বাংলাদেশকে জমি লিজ দিতে চায় আফ্রিকা

আগের সংবাদ

যে কারণে সাংসদদের বিরুদ্ধে দুদকের তদন্ত শেষ হয় না

পরের সংবাদ

দুর্গা মায়ের গহনা চুরির রহস্য কল্যাণী সেন

প্রকাশিত: অক্টোবর ৬, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ৬, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ভোর পাঁচটা না বাজতেই মা সবাইকে ঘুম থেকে তুলে দিল। আমার মনে হলো এইতো মাত্র ঘুমালাম। এখনই উঠব কেন? ভাবতে ভাবতেই আমি আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। হঠাৎ ঘুমচোখেই আমি হুড়মুড়িয়ে উঠে বসলাম বিকট একটা শব্দ শুনে। তাকিয়ে দেখি তমা এলার্ম ঘড়ি হাতে দাঁড়িয়ে আছে আর সেটা ক্রমাগত বেজেই যাচ্ছে। কটমট করে আমার দিকে তাকিয়ে সে বলল, তাড়াতাড়ি উঠে পড়, মা রেগে যাবেন। বাধ্য হয়ে উঠতেই হলো।
আমি তপু। ক্লাস নাইনে পড়ি। তমা আমার যমজ বোন। তিন মিনিট আগে জন্মানোর জন্য সে সবসময় দিদির অধিকার দাবি করে। আজ আমরা নয় সদস্যের একটি টিম মামা বাড়ি যাচ্ছি। সকাল ৮টায় ট্রেন। তারই তোড়জোড় চলছে। কাল থেকে দুর্গাপূজা শুরু। পূজার এই পাঁচটা দিন আমাদের কাছে বছরের শ্রেষ্ঠ সময়। এই সময়ে আমরা সব ভাইবোনরা একত্রিত হই। মায়েরা তিন বোন, দুই ভাই। বড়মাসির দুই মেয়ে বানী আর রিনিদি। রিনিদি সবার বড়। ছোট মাসির দুই ছেলে হর্ষ আর চর্যা। ওরা এত দুষ্টু আর চঞ্চল যে আমরা ডাকি হইচই। আমার দুই মামা এখনো বিয়ে করেননি। তারা দাদু-দিম্মার সঙ্গেই থাকেন।
মা আর দুই মাসি তাদের দুটি করে ছানা-পোনা নিয়ে পূজা করতে বাপের বাড়ি রওনা হলেন। অফিসের কারণে বাবা এবং দুই মেসো দুদিন পরে যাবেন। ছোট মামা গাড়ি নিয়ে আসে স্টেশন থেকে আমাদের নিয়ে যেতে। উবার ডেকে মা-মাসিদের উঠিয়ে দেয় আর আমরা ছয় ভাইবোন চাপাচাপি করে মামার গাড়িতে উঠে বসি।
দাদুর বাড়িটা পুরনো আমলের জমিদার বাড়ির মতই বিশাল। আমার বড়বাবা মানে দাদুর বাবা খুব শৌখিন লোক ছিলেন। শুনেছি তিনি এক জমিদারের কাছ থেকে এই দোতলা বাড়িটা কিনে নেন। সেই সময় থেকে এই বাড়ির উঠানে বড় করে দুর্গাপূজা হয়। আমার কাছে বাড়ির ছাদটা সবচেয়ে বেশি প্রিয়।
বাড়িতে পা দিতেই একটা পুজো পুজো গন্ধ পাওয়া গেল। কেউ নারু বানাচ্ছে, কেউ মোয়া, কেউবা দুধের সন্দেশ। মানসীপিসিকে দেখলাম এককোণে বসে নারকেল কোড়াচ্ছে। পিসি কথা বলতে পারে না; কিন্তু কানে শুনতে পান। কথা বলতে গেলে পিসির গলা দিয়ে কেমন একটা গোঙানির মতো শব্দ বের হয়। এর আগেও পিসিকে দেখেছি। বড্ড অভাবী। তাই পূজার সময় এ বাড়িতে কাজ করতে আসে। আমি নারকেলের ফুল খেতে ভালোবাসি বলে আমাকে দেখলেই ডেকে নারকেলের ফুল ধরিয়ে দিত। দিম্মাকে দেখলাম ঘুরে ঘুরে কাকে কী করতে হবে দেখিয়ে দিচ্ছেন। আমি অবাক হয়ে দেখি, এখনো দিম্মা সেইরকম শক্ত-সমর্থ রয়েছেন।
