গঙ্গা-যমুনা নাট্য ও সাংস্কৃতিক উৎসব : শিল্পকলায় দ্বিতীয় দিনে ছিল দর্শকদের উপচে পড়া ভিড়

আগের সংবাদ

জাতিসংঘ থেকে ফিরে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা : রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন না হওয়ার নেপথ্যে আন্তর্জাতিক নিষ্ক্রিয়তা

পরের সংবাদ

ক্ষতিগ্রস্ত পর্যটন খাত ও ব্যাংকের ভূমিকা

প্রকাশিত: অক্টোবর ৪, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ৪, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশে তৈরি পোশাক খাতের পর পর্যটন শিল্প হতে পারে রাজস্ব আদায়ের বিরাট সম্ভাবনাময় খাত। আর সেই সম্ভাবনার বিষয়টি বিবেচনায় রেখেই সরকার পর্যটন খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। পর্যটন শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে এদেশের প্রায় ৫০ লাখ মানুষ। অনেক প্রতিকূলতা, সীমাবদ্ধতা, সমস্যা, সংকট, ত্রæটি-বিচ্যুতি, পশ্চাৎপদতা সত্ত্বেও পর্যটন খাত থেকে একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ উপার্জন করছে বাংলাদেশ। অভ্যন্তরীণ পর্যটনের উল্লেখযোগ্য প্রসার ঘটেছে বাংলাদেশে। সাধারণ মানুষ এখন ছুটির দিনগুলোতে পরিবার, পরিজন, বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে দেশের বিভিন্ন পর্যটন স্পটে বেড়াতে যাচ্ছেন। এখন বিভিন্ন উৎসবে, ছুটির দিনে দেশের জনপ্রিয় পর্যটন স্পটগুলো আগত পর্যটকের ভিড়ে দারুণ জমজমাট হয়ে ওঠে। ওই সময়ে সেখানকার হোটেল, মোটেল, কটেজগুলোতে থাকার জন্য রুম খালি পাওয়া যায় না। কয়েক মাস আগে থেকেই মোটেল রিসোর্টগুলোর সব রুম বুকিং দিয়ে রাখতে হয়। যদি পর্যটন স্পটগুলোতে হোটেল, মোটেল, রিসোর্টের সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পায় তাহলেও সেখানে ভিড় কমবে না।
পর্যটন ব্যবসায় নিয়োজিত উদ্যোক্তা, বিনিয়োগকারী, ব্যবসায়ী, ট্যুর অপারেটরদের দাবি- করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত পর্যটন শিল্পকে পুনরায় উজ্জীবিত করতে এ খাতে সরকারের পক্ষ থেকে আরো সুযোগ-সুবিধা দিতে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। পর্যটন খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধিসহ উদ্যোক্তাদের জন্য আর্থিক সহযোগিতা ঋণ প্রদানের নানা স্কিম গ্রহণের মাধ্যমে এ খাতকে আরো এগিয়ে নিতে বিশেষ ব্যাংকিং সেবা প্রদানের ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণের দাবি উঠেছে। এ খাতের বিনিয়োগ বাড়াতে ব্যাংক ও আর্থিক খাতকে এগিয়ে আসতে হবে। পর্যটন শিল্পে বিনিয়োগে আগ্রহী অনেক উদ্যোক্তা যথেষ্ট পরিমাণ পুঁজির অভাবে মাঝপথে থেমে আছেন। প্রয়োজনীয় আর্থিক সহযোগিতা যেমন, ব্যাংক ঋণ পেলে তারা তাদের পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করতে পারেন। এর মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন পর্যটন স্পটগুলোতে আরো অনেক বেশি হোটেল, মোটেল, কটেজ, রেস্টুরেন্ট, রিসোর্ট তৈরি হতে পারে। ব্যাংক ঋণ নিয়ে গড়ে তোলা যেতে পারে আকর্ষণীয় ট্যুরিস্ট স্পট। যেখান থেকে আয় হতে পারে বিপুল পরিমাণ অর্থ। লাভজনক এবং পরিবেশবান্ধব এই শিল্পে বিনিয়োগের অনেক সুযোগ থাকলেও ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর এ খাতে অংশগ্রহণ এখনো উল্লেখ করার মতো অবস্থায় পৌঁছায়নি।
