দেব দুলাল মিত্র : ফেসবুক ও অন্যান্য অনলাইন অ্যাকাউন্ট হ্যাকিংয়ের ঘটনা আতঙ্কজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। যারা হ্যাকিংয়ের শিকার হচ্ছেন, তাদের বেশির ভাগই বিভিন্ন বয়সী নারী। এদের মধ্যে প্রায় ৮৭ ভাগের বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। দেশের মাদারীপুর জেলা এখন হ্যাকারদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। উচ্চশিক্ষা না থাকলেও এ জেলার তরুণ ও যুবকরা হ্যাকিংয়ে সবচেয়ে বেশি দক্ষ। চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করা যুবকরা ফেসবুক ও অনলাইন হ্যাকিং করে আর্থিক অবস্থা বদলে ফেলছে। সম্প্রতি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার এন্ড স্পেশাল ক্রাইম টিম মাদারীপুর থেকে তিন যুবককে গ্রেপ্তারের পর এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ্যে চলে এসেছে। এ এক চক্রের হাতে দুই হাজার নারীর অ্যাকাউন্ট হ্যাক হয়েছে।
তথ্যপ্রযুক্তি পেশাজীবীদের আন্তর্জাতিক সংগঠন ইনফরমেশন সিস্টেম অ্যান্ড কন্ট্রোল অ্যাসোসিয়েশন (আইসাকা) ঢাকা চ্যাপ্টারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও অন্যান্য অনলাইন অ্যাকাউন্ট হ্যাকিংয়ের ঘটনার হার ২৮ দশমিক ৩১ শতাংশ বেড়েছে। ২০১৯ সালে এ হার ছিল ১৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ। গত এক বছরে হ্যাকিংয়ের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ শতাংশ। বয়সভিত্তিক সাইবার অপরাধের ঘটনায় ৮৬ দশমিক ৯০ শতাংশ ভুক্তভোগীর বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সাইবার এন্ড স্পেশাল ক্রাইম ইউনিটের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার জুনায়েদ আলম সরকার বলেন, ঢাকার রামপুরায় বসবাসরত এক গৃহবধূ তার ফেসবুক আইডি হ্যাক হওয়া এবং তার কাছ থেকে টাকা আদায়ের ঘটনার ব্যাপারে অভিযোগ করে। এ ঘটনার তদন্তে নেমে একপর্যায়ে মাদারীপুরের শিবচর থানার মাতব্বরচর পূর্ব কাচাকান্দি এলাকা থেকে ওবাইদুল রহমান নোবেল, শামীম সরদার ও সজিব খলিফা নামে তিন তরুণকে গ্রেপ্তার করা হয়। গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানায়, কমপক্ষে দুই হাজার নারীর ফেসবুক আইডি তারা হ্যাক করে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
তিনি আরো বলেন, মূলত তরুণীরাই তাদের মূল টার্গেট ছিল। হ্যাকাররা টার্গেট করার নারীর পরিচিত পুরুষ ব্যক্তির ফেসবুক আইডি প্রথমে হ্যাক করে। এরপর ওই আইডি থেকেই হ্যাকাররা নারীর মেসেঞ্জারে ফিশিং লিংক পাঠান। পরিচিতজনের পাঠানো লিংকে নারীরা ক্লিক করে পাসওয়ার্ড দেয়ামাত্র আইডি হ্যাকারদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এরপর আইডি ফিরিয়ে দেয়ার আশ্বাস দিয়ে টাকা দাবি করতে থাকে।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে ব্ল্যাকমেইল করাই হ্যাকারদের একমাত্র লক্ষ্য। রামপুরার ওই নারীর কাছ থেকে হ্যাকাররা মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করে। প্রথমে ওই গৃহিণী বিষয়টি বুঝতেই পারেননি। হ্যাকাররা পরিচিত ব্যক্তি সেজে ওই নারীর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ে তোলে।
চেহারা আড়াল করে ভিডিও কল দিয়ে স্ক্রিনশট রেখে দেয়। পরে ছবি ওই নারীর ম্যাসেঞ্জারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ছবিগুলো তার স্বামীর কাছে পাঠানো হবে বলেও হুমকি দেয়। তখন ওই নারী বুঝতে পারেন যে তার আইডি হ্যাক হয়েছে। অন্য এক নারীর কাছে থেকেও তারা একাধিকবার টাকা আদায় করেছে। সেই নারী হ্যাকার নোবেল ও শামীমের ০১৮৬৫৫২১৭৪২ ও ০১৭৩২৭২৮৫৭৯ নাম্বারে টাকা বিকাশ করে অ্যাকাউন্ট ফেরত পান।
আইসাকা প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ ইকবাল হোসাইন বলেন, বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তি ও ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ব্যাপক হারে বাড়ায় এটার ইতিবাচক দিকগুলোর সঙ্গে নেতিবাচক দিকগুলো ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। চলতি বছরে হ্যাকিংয়ের হার আগের চেয়ে ১৩ শতাংশ বেড়েছে। এই হারটা কেবল ভাবিয়েই তুলছে না, ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কাও সৃষ্টি হচ্ছে। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে দেশের সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি সাইবার লিটারেসিও বাড়াতে হবে।
গ্রেফতার নোবেল এসএসসি পাস করার পর মাদারীপুরে একটি মুদি দোকান চালাত। করোনাকালে তার ব্যবসা ভালো না হওয়ায় ইউটিউব দেখে হ্যাকিংয়ের কৌশল শিখে প্রতারণা শুরু করে। চতুর্থ শ্রেণি পাস শামীম ইলেকট্রিশিয়ান এবং সজিব গার্মেন্টের চাকরি ছেড়ে ফেসবুক আইডি হ্যাকিং শুরু করে। তারা এ পর্যন্ত অন্তত ২ হাজার নারীর ফেসবুক আইডি হ্যাক করে কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে। মূলত তরুণী ও বিবাহিত অল্প বয়সি নারীরাই তাদের মূল টার্গেট।
এর আগে গত ২৩ জুন মামুন মিয়া নামে এক যুবককে ডিবি পুলিশ গ্রেপ্তার করে। স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণ নেয়ার পাশাপাশি ইউটিউব ও গুগল ঘেঁটে ফেসবুক আইডি হ্যাক করার ফিশিং প্রক্রিয়া রপ্ত করে। একাধিক প্রবাসীসহ অসংখ্য নারী মামুনের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছে।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।