এই পাঁচদিন মায়েরা আমাদের খোঁজ-খবর তেমন রাখেন না। পড়ালেখার কথাও কেউ বলেন না। রিনিদি সারাদিন গল্পের বই নিয়েই থাকেন। আর আমরা নিজেদের মতো আনন্দ করে সময় কাটাই। সন্ধ্যার দিকে ছাদে বসে ছোটমামার গিটারটা নিয়ে আমরা গান-বাজনা করছিলাম। বাড়ির পেছনে একটা বড় পুকুর আর ঘন গাছগাছালি ছাড়া কাছাকাছির মধ্যে তেমন কোনো বাড়ি নেই। তাই এই বাড়িটা ছাড়া আশপাশটা বেশ অন্ধকার। একটু বাদে নিচে শোরগোল শুরু হলো। বিয়ে বাড়িতে বর এলে যেমন হয় তেমন। কারণ দুর্গা ঠাকুর এসে গেছে। বানী তমা, হই-চইকে নিয়ে নিচে নেমে গেল। শুধু আমি নামতে গিয়েও নামতে পারলাম না। কারণ আমার চোখ আটকে গেছে পুকুর পাড়ের অন্ধকার ঝোপের মধ্যে।
মাথায় একটা টোকা পড়তেই ঘুরে তাকিয়ে দেখলাম রিনিদি দাঁড়িয়ে আছেন।
কিরে সবাই নিচে ঠাকুর দেখতে গেল তুই গেলি না যে?
রিনিদি দেখো ওই অন্ধকার ঝোপের আড়ালে কেউ আছে মনে হচ্ছে না?
ঝোপঝাড়ে তো সাপ বেজি কত কিছুই থাকতে পারে। চল নিচে যাই। ঠাকুর দেখে আসি।
দুর্গা মায়ের গায়ে দিম্মার শাশুড়ির আমলে গড়া দশভরি সোনার গহনা পরানো হয়। রাতেই সেগুলো পরিয়ে দেয়া হলো। অন্য সময় গহনাগুলো ব্যাংকে জমা থাকে। এই পাঁচদিন থাকে দুর্গার গায়ে। তাই নিরাপত্তার জন্য উঠানে তিনটা সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। ব্যাপারটা নতুন বলে বাচ্চারা সারাদিন ক্যামেরার সামনে নাচানাচি করে। পুজো বাড়িতে কত রকমের লোকজন আসছে যাচ্ছে তার হিসাব নেই। সময় পেলেই আমরা মনিটরের সামনে দাঁড়িয়ে এসব লক্ষ্য করি। ক্যামেরায় মানসীপিসিকেও কয়েকবার দেখা গেল।
সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে পূজার প্রথম দিন শুরু হবে। ভোরের আলো তখনও ফুটেনি। দিম্মা উঠে পড়েছেন উঠান ঝাড়ু দেবেন বলে। দুর্গা মায়ের দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠলেন। মায়ের গায়ে একটা গহনাও নেই এবং যথারীতি সদর দরজা খোলা। মুহূর্তেই পুরো বাড়িতে সাড়া পড়ে গেল। সবার আগে সিসিটিভি ক্যামেরা চেক করা হলো। সেখানে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে ঘোমটা জড়ানো কলাবউয়ের শাড়িটা সরিয়ে ৮-১০ বছরের একটা ছেলে বেরিয়ে এলো। সে হাতে একটা পিচকারী নিয়ে এগিয়ে এসে ক্যামেরার দিকে তাক করে কালো রঙ ছুড়ে দিল। তিন জায়গার তিনটা ক্যামেরাই কালো রঙে ঢেকে গেল। ছেলেটার মুখটাও এমন কালি মাখা যে, চেহারাটা বোঝা গেল না। এরপর আর ক্যামেরায় কিছু ধরা পড়েনি। রেকর্ডটা আরও খানিকটা পেছানোর পর সবাই স্তম্ভিত হয়ে গেল। দেখা যাচ্ছে মানসীপিসি ছেলেটাকে কলাবউয়ের শাড়ি দিয়ে পেঁচিয়ে দিচ্ছে। দিম্মা সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠলেন, চিনেছি এটা মানসীর ছেলে কানাই।
