তেজগাঁওয়ে বাসায় রহস্যজনক বিস্ফোরণে দুই শিক্ষার্থী দগ্ধ

আগের সংবাদ

১৫ সদস্যের দলে আট নতুন মুখ : আত্মবিশ্বাস নিয়ে বিশ্বকাপ মিশনে টাইগাররা

পরের সংবাদ

চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি সম্মেলন : দীর্ঘদিনের চাপা ক্ষোভ উগরে দিলেন তৃণমূল নেতারা

প্রকাশিত: অক্টোবর ৩, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ৩, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ভ্রাম্যমাণ প্রতিবেদক, চাঁদপুর থেকে : কেন্দ্রীয় নেতাদের সামনে দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ ও কষ্টের কথা তুলে ধরলেন আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতারা। জানালেন টানা তিন মেয়াদে দল ক্ষমতায় থাকলেও স্থানীয় নেতা ও সংসদ সদস্যদের অবহেলা, মামলা, বঞ্চনা ও নির্যাতন-নিষ্পেষণের কথা। তাদের কথায় উঠে এসেছে স্থানীয় আওয়ামী লীগে হাইব্রিড ও অনুপ্রবেশকারীদের দৌরাত্ম্যের তথ্যও। আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের কমিটিতে আত্মীয়করণসহ নিজেদের পছন্দের লোকদের ঠাঁই ও বিগত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকার বিরোধিতা করেও দলের পদে পুরস্কৃত হওয়াসহ নানা সমস্যা উঠে আসে। কেন্দ্রীয় নেতারাও এসব সমস্যা সমাধানে দিয়েছেন প্রয়োজনীয় নির্দেশনা।
চাঁদপুর জেলা স্টেডিয়ামে গতকাল শনিবার সকালে অনুষ্ঠিত তৃণমূল প্রতিনিধি সম্মেলনে কথা বলেন কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতারা। বেলা সাড়ে ১০টায় শুরু হওয়া এ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নাসির উদ্দিন আহমেদ। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু নঈম মোহাম্মদ দুলাল পাটোয়ারীর সঞ্চালনায় প্রতিনিধি সম্মেলনের শুরুতে বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন। শুরুতেই তিনি বলেন, এতদিন আমরা কেন্দ্রীয় নেতারা বক্তব্য দিয়েছি, তৃণমূলের নেতাকর্মীরা তা শুনেছেন। আজ তৃণমূল নেতারা বলবেন, আমরা কেন্দ্রীয় নেতারা শুনব। আজকে তৃণমূলের কথা বলার দিন। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেছেন আগামী নির্বাচনের ইশতেহার করার জন্য। আমরা যারা দায়িত্ব পেয়েছি, তারা চাই এই ইশতেহার তৃণমূল তৈরি করবে। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে কি কি করা উচিত সেটা আপনারা বলবেন। আমরা আপনাদের সব কথা শুনব। প্রতিনিধি সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ। এছাড়া উপস্থিত ছিলেন আরেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ডক্টর সেলিম মাহমুদ, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী

