গঙ্গা-যমুনা নাট্য ও সাংস্কৃতিক উৎসব : শিল্পকলায় দ্বিতীয় দিনে ছিল দর্শকদের উপচে পড়া ভিড়

আগের সংবাদ

জাতিসংঘ থেকে ফিরে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা : রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন না হওয়ার নেপথ্যে আন্তর্জাতিক নিষ্ক্রিয়তা

পরের সংবাদ

প্রত্যাবাসনে জটিলতা বাড়ল! রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়া বানচাল করতেই কী মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ড : কারা এই স্বার্থান্বেষী মহল

প্রকাশিত: অক্টোবর ৪, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ৪, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য : বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার বিষয়টি অনেকটা চাপা পড়ে গেছে। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট সব মহলে বিরাজ করছে ‘অদ্ভুত নীরবতা’। এর মধ্যে রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ড বিষয়টিকে আরো জটিল করে তুলেছে। কেন এই জটিলতা- এ নিয়ে কোনো কথা এখনো প্রকাশ্যে না এলেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় হত্যাকাণ্ড নিয়ে কথা বলা শুরু করেছে। একই সঙ্গে প্রত্যাবাসনের বিষয়ে তারা মুখে কুলুপ এঁটেছে। পাশাপাশি তিন বছর আগে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি হলেও কবে এবং কীভাবে রোহিঙ্গারা ফেরত যাবে, সে বিষয়েও কোনো উচ্চবাচ্য নেই। তবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বদ্ধপরিকর বাংলাদেশ। তাদের নিজ দেশে ফিরে যেতে হবে গতকাল আবারো এমন আশাবাদ ব্যক্ত করলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন।
প্রসঙ্গত, রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের জের ধরে তাদের প্রত্যাবাসনের আলোচনাটি ফের সামনে চলে আসে। বিশেষ করে ওই হত্যাকাণ্ডের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে বিবৃতি দেন তাতে বলা ছিল, মুহিবুল্লাহ নিজ দেশ মিয়ানমারে ফেরত যেতে চেয়েছিলেন, সে কারণে কিছু স্বার্থান্বেষী মহল তাকে হত্যা করেছে। এরপরই প্রশ্ন উঠেছে স্বার্থান্বেষী মহল কারা, যাদের কারণে ঘনবসতিপূর্ণ রোহিঙ্গা শিবিরে একজন রোহিঙ্গা নেতাকে প্রাণ হারাতে হলো এবং রোহিঙ্গারা কেন বাংলাদেশে রয়েছে, তারা মিয়ানমার ফিরে যাবে কবে? এ বিষয়ে গতকালও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি আবার বলেন, আমার ধারণা মিয়ানমারে ফেরত যেতে চাওয়ার কারণেই তাকে হত্যা করা হয়েছে। এখন ধরপাকড় চলছে। কয়েকজন আটক হয়েছেন। অবশ্যই মূল অপরাধী বের হবে। কিন্তু স্বার্থান্বেষী মহল কারা, সে বিষয়ে তিনি কিছু বলেননি।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, মূলত চারটি কারণেই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া আটকে আছে। মিয়ানমার নিজেরাই রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে চায় না, রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করা এনজিওগুলো চায় না, ইসলামী মৌলবাদী গোষ্ঠী চায় না এবং রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার বিষয়টি মিয়ানমার যেভাবে এড়িয়ে যাচ্ছে, তাতে গোপনে সমর্থন জানাচ্ছে চীন-রাশিয়ার মতো বৃহৎ শক্তি। এমনকি বিশ্বব্যাংকের মতো বৈশ্বিক সংস্থাও রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের মূল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে আত্তীকরণের উদ্ভট প্রস্তাব দিয়েছে। এই হাওয়ায় তাল দিচ্ছে জাতিসংঘও। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপীয় ইউনিয়নও মিয়ানমারের ওপর জোরালো চাপ সৃষ্টি করতে পারেনি। সব মিলিয়ে জটিল ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার মারপ্যাঁচ এবং সর্বশেষ মুহিবুল্লাহর হত্যাকাণ্ড পুরো প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকেই অনিশ্চয়তায় ফেলে দিয়েছে। তাছাড়া বাধ্য না হলে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে না। অন্যদিকে যারা মিয়ানমারকে বাধ্য করতে পারে, তারাও নিজেদের স্বার্থে সে রাস্তায় হাঁটছে না। আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এ দেশগুলোর ‘স্বার্থ রক্ষার কূটনীতির’ কারণে বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ফিরে যেতে কত বছর লাগবে, সেটা নিয়ে যেমন অনিশ্চয়তা রয়েছে