মানসীপিসিকে ধরে এনে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে। তাকে পুলিশের ভয়ও দেখানো হলো। পিসি সমানে কেঁদেই যাচ্ছে। হাত নেড়ে গোঙানির মতো শব্দ করে সবার হাতে পায়ে ধরে বোঝানোর চেষ্টা করছে তার ছেলে কোথায় সে জানে না।
মানসীপিসির দুই দেবর আছে। তারা মানুষ ভালো না। দুবার জেল খেটে এসেছে। কানাইকে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়েছিল তারা। বলেছিল তাদেরকে বাড়িতে ঢোকার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। পিসি গহনা চুরির প্ল্যান জানত না। সে ছেলেকে বাঁচানোর কথাই শুধু ভেবেছে। তাই কথামতো ছেলেকে কলাবউ সাজিয়ে দিয়েছিল। ছেলেরও কাজ ছিল ক্যামেরাগুলো নষ্ট করে তাদের বাড়িতে ঢোকার ব্যবস্থা করা। রাত ১০টার পরে ঘরের মানুষ ছাড়া বাইরের কারো থাকার সুযোগ নেই বলে পিসিকেও বাড়ি চলে যেতে হয়। কিন্তু সারারাতেও কানাই বাড়ি ফেরেনি।
হঠাৎ কিছু একটা বুঝতে পেরে আমি আর রিনিদি ছাদে চলে গেলাম। অন্ধকারে ভালো দেখা যাচ্ছে না ঠিকই; কিন্তু পুকুরের জল খুব নড়ছে বোঝা যাচ্ছে। শব্দ হলে যদি ওরা সতর্ক হয়ে যায় তাই রিনিদি সাবধানে মোবাইলে ভিডিও করে নিল। তারপর নিচে গিয়ে মামাদের দেখাল। মামারা ছুটল পুকুর পাড়ের দিকে।
পুকুরে জাল ফেলা হয়েছে এবং কিছু খোঁজা হচ্ছে। কানাইকে তারা বেঁধে রেখেছিল। মামাদের আসতে দেখে লোক দুটো হ্যাচকা টানে কানাইকে দাঁড় করিয়ে তার গলায় একটা ধারালো খুড় ধরল। মামারা খুব সাবধানে ওদের বোঝাতে বোঝাতে আগাতে লাগল। তখন এমন একটা কাণ্ড হলো আমরা সবাই স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। মানসীপিসি মা দুর্গার ত্রিশূল হাতে ছুটে আসছে। তার গলা দিয়ে তীব্রস্বরে গোঙানির আওয়াজ আসছে। লোকদুটো ভয়ে কানাইকে ছেড়ে পালাতে গেল। ততক্ষণে পিসি একজনের পায়ে ত্রিশূল বিঁধিয়ে দিয়েছে। অন্যজনও বেশিদূর যেতে পারেনি। ত্রিশূলের আঘাতে তার হাত থেকে ঝরঝর করে রক্ত পড়ছে।
কানাইয়ের থেকে জানা গেল সে ক্যামেরাগুলো বিকল করার পর দরজা খুলে দিয়েছিল। ওরা খুব পাকা হাতে কয়েক মিনিটেই গহনাগুলো একটা ব্যাগে ভরে নেয়। তারপর ওর মুখ-হাত বেঁধে পুকুর পাড়ে নিয়ে আসে। ওদের কথাবার্তায় কানাই বুঝতে পারে সে যেহেতু সবকিছু জানে তাই তাকে মেরে পুকুরে ফেলে রেখে যাবে। কানাই চকিতে ব্যাগটা টেনে নিয়ে ছুড়ে পুকুরে ফেলে দেয়। কানাইকে সেজন্য মারধর করে ঠিকই কিন্তু গহনা খোঁজাতেই বেশি মনোযোগ দেয়।
জাল ফেলে পুকুর থেকে গহনা উদ্ধার করা হয়েছে। এত বছরের ঐতিহ্যবাহী পূজা ভণ্ডল হয়নি। বাকি দিনগুলো আনন্দেই কেটে গেল। কাল সবাই যার যার বাড়ি ফিরে যাবে। এমন আনন্দের দিন ফিরে পেতে আরো এক বছর অপেক্ষা করতে হবে সবাইকে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়