তেজগাঁওয়ে বাসায় রহস্যজনক বিস্ফোরণে দুই শিক্ষার্থী দগ্ধ

আগের সংবাদ

১৫ সদস্যের দলে আট নতুন মুখ : আত্মবিশ্বাস নিয়ে বিশ্বকাপ মিশনে টাইগাররা

পরের সংবাদ

বৈপরীত্যের নানা কথন

প্রকাশিত: অক্টোবর ৩, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ৩, ২০২১ , ১২:৫৭ পূর্বাহ্ণ

সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায়ে হিন্দি ভাষা বহু-ভাষাভাষী ভারতীয় জনগণের ওপর চাপানো হয়েছিল। ভারতের ধনিক এবং শাসকশ্রেণি একাকার হয়ে গিয়েছিল এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র ও হিন্দি ভাষা প্রতিষ্ঠায়। কেন্দ্রীয় শাসকগোষ্ঠী ভারতের বিভিন্ন জাতিসত্তার মানুষের জাতীয়তার উন্মেষ কঠোর হস্তে শাসন, শোষণ, দমন ও পীড়নে চরমভাবে সিদ্ধহস্ত। সংবিধান অনুযায়ী বহুজাতি-ভাষাভাষীর কারাগারে পরিণত ভারত। শুরুতে ভারতীয় সংবিধানে ‘ভারত যুক্তরাষ্ট্র’ (ঋবফধৎধঃরড়হ ড়ভ ওহফরধ) প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হয়েছিল কিন্তু শাসক দল কংগ্রেস তাতে বাধা প্রদান করে। কংগ্রেস সংবিধানভুক্ত করে ‘ভারত রাষ্ট্রসংঘ’ (টহরড়হ ড়ভ ঝঃধঃবং)। এতে ফেডারেলের আওতায় সব প্রদেশ স্বেচ্ছায় কেন্দ্রীয় শাসনের অধীন হয়ে পড়ে। রাজ্যের শাসন সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয় কেন্দ্রের শাসনাধীনে চলে যাবার ফলে রাজ্য সরকারগুলোর ক্ষমতা স্থায়ীভাবে সংকুচিত এবং সীমিত হয়ে যায়। রাজ্যগুলোর সব শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতা সংবিধানে খর্ব করা হয়। রাজ্যপাল নিয়োগের ক্ষেত্রে জনগণ দ্বারা নির্বাচিত রাজ্যপালের দাবি ওঠে। সে দাবি নেহরু প্রত্যাখ্যান করেন। রাজ্যপালের নিয়োগের অধিকার কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে দেয়া হয়। রাজ্যপালের নিয়োগ-জবাবদিহিতা কেবলই কেন্দ্রের অধীন। প্রতিটি প্রদেশে রাজ্যপাল নিয়োগ করে কেন্দ্রীয় সরকার। অনির্বাচিত রাজ্যপাল ইচ্ছা করলেই নির্বাচিত রাজ্য সরকারকে বরখাস্ত করে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করতে পারেন। রাজ্যপালের এই অধিকার সাংবিধানিক। আইনসভা, মন্ত্রিসভা বাতিলের অধিকারও সংবিধান দিয়েছে রাজ্যপালকে। রাজ্যপাল কেন্দ্রীয় সরকারের কাছেই দায়বদ্ধ। প্রতিটি রাজ্য সরকারের আতঙ্কস্বরূপ কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত রাজ্যপাল। শাসন বিভাগ, বিচার বিভাগ, পুলিশের উচ্চতর বিভাগসহ সামরিক, আধা সামরিক বাহিনী এবং গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাগুলো কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন। নির্বাচিত রাজ্য সরকারগুলোর ক্ষমতা সীমিত, সংকীর্ণ ও নিষ্প্রভ।
ভাষার দ্ব›েদ্ব হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের বিভক্তি সাম্প্রদায়িক বিভক্তিরই আরেক অনুষঙ্গ। অপরিণামদর্শী দেশভাগ, রক্তাক্ত দাঙ্গা, উচ্ছেদ, বিচ্ছেদ, উৎপাটনের ইতিহাস আজো উপমহাদেশের সর্বাধিক মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি। ভারত-পাকিস্তান দুই দেশে হিন্দি-উর্দু সরকারি ও রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা পেয়েছে। পাকিস্তান রাষ্ট্রাধীন পূর্ব বাংলায় উর্দু ভাষা চাপানো সম্ভব হয়নি। ত্যাগ-আত্মত্যাগে, সংগ্রামে মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হয়েছিল। অথচ বৃহৎ ভারতে বিভিন্ন জাতিসত্তার ভাষাকে কোণঠাসা করে হিন্দির একক দৌরাত্ম্যের অধীন করা হয়েছে। ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী উন্মেষকে নিষ্ঠুর হস্তে দমন-পীড়নে স্তব্ধ করা হয়েছে, বারংবার-বহুবার। জাতিসত্তার আন্দোলনকে আখ্যা দেয়া হয় বিচ্ছিন্নতাবাদী অভিধায়। তবে দক্ষিণ ভারতের চার রাজ্য ছাড়া সমগ্র ভারত হিন্দির আধিপত্য ও আগ্রাসনের কবলে। এমনকি আমাদের দেশেও হিন্দি সাংস্কৃতিক আগ্রাসন প্রবলভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারতের বিভিন্ন জাতিসত্তার ন্যায় আমাদের ভাষা-সংস্কৃতিও হিন্দির আগ্রাসনে চরম সংকটের কবলে। বিশিষ্ট লেখক-সাংবাদিক ফ্র্যাঙ্ক মোরেস বলেছিলেন, ‘ভারতবর্ষের ঐক্য যদি কৃত্রিম ছিল তো ভারতবর্ষের দেশভাগও তাই। ভারতবর্ষকে যদি বিভক্তই হতে হতো, তবে জনতত্ত্বগত এবং সাংস্কৃতিক সংহতি ও ভাষার ভিত্তিতে যুক্তিসম্মতভাবে ভাগ হওয়া উচিত ছিল।’
বাঙালিদের প্রদেশ পশ্চিম বাংলার রাজধানী কলকাতায় জাত-বৈষম্য নিশ্চয় রয়েছে। যার ছিটেফোঁটা বাংলাদেশে নেই। তবে প্রকাশ্যে তেমন দেখা না গেলেও সম্প্রদায়গত বৈষম্য কিন্তু দেখা যায়। এছাড়া ঘটি-বাঙালদের বৈষম্য প্রকটভাবে কিন্তু রয়েই গেছে। বাঙাল-ঘটিদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক হচ্ছে, তবে সেটা পাত্র-পাত্রীদের ব্যক্তিগত পছন্দের কারণেই। পারিবারিকভাবে পরস্পর পরস্পরের থেকে দূরত্ব বজায় রেখেই চলে। কলকাতায় দ্বিমুখী সংকটের কবলে বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায়। তারা যেমন জাতি বৈষম্যের শিকার, তেমনি সম্প্রদায়গতও। অবাঙালি মুসলমানরা ভাষা-সংস্কৃতির পার্থক্যে বাঙালি মুসলমানদের আপন ভাবতে পারে না। তেমনি ভাষা-সংস্কৃতির অভিন্নতার পরও বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায় সম্প্রদায়গত বিভক্তির দরুন বাঙালি মুসলমানদের দূরে ঠেলে দেয়। এ বিষয়ে কলকাতার ক’জন বাঙালি মুসলমান তাদের আক্ষেপের কথা অকপটে বলেছে। কলকাতায় লাখ লাখ বিহারের অবাঙালি মুসলমান বসবাস করে আসছে সুদীর্ঘকাল থেকে। কলকাতার কলাবাগান, রাজাবাজার, পার্ক সার্কাস, খিদিরপুর, মেটিয়াবুরুজ, নিউমার্কেটের পূর্বাংশের বৃহৎ অঞ্চলে, আলিমুদ্দীন স্ট্রিট, ওলিউল্লাহ লেনের আশপাশের বিশাল অঞ্চলজুড়ে তারা বিচ্ছিন্নভাবে নয়, সংঘবদ্ধভাবে শত-হাজার পরিবার একত্রে বসবাস করে। এতে নিরাপত্তার ঘাটতি তাদের নেই। শক্ত নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যেই তারা রয়েছে। অবাঙালি বিহারের মুসলমানদের সঙ্গে বাঙালি মুসলমানরা একত্রে মসজিদে নামাজ আদায় করে মাত্র। অথচ তাদের পরস্পরের মধ্যে সৌহার্দ-সম্প্রীতির কোনোই নজির নেই। জাতিগত ভিন্নতা সম্প্রদায়গত অভিন্নতা সত্ত্বেও তারা কেউ কারো বন্ধু নয়। বাঙালি মুসলমানদের বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায় এবং অবাঙালি মুসলিমরা ব্রাত্য বলেই গণ্য করে। তবে মুসলিম বিহারিদের মধ্যে যথেষ্ট ঐক্য-সম্প্রীতি লক্ষ করা যায়। যে কোনো অবাঞ্ছিত ঘটনায় তারা হরহামেশা ঐক্যবদ্ধ হতে বিলম্ব করে না। ঝগড়া-হানাহানিতেও তাদের জুড়ি নেই। বাঙালি হিন্দু-মুসলমানরা ভাষা-সংস্কৃতির অভিন্ন বলয়ের হলেও তারা পরস্পরকে এড়িয়ে চলে। ধর্মীয় এবং জাতিগত মিল-অমিলে বাঙালি মুসলমানরা কোণঠাসা অবস্থায়। তাদের ভেতর হীনম্মন্যতার নানা প্রকাশ দেখা যায়।