তেমনি কখনো যাবে কিনা, তা নিয়েও রয়েছে ঘোরতর সংশয়।
জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন ভোরের কাগজকে বলেন, হয়তো রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন থেমে আছে। কিন্তু এটা যে কোনো সময় শুরু হতে পারে। তিনি বলেন, মিয়ানমার তো কখনই বলেনি তারা রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে না। এজন্য রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়ার ব্যাপারে আমি এখনো আশাবাদী।
তবে রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়ার ব্যাপারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আশাবাদী হলেও সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমসের মবিন চৌধুরী কোনো আশা দেখতে পাচ্ছেন না জানিয়ে গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, যে প্রক্রিয়ায় রোহিঙ্গারা বিতাড়িত হয়েছে, তা ফেরত নেয়ার জন্য নয়। মিয়ানমার কূটনৈতিক ভাষায় হয়তো বলছে তাদেরকে ফেরত নেবে, কিন্তু ফেরত নেয়ার ব্যাপারে আমি মিয়ানমার সরকারের কোনো আলামত বা ইঙ্গিত পাইনি। বরং রোহিঙ্গাদের চিরস্থায়ীভাবে বিতাড়নের জন্যই মিয়ানমার পরিকল্পিতভাবে নির্যাতন করেছে এবং এটা তাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনারই অংশ। মূলত আরাকানকে রোহিঙ্গামুক্ত করা। তবে এখন রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে কে খুন করল, এটা বের করা জরুরি বলে মনে করেন তিনি। তার মতে, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতির আলোকে স্বার্থান্বেষী মহলের কথা ধরে নিলেও প্রশ্ন আসে, কারা এ স্বার্থান্বেষী? তিনি বলেন, ঘনবসতিপূর্ণ শরণার্থী শিবিরে একদল মানুষ রোহিঙ্গা নেতাকে গুলি করে মেরে বেরিয়ে গেল। এই ঘটনা কেউ দেখল না, কোনো রোহিঙ্গাও এ বিষয়ে মুখ খুলছে না, এটা খুবই বিপজ্জনক। বিশেষ করে ওই ঘটনা বাংলাদেশে নিরাপত্তার ঝুঁকি তৈরি করেছে। এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জঙ্গিবাদ, উগ্রবাদ কিংবা দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনা আছে কিনা, তাও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
শমসের মবিন চৌধুরী এটাও বলেন, রোহিঙ্গা শিবিরে এত পুলিশ, আর্মি, এপিবিএনের সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছেন। এ রকম পরিস্থিতিতে সেখানে রোহিঙ্গাদের হাতে অস্ত্র গেল কীভাবে? সব মিলিয়ে মুহিবুল্লাহকে কেন মারা হয়েছে, এটাই এখন বড় প্রশ্ন।
সংশ্লিষ্টদের মতে, রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার বিষয়ে আন্তর্জাতিক শক্তিও খুব একটা ভূমিকা রাখছে না। এতে মিয়ানমার কার্যত কোনো চাপও অনুভব করছে না। যদিও যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের কয়েকজনের ওপরে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে। কিন্তু এ নিষেধাজ্ঞা নিয়ে মিয়ানমার খুব একটা চিন্তিত নয়। কারণ এর আগে গত ৩০ বছর তারা নিষেধাজ্ঞার কবলেই ছিল। এতে যে তাদের ক্ষতি হয়েছে, তাও বলা যায় না। নিষেধাজ্ঞার ফলে তারা যুক্তরাষ্ট্রে যাবে না। কিন্তু অনায়াসেই তারা চীন যাবে, ভারত যাবে, থাইল্যান্ড যাবে। এছাড়া আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর মধ্যে রাশিয়ার তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ‘গ্যাজপ্রম’ মিয়ানমারে অফিস খুলেছে। অন্যদিকে অং সান সুচির সময়ে, বিশেষ করে পূর্বাঞ্চলে প্রচুর অর্থ লগ্নি করেছে জাপান। জাপান জান্তা সরকারের প্রতি সমর্থন না জানালেও খুব একটা বিরোধিতাও করছে না। তবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন খেলায় মিয়ানমারের পক্ষে মূল খেলোয়াড় হচ্ছে চীন। জাপান বা ভারতের অবস্থান এখানে এখনো তেমন প্রভাব ফেলতে না পারলেও চীনই দীর্ঘ সময় ধরে বিশ্ব মতামত উপেক্ষা করে তাদের টিকিয়ে রেখেছে। অন্যদিকে, ভারত বা জাপান নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যও নয়। ফলে এ দেশ দুটির চেয়ে চীন ও রাশিয়ার ভূমিকা এক্ষেত্রে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মিয়ানমারের জন্য যে চারটি করণীয় নির্ধারণ করে দিয়েছে, দেশটি তা প্রতিপালনে ব্যর্থ হলে ওই আদেশ স্বয়ংক্রিয়ভাবেই জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে যাবে। এক্ষেত্রে আদালতের আদেশ প্রতিপালন না করার কারণে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া যায়, তা নিয়ে ভোটাভুটি হবে। ওই ভোটাভুটির ক্ষেত্রে চীন ও রাশিয়া আগের মতো ভেটো দিলে পুরো আদেশটিই কার্যত অর্থহীন হয়ে যাবে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সংকট থেকে সেদিনই পরিত্রাণ পাবে, যদি চীন তা আন্তরিকভাবে চায়। চীন চাইলে, রাশিয়াও চাইবে। পাশাপাশি মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে আন্তর্জাতিক পক্ষগুলোর চাপের মুখেও পড়েছে বাংলাদেশ সরকার।
জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডে নিঃসন্দেহে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় জটিলতা বেড়েছে। আন্তর্জাতিক শক্তি হয়তো এ বিষয়ে কিছু কথা বলবে। এজন্য প্রত্যাবাসন আটকে যাবে কথাটি ঠিক নয়। তিনি বলেন, মুহিবুল্লাহ থাকাকালে প্রত্যাবাসন শুরু হয়েছিল বিষয়টি তাও নয়; তবু পরিস্থিতি একটু জটিল করে তুলবে। তবে কেন মুহিবুল্লাহকে মারা হলো, তার কারণ অনুসন্ধানে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়