দেশের পর্যটন খাত নিয়ে গর্ব করার যাত্রা শুরু হলেও গতানুগতিক সাধারণ ব্যাংকিং ব্যবস্থায় এমনিতেই পর্যটন খাতকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে এ খাতে আর্থিক বিনিয়োগ সব সময়ই সংকুচিত করে রাখা হয়। ফলে পর্যটন খাতে ব্যাংক কর্তৃক বিনিয়োগের মাত্রা সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। কিন্তু ব্যাংকগুলো যদি পর্যটন খাতের জন্য বিশেষ সঞ্চয় স্কিম, আলাদা ঋণদানের মাধ্যমে হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট, রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় বিনিয়োগের বিশেষ প্যাকেজ চালুর উদ্যোগ নেয় তাহলে এ খাতের সমৃদ্ধি ঘটতে পারে খুব দ্রুত। আমাদের প্রতিবেশী এবং সার্কভুক্ত দেশ নেপাল পর্যটন খাতে আকাশছোঁয়া সাফল্য অর্জন করেছে। তাদের পর্যটন খাতের বিশাল সাফল্যের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে নেপাল ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড। এটাকে পর্যটন খাতের জন্য বিশেষায়িত ব্যাংক বলা চলে। খুব বেশি দিন আগে এই ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কিন্তু এর মধ্যেই নেপালের পর্যটন শিল্পের রক্ত সঞ্চার করে চলেছে নেপাল ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড। ওখানকার সাধারণ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো যখন পর্যটন খাতে আর্থিক বিনিয়োগকে ঝুঁকিপূর্ণ ভেবে সংকুচিত অবস্থায় ছিল তখন প্রতিষ্ঠিত হয় নতুন এই বিশেষায়িত ব্যাংক। বিশেষ সঞ্চয়ী প্রকল্প চালুর মাধ্যমে পর্যটন খাতকে সহায়তা করা, হোটেল, মোটেল, কটেজ, রিসোর্ট প্রতিষ্ঠা, ক্রয়, সংস্কার, পুনঃসজ্জিতকরণ, আধুনিকায়নে ঋণ বিতরণ এবং পর্যটন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যবসায় গ্যারান্টি প্রদানে নেপাল ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড কাজ করে যাচ্ছে। যার অনুকূলে প্রভাব নেপালের পর্যটন খাতে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। নেপালের মতো ভারতেও পর্যটন খাতে আর্থিক সহযোগিতার জন্য রয়েছে ট্যুরিস্ট ফাইন্যান্স করপোরেশন অব ইন্ডিয়া, যা ভারতের পর্যটন শিল্পের বিকাশে প্রয়োজনীয় আর্থিক সাহায্য-সহযোগিতা করে যাচ্ছে।
নেপাল ও ভারতের মতো বাংলাদেশে পৃথক কোনো পর্যটন ব্যাংক চালু না করেও প্রচলিত ব্যাংক ব্যবস্থায় পর্যটন শিল্পের বিকাশে আমাদের ব্যাংকগুলো নতুন বিনিয়োগ করতে পারে। পর্যটনে যাওয়ার জন্য আগ্রহীদের বিশেষ সঞ্চয় স্কিম, এ ব্যবসায় নিয়োজিতদের জন্য বিশেষ সঞ্চয় প্রকল্প চালু থেকে শুরু করে এ খাতে উদ্যোক্তাদের জন্য এসএমই ঋণের মতো আলাদা ঋণদান কর্মসূচি প্রচলন করা যায়। দেশের বিভিন্ন সম্ভাবনাময় পর্যটনকেন্দ্র ও স্থানগুলোকে কেন্দ্র করে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বিশেষ ট্যুরিজম ব্যাংকিং উইন্ডো চালু করা যেতে পারে। নতুন নতুন হোটেল, মোটেল নির্মাণ, কটেজ, রিসোর্ট এবং অ্যামিউজমেন্ট পার্ক প্রতিষ্ঠা, পর্যটন স্পটগুলোতে অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যবসায়িক সম্ভাব্যতা যাচাই ও বিশ্লেষণ করে বিনিয়োগ উপযোগী মনে হলে ট্যুরিজম ব্যাংকিং উইন্ডো চালু করার মাধ্যমে ঋণ সুবিধা প্রদান করা যেতে পারে। আগ্রহী উদ্যোক্তারা এক্ষেত্রে ব্যাংক প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে পর্যটন শিল্পে নতুন প্রাণের সঞ্চার করতে পারেন। দেশের অভ্যন্তরে পর্যটকদের চলাচলে সুবিধার জন্য বিভিন্ন এয়ারলাইন্সকে নানা ধরনের আর্থিক প্রণোদনা দেয়া যায়, যাতে তারা তাদের সেবার পরিধি ও মান বৃদ্ধি করতে পারে। বিলাসবহুল বাস, ট্যুরিস্ট কোচ ও জাহাজ আমদানির লক্ষ্যে ব্যাংকগুলো যথাসম্ভব জটিলতা পরিহার করে সহজ শর্তে ট্যুরিস্ট অপারেটরদের পর্যাপ্ত ঋণ প্রদান করতে পারে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে মুদ্রা বিনিময়ের জন্য সার্বক্ষণিক ব্যাংকিং সেবা প্রদানের ব্যবস্থা, যথেষ্ট সংখ্যক এটিএম বুথ স্থাপন এবং এগুলো সার্বক্ষণিক চালু থাকা নিশ্চিতকরণ, ডিজিটাল আর্থিক লেনদেন সুবিধা বৃদ্ধিকরাসহ দেশি-বিদেশি পর্যটকদের ব্যাংকিং সেবা প্রদানের লক্ষ্যে বিশেষ হেলপ ডেস্ক চালুকরণের মাধ্যমে ব্যাংকগুলো পর্যটন খাতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে। পর্যটন খাতকে ঝুঁকিবহুল খাত মনে না করে এটাকে সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে বিবেচনায় এনে আমাদের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বিনিয়োগে উদ্যোগী হলে পর্যটন ব্যবসায় নিয়োজিতরা বিশেষ প্রণোদনা লাভ করবেন, নিঃসন্দেহে বলা যায়।