অনেক বছর পূর্বে নেহরু কাপ ক্রিকেট খেলা দেখতে কলকাতায় গিয়েছিলাম। ইডেন গার্ডেনে পাকিস্তান-ভারতের খেলা শেষে ফেরার পথে আমার সফর-সঙ্গীর পরিচিত নিউমার্কেটের এক দোকানে বসে চা-পান করছিলাম। এমন সময় দুজন ছেলে দোকানে উঁকি দিয়ে দোকানিকে উদ্দেশ করে বলল, ‘নে, আজ তোরা জিতে গেলি, মিষ্টিমুখ করা আমাদের।’ আমি ওদের কথা বুঝতে পারিনি। পরে দোকানিকে জিজ্ঞেস করলে সে মুখ ভার করে বলেছিল, ‘আজ খেলায় পাকিস্তান জিতেছে, আমরা ভারতীয় মুসলমান, তাই আমাদের উদ্দেশে অমন অপমানজনক উক্তি করে গেল।’ আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম আপনি কি পাকিস্তানের সমর্থক? সে দৃঢ়ভাবে বলল ‘পাগল নাকি? দেখুন আমার বাড়ি হাওড়ায়। প্রতিদিন বাড়ি থেকেই আসা-যাওয়া করি। এদের সঙ্গে প্রতিদিন দেখা-সাক্ষাৎ হয়। নিজ মাতৃভূমি থেকে অপর কোনো দেশ কখনো আপন দেশ হতে পারে না? আমি পাগল বা অসুস্থ নই যে নিজ দেশের বদলে অদেখা-অচেনা অপর কোনো দেশের সমর্থক হব। সংখ্যালঘু মুসলমান হওয়ার কারণে এ ধরনের অপমানজনক কটূক্তি ছোটবেলা থেকেই শুনে শুনে গা-সওয়া হয়ে গেছে। ওসব আর গায়ে মাখি না।’
উত্তর ভারতের মথুরা গিয়ে ভিন্ন এক হৃদয়স্পর্শী বিপরীত অভিজ্ঞতাও হয়েছিল। মথুরায় পাঁচ-ছয়জনের এক পরিবারের পরস্পরের সঙ্গে খাস ঢাকাইয়া ভাষায় কথা শুনে অবাক হয়ে আগ বাড়িয়ে তাদের সঙ্গে আলাপ করি। বাংলাদেশের ঢাকা থেকে এসেছি শুনে কর্তাব্যক্তিটি আমাকে জড়িয়ে ধরেন। ঢাকার বিভিন্ন স্থানের কথা জিজ্ঞেস করেন। তাদের আদি নিবাস ছিল নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায়। ১৯৫০ সালের দাঙ্গায় প্রাণ বাঁচাতে রাতের অন্ধকারে বাড়িঘর ফেলে ঢাকা হয়ে সিলেট এবং সিলেট থেকে আসামের গৌহাটিতে স্থায়ী হয়েছেন। তীর্থে এসেছেন সুদূর আসাম থেকে। আসামে ঘরের বাইরে অসমিয়া-বাংলা দুই ভাষায় কথা বললেও পারিবারিক পরিমণ্ডলে খাস ঢাকাইয়া ভাষায় তারা কথা বলেন। আসামে পূর্ব বাংলার অনেক মানুষ রয়েছে। আদি ঢাকার যারা তারা পরস্পরের সঙ্গে ঢাকাইয়া কুট্টি ভাষায় কথা বলে থাকেন। কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গে স্থায়ী না হওয়ায় স্বস্তি প্রকাশ করেছিলেন তারা। তাদের ভাষ্য মতে, ‘ভাগ্যিস কলকাতায় যাইনি। গেলে ঘটিদের ভাষায় খাচ্ছি-দাচ্ছি বলা শিখতে হতো। প্রাণ খুলে নিজেদের ভাষায় কথা বলা সম্ভব হতো না। নিজেদের আদি ভাষা হয়তো হারিয়ে যেত।’ ঢাকায় থাকি, ঢাকা থেকে এসেছি কেবল এটুকু পরিচয়েই তারা আমাকে পরম আত্মীয়জ্ঞানে বুকে জড়িয়ে ধরেন। সম্প্রদায়গত বিভাজনের লেশমাত্র তাদের আচরণে দেখিনি। মথুরা থেকে বৃন্দাবন হয়ে আগ্রা পর্যন্ত পরিবারটি আমাকে জোর করে তাদের সঙ্গে রেখেছিল। আমাকে বাইরে খেতে পর্যন্ত দেয়নি। তারাই খাইয়েছিলেন। আগ্রায় তিন দিন থাকার পর আমি দিল্লি আসব আর তারা যাবেন আজমিরের পুষ্কর নামক তীর্থস্থানে। তাদের কাছ থেকে বিদায়ের সময় আমারও ভীষণ খারাপ লেগেছিল। বারবার আমাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুুলিয়ে আশীর্বাদ করছিলেন। তাদের সেই আন্তরিক ও অভিব্যক্তিময় ভালোবাসার কথা কোনোদিন ভোলা যাবে না।

মযহারুল ইসলাম বাবলা : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়