেতারা দলে ভারি নন। তাদের কণ্ঠ ক্ষীণ। অর্থনীতিবিদদের একাংশ, বিশেষত যারা বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ প্রভৃতি আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন- তারা সঞ্চয়পত্রের উচ্চ হারতো বটেই, সব ধরনের ভর্তুকির বিরুদ্ধে। তাদের মতামত উপেক্ষা করে সরকার কৃষিসহ বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি দিয়ে সুফল পাচ্ছে। দুর্বল এই বিনিয়োগকারীদের পক্ষে যদি দঁাঁড়াতে হয় তো দাঁড়াতে হবে সরকারকেই। সরকার স্বপ্রণোদিত হয়ে কিছু কাজ ইতোমধ্যে করেছেও। এর একটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত হলো সরকারি কর্মচারীদের ভেতর যারা পেনশন বিক্রি করে দিয়েছিলেন তাদের ১৫ বছর পর নতুন করে পেনশন দেয়া। এই সময়সীমা কমানোর দাবি উঠেছে, যা যুক্তিসঙ্গত কারণেই সরকারের বিবেচনায় আছে বলে শোনা যাচ্ছে। ধীরে ধীরে দেশের সব বয়স্ক মানুষ পেনশনের আওতায় আসুক কিংবা সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতাভুক্ত হোক এ দাবি সবার। সঞ্চয়পত্রে প্রথমবারের মতো সরকার স্তরভিত্তিক বিভাজন নীতি অনুসরণ করে মুনাফার মাত্রা নির্ধারণ করেছে। নিম্নতর স্তর ১৫ লাখ টাকা, যেখানে মুনাফার হার পূর্বের মতো রাখা হয়েছে। বলা হচ্ছে এর ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। এ ধারণা ঠিক নয়। ১৫ লাখ টাকায় যে পরিমাণ মুনাফা আসে তা দিয়ে কোনোমতেই সংসারের ব্যয়ভার মেটানো সম্ভব হবে না। তাছাড়া সিনিয়র সিটিজেন বা প্রবীণদের জন্য আলাদা করে সুবিধার কথা বলা হয়নি। প্রবীণদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুবিধা প্রদানের দাবি এখন জোরালো। সঞ্চয়পত্রে প্রবীণদের বিশেষ সুবিধা দেয়া হোক, এমনটাই প্রত্যাশিত।
মজিবর রহমান : কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়