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো পর্যটন খাতের সম্ভাবনাময়, লাভজনক প্রকল্প খুঁজে বের করে আগ্রহী উদ্যোক্তাদের প্রয়োজনীয় ঋণ প্রদানসহ অন্যান্য বিনিয়োগ প্যাকেজের সুযোগ সৃষ্টি করলে আগামী কয়েক বছরে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের চেহারা অনেকটাই বদলে যেতে পারে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব লীলভূমি বাংলাদেশ হাতছানি দেয় বিদেশি পর্যটকদের। কিন্তু বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প এখনো অবকাঠামোগতভাবে অনেকটা পিছিয়ে আছে আমাদের প্রতিবেশী অন্যান্য দেশের চেয়ে। প্রয়োজনীয় আর্থিক বিনিয়োগ পর্যটন শিল্পের অবকাঠামোগত উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনাময় খাত ও যোগ্য, অভিজ্ঞ, দক্ষ উদ্যোক্তা নির্বাচন করে যদি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো পৃথক উইন্ডোর মাধ্যমে বিশেষ ব্যাংকিং সেবা প্রদানে উদ্যোগী হয় তাহলে বিনিয়োগকৃত অর্থের সদ্ব্যবহার নিশ্চিতকরণসহ তা ফেরত পাওয়ার কার্যকর কলাকৌশল নির্ধারণ করতে হবে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে। এসএমই খাতের মতো ব্যাংকগুলো পর্যটন খাতে বিশেষ ব্যাংকিং সেবা পণ্য চালুর মাধ্যমে আগ্রহী উদ্যোক্তা গ্রাহকদের সহযোগিতা করতে পারে। নতুন নতুন হোটেল, মোটেল, কটেজ প্রতিষ্ঠা, বিনোদনকেন্দ্র স্থাপন, বিভিন্ন প্রাকৃতিক শোভামণ্ডিত স্থানে অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা সমৃদ্ধ মনোরম রিসোর্ট গড়ে তোলা, উন্নতমানের রেস্টুরেন্ট চালুর লক্ষ্যে ব্যাংকগুলো যদি আলাদা ঋণদান কার্যক্রম শুরু করে তবে আগ্রহী উদ্যোক্তার অভাব হবে বলে মনে হয় না।
বাংলাদেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে পর্যটন শিল্পের জন্য বিশেষ ব্যাংকিং সেবা চালুকরণের ব্যাপারে অর্থ মন্ত্রণালয়, পর্যটন ও বেসামরিক বিমান মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে যদি আলাদা নীতিমালা প্রণয়ন করতে পারে তাহলে সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্পকে আরো সমৃদ্ধ ও উন্নতকরণের মাধ্যমে জিডিপিতে এর বিপুল পরিমাণ অবদান বাড়ানো সম্ভব। পর্যটন খাতকে চাঙ্গা ও উন্নত করতে স্পেশাল ট্যুরিজম ব্যাংকিং কর্মসূচি চালুর ব্যাপারে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করলে জাতীয় অর্থনীতিতে শুভ ফলাফল বয়ে আনতে পারে। দেশীয় অর্থনীতিতে পর্যটনের অবদান প্রায় ৫ শতাংশ। যার মুখ্য অংশ অভ্যন্তরীণ পর্যটন থেকে আসে। করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পকে পুনরায় উজ্জীবিত করতে বেশ কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে অবিলম্বে। বড় অঙ্কের প্রণোদনা প্যাকেজসহ সরকারের বিভিন্ন এজেন্সির সহযোগিতা এ ক্ষেত্রে জরুরি হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে পর্যটন শিল্পে প্রয়োজনীয় পুঁজির জোগান নিশ্চিত করতে হবে। পর্যটনের বিভিন্ন উপখাতের ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা, প্রতিষ্ঠানকে তাদের সক্ষমতা অনুযায়ী ঋণ প্রদানে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। পর্যটন উপখাতে সংশ্লিষ্ট উদ্যোগগুলোর সম্ভাব্যতা যাচাই করে প্রয়োজনীয় ঋণের পরিমাণ নিরূপণ করে তা প্রদানে আন্তরিক এবং উদ্যোগী হতে হবে ব্যাংকগুলোকে।
রেজাউল করিম খোকন : সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়