মায়া বীরবিক্রম, পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম, সংসদ সদস্য মেজর অবসরপ্রাপ্ত রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম, মুহাম্মদ শফিকুর রহমান ও নুরুল আমিন রুহুল।
প্রতিনিধি সম্মেলনে চাঁদপুর জেলার আটটি উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন, পৌর ও উপজেলা নেতারা বক্তব্য রাখেন। দলের স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও সমস্যার কথা তুলে ধরেন। গতকালের সভায় মূলত কচুয়া, মতলব উত্তর ও দক্ষিণ, হাইমচর, ফরিদগঞ্জ ও হাজিগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন সমস্যা উঠে আসে। শুরুতেই হাজিগঞ্জ উপজেলার একটি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক খোরশেদ আলম তার বক্তব্যে কেন্দ্রীয় নেতারা তৃণমূলের কথা শুনতে চাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি বক্তব্যে বলেন, আপনারা তৃণমূলের দিকে খেয়াল করুন, নজর দিন। বিগত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আমি নৌকা প্রতীক পেয়ে নির্বাচন করেছি। কিন্তু যিনি আমার বিরুদ্ধে নির্বাচন করেছেন। তাকে আবার ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এতে বিদ্রোহীরা আরো উৎসাহিত হচ্ছে। কচুয়া উপজেলার ৩নং ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি তার বক্তব্যে বলেন, আমরা ভাই ভাই হিসেবে থাকতে চাই। চাঁদপুরের কেন্দ্রীয় নেতারা এক হয়ে যান। ইনশাআল্লাহ আমরা একটা আদর্শ চাঁদপুর আওয়ামী লীগকে উপহার দেব। কচুয়া উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ও পৌর মেয়র নাজমুল আলম স্বপন উপজেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান বিভিন্ন সংকট তুলে ধরে বলেন, এখানে ১২টি ইউনিয়ন রয়েছে। সব কয়েকটিতে সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি গঠন করা হলেও তিনটি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে কার ইশারায়? তৃণমূলের খবর কেউ নেয় না। যদি আপনারা তৃণমূলের নেতাদের খোঁজখবর না নেন, তাহলে আগামী নির্বাচনে কেউ মাঠে নামতে চাইবে না। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ১২টি ইউনিয়নের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক মিলে ২৪ জন। কিন্তু কেন সেখানে ৩২ জন করা হলো। ইকবাল আজিজ শাহিন নামে কচুয়ার আওয়ামী লীগের আরেক নেতা তার বক্তব্যে বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে শুনেছি ত্যাগীদের মূল্যায়ন করা হবে। এই কথা শুনতে শুনতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর কেন্দ্রীয় নেতারা নিজেদের দল ভারি করার জন্য প্রতিযোগিতা শুরু করেন। এই কারণে দলে নানা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে। বিএনপি-জামায়াতের লোকজন বিভিন্ন কমিটিতে সুকৌশলে জায়গা করে নিচ্ছে। আজকে কচুয়া উপজেলা পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যানকে যেভাবে একের পর এক মামলা দিয়ে হেনস্থা করা হচ্ছে। তার বিরুদ্ধে আইসিটি অ্যাক্টে মামলা দেয়া হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে তাকে জামিন দেয়া হচ্ছে না। কেন? কার ইশারায়?
কচুয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান শিশির বলেন, গত দুই বছর দরে কচুয়ায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। কমিটির কোনো বৈঠক হয়নি। নানা বলয় সৃষ্টি হয়েছে। এই সমস্যার সমাধান করতে হলে কেন্দ্রীয় নেতাদের একমঞ্চে বসতে হবে।
মতলব দক্ষিণের সাংগঠনিক অবস্থা তুলে ধরে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ও নারায়নপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোমিন সুজন বলেন, দুই বছর ধরে মতলব দক্ষিণ আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, যুব মহিলা লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ কোনো ইউনিটের কমিটি নেই। নেতাকর্মীদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। সামনে নির্বাচন। তাই এখন থেকেই প্রত্যেকটি ইউনিট কমিটি গঠন করতে হবে। নইলে এই এলাকায় আওয়ামী লীগের ভরাডুবি ঘটবে। হাইমচরের একজন আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, কেউ দলের নাম বিক্রি করে ১০০ কোটি টাকার মালিক হবে আর কেউ নিজের জমি বিক্রি করে আওয়ামী লীগ করবে এটা হওয়া উচিত নয়।
চাঁদপুর পৌর আওয়ামী লীগের একজন নেতা তার বক্তব্যে বলেন, ২৮ বছরে মাত্র দুটি সম্মেলন পেলে কীভাবে রাজনীতি হবে। পৌর আওয়ামী লীগের সম্মেলন প্রয়োজন। আমাদের একটা চমৎকার গঠনতন্ত্র আছে। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ প্রতি তিন বছর পরপর সম্মেলন করে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ঠিকমতো সম্মেলন হয় না। আর সম্মেলন হলো পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনে লেগে যায় দুই থেকে তিন বছর। এভাবে সময় নষ্ট হচ্ছে। সংগঠন তার গতি হারাচ্ছে।
হাইমচর উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা নুরুল ইসলাম পাটোয়ারী তার বক্তব্যে বলেন, আগামী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলের যোগ্য লোকজন যেন মনোনয়ন পায়। অর্থ বা অন্য কোনো উপায়ে যেন কেউ মনোনয়ন না পায় সেটা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের কিছু কেন্দ্রীয় নেতা আছেন, তারা নিজেদের পছন্দমতো লোক নৌকার মনোনয়ন না পেলে, তারা নৌকার বিরুদ্ধে কাজ শুরু করেন।
মতলব দক্ষিণ আওয়ামী লীগের নেতা আকরাম হোসেন চৌধুরী বলেন, আমি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের সভাপতি। বর্তমান সাংসদের লোকেরা এজন্য আমার বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দিয়েছেন। আমরা অনেক চেয়ারম্যান আছি। তাই আমাদের স্থানীয় সংসদ সদস্য চোর বলে আখ্যা দেন। আজকে মতলব উত্তর দক্ষিণে আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাকর্মীদের অপমান করা হয়। আর সংসদ সদস্য দল চালাচ্ছেন বিএনপি ও জামায়াত-রাজাকার দিয়ে।
মতলব উত্তরের আরেকজন আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, এমন বর্ধিতসভা তৃণমূল সভা হয়। কিন্তু কখনোই কোনো সমাধান হয় না। এবার হয়তো সমাধান হবে। শোনা যায় মনোনয়ন কিংবা দলের পদের ক্ষেত্রে গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে তথ্য নেয়া হয়। এতে সঠিক রিপোর্ট যায় কিনা সন্দেহ। একটা কথা মনে রাখতে হবে, গোয়েন্দা সংস্থা আওয়ামী লীগকে পাহারা দেয় না। আওয়ামী লীগকে পাহারা দেয় তৃণমূলের নেতারা।
জেলা আওয়ামী লীগের একজন নেতা আগামী নির্বাচনে ইশতেহার প্রণয়নে তৃণমূলের মতামতকে প্রাধান্য দেয়ার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, বিভিন্ন দুর্যোগে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু তাকে কোনো প্রণোদনা দেয়া হয় না। এরপর কৃষকরা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সেই ভাবে আগামী নির্বাচনী ইশতেহার তৈরি করতে হবে। যারা দলের ইমেজ ক্ষতি করছে, তাদের বাদ দিয়ে যারা জনগণের পাশে ছিল, দলের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে সেই সব নেতাদের মূল্যায়ন করতে হবে। মতলবের আরেক আওয়ামী লীগ নেতা আবেগাপ্লæত কণ্ঠে বলেন, আমি মতলবের একটা ইউনিয়নে নৌকার মনোনয়ন পেয়েছি। কিন্তু নির্বাচনের সময় আমাকে এলাকায় ঢুকতে দেয়া হয়নি। জোর করে আমাকে হারিয়ে দেয়া হয়েছে। আমার এই দুঃখের কথা আমি কাউকে জানাতে পারিনি বা জানালেও কোনো লাভ হয়নি। যারা আমাকে লাঞ্ছিত করেছে, নৌকাকে হারিয়েছে- তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হোক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়