গঙ্গা-যমুনা নাট্য ও সাংস্কৃতিক উৎসব : শিল্পকলায় দ্বিতীয় দিনে ছিল দর্শকদের উপচে পড়া ভিড়

আগের সংবাদ

জাতিসংঘ থেকে ফিরে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা : রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন না হওয়ার নেপথ্যে আন্তর্জাতিক নিষ্ক্রিয়তা

পরের সংবাদ

বেলকনি

প্রকাশিত: অক্টোবর ৪, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ৪, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ঘড়িতে রাত ৩টা বেজে উনিশ মিনিট। দোতলার বেলকনিতে বসা আমি। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় আলোকিত রাস্তা। কিছু সময় বাদে বাঁশিতে ফুঁ দিতে দিতে হেঁটে চলছে নৈশপ্রহরী। পিকিউলার ড্রেস। বালুভর্তি ট্রাক থেকে বালু ফেলছে তিনজন মানুষ। দিনে ট্রাক ঢুকতে দেয়া হয়না বিধায় রাতে আসে বালু-ইট। বিআরটিসি কোয়ার্টারের ভেতরে পুকুর ভরাট চলছে। বিআরটিসির স্টাফ কোয়ার্টারের মসজিদের স্টিলের গেটটা জ্বলজ্বল করছে আলোয়। আমি এই মসজিদেই নামাজ পড়ি।
পাশের বিল্ডিংয়ের আলোগুলো নিভে যাচ্ছে এক এক করে। আজ শুক্রবার। অফিসের প্যারা নেই। রাত জেগে মনের খায়েশ মেটানোর সুবর্ণ সুযোগ আজ। চাকরিজীবীদের কাছে প্রতিটি শুক্রবার আসে ঈদ হয়ে।
খানেক বাদেই আকাশ ফাটা আওয়াজে একটার পর একটা বিমান উড়ছে আকাশে। অজানা অচেনা নানান দেশে পাড়ি জমাচ্ছে শত শত মানুষ।
নিজের পোশাকের ওপর ডানাকাটা একটা পোশাক পরে ঝাড়ু হাতে পিচঢালা রাস্তায় পা ঘষে ঢুলতে ঢুলতে যাচ্ছে নগরের মহিলা পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা। মধ্যবয়সী থেকে বৃদ্ধ মহিলারাও আছে এ দলে। বুকের মানিকের মুখে দু’মুঠো ভাত জোগাতেই এই ছুটে চলা। বেশির ভাগই বস্তি পাড়ার মানুষ। কারো স্বামী পঙ্গুত্বের শিকার। কাউকে স্বামী ছেড়ে চলে গেছে।
হলুদ বর্ণের সেফটি হেলমেট হাতে সিগারেট টানতে টানতে ফিরছে এয়ারপোর্টের নাইট শিফটে কাজ করা শ্রমিকরা। ক্লান্তি তাদের ছিঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছে সেটা তাদের হাঁটার ধরনে সুস্পষ্ট।
আমার খারাপ লাগাকে ভালো লাগায় রূপান্তর করতে এই বেলকনিটা একটা এন্টিবায়োটিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। মনের কষ্টগুলোকে আকাশের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে এর থেকে ভালো জায়গা আর এই শহরের কোথাও নেই। এই শহরে আমার মতো হাজারও নির্ঘুম মানুষের নিস্তব্ধ রাজ্য এই বেলকনি। এই শহরে রাত আসে দিন হয়ে। দিন আসে ব্যস্ততা নিয়ে। হাজারো ব্যস্ততা। পেটের দায়ে এই শহরের প্রতিটি মানুষ ধান্দাবাজ। আমিও সেই ধান্দাবাজের দলে। সকাল হয় যন্ত্রণা নিয়ে। এলার্ম কেটে দিয়ে এক লাফে বিছানা থেকে ওয়াশরুমে। ঝর্ণা ছেড়ে গা ভিজিয়ে শার্ট পরে প্যান্টের চেইন বেল্ট লাগাতে লাগাতে দৌড় শুরু হয় উপরমুখী। প্রাণভরে গোসল করা হয় না যে কত দিন!
দিন কেটে যায় হরেক রকম তালবাহানায়। নিজের স্বাধীনতাকে জ্যান্ত কবর দিয়ে চলে মালিক সন্তুষ্টির যুদ্ধ। যে যুদ্ধের শুরুর নির্দিষ্ট সময় থাকলেও শেষের সময়টা একদম অনিশ্চিত। পেটের দায়ে, আপনজনদের প্রতি দায়িত্ববোধের প্রবণতা থেকে মানুষ স্বাধীনতাকে পায়ে ঠেলে পরাধীনতার সাগরে জীবন ভেলা ভাসিয়ে চলতে থাকে দুঃখে ভেজা হৃদয়টাকে মিথ্যা হাসির বৈঠা করে।
একটা ছোট পিকআপ এসে দাঁড়াল। পিকআপ ভর্তি পাটকাঠিতে। আমাদের বিল্ডিংয়ের পাশেই একটা টিনসেডের ছাপরা। বেলকনির সঙ্গে লাগোয়া। ওখানে সারাদিন সারারাত ক্যাচ-কুচ শব্দ তৈরি হয়। স্কচটেপ মারার শব্দ। ওখানে তৈরি হয় ঝাড়ু। কাশফুলের গাছ দিয়ে তৈরি হয় ঝাড়ু। ঝাড়ু তৈরিতে এই পাটকাঠি ব্যবহার করা হয়। এই ঝাড়ু ফ্যাক্টরির মালিকের ছেলে সারারাত বসে থাকে খোলা জায়গায়। খানেক বাদে উঠে একটু ঘুরেই আবার বসে। কখনো আকাশ পানে তাকিয়ে, কখনো বা বিআরটিসির স্টাফ কোয়ার্টারের আম গাছের সঙ্গে কথা বলে। একা একা হাসে। মুখে ভেংচি কাটে। মুখভর্তি কালো কুচকুচে দাড়ি। তাগড়া যুবক। নেশার পরিমাণ ওভারটেক করার দরুন ব্রেনে সমস্যা হয়েছে ছেলেটার। আমি তার কার্যকলাপ ফলো করি। হরেকরকম হাসির খোরাক তৈরি করে ছেলেটা। প্রায়ই আমার পাশে বসে অজু করে মসজিদের অজুখানায়। সবকিছু করলেও পা না ধুয়ে নামাজ পড়ে চলে আসে। মসজিদের এসি-ফ্যান সবগুলোর সঙ্গে কথা বলে বের হয় মসজিদ থেকে।
রিকশা নিয়ে ছুটছে এই শহরের জাতীয় মামারা, যাদের নাম কখনো খালি, কখনো রিকশা, কখনো বেয়াদব-ছোটলোক ইত্যাদি। দিন শেষে এরকম কত যে তকমা নিয়ে গ্যারেজে ফেরে এই মানুষগুলো তার হিসাব রাখা কঠিন। আমি সময় পেলেই পাশের দুইটা রিকশা গ্যারেজে যাই। রিকশাচালকদের সঙ্গে গল্প করে সময় কাটাই। বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার গল্প। এই শহরে সমস্ত রকম রাগ, ক্ষমতা, দাম্ভিকতা প্রয়োগের উর্বর ক্ষেত্র এই রিকশাওয়ালারা। এদের কান আছে শুনতে পায়। মুখ আছে কিন্তু বলতে পারে না।
এই শহরের রংবেরঙের আলোর ভিড়ে ভালো আছে অনেকেই। আমরা মানুষরা এক আজব প্রাণী। অন্ধকারে যে আলো আমাদের রাস্তা দেখায় আমরা সেই আলোকে ভুলে রাস্তাটাকেই মনে রাখি।
এই শহরে পেটের দায়ে এরকম হাজারো আলোর অক্লান্ত পরিশ্রমে আলোকিত হয় রাস্তা। আলোগুলোর আলোর জ্যোতি বেশি হলেও চাহিদা একদম কম। স্বপ্নগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে যুগে যুগে কত আলো যে এই শহর থেকে চিরবিদায় হয়ে দূর আকাশের তারা হয়ে যায়, তার হিসাব কেউ রাখে না। আলোর নিচের অন্ধকারটা সবার কাছে অজানাই থেকে যায় যুগের পর যুগ।
মসজিদ থেকে মোয়াজ্জিনের আজানের সুর ভেসে আসছে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আওয়াজ। শ্রেষ্ঠ ছন্দ। হৃদয় দিয়ে শুনলে চোখ বেয়ে পানি নামে।
এই শহরের গল্প লেখা যায়। শেষ করা যায় না।
ঘড়িতে এখন ভোর ৪টা বেজে ৪৪ মিনিট।
এস আর শানু খান
মনোখালী, শালিখা, মাগুরা

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়