নলডাঙ্গা : আ.লীগ-বিএনপি নেতাসহ আটক ১১ জুয়াড়ি

আগের সংবাদ

উন্নয়নের ভোগান্তি আর কত : কোনো প্রকল্পই শেষ হয় না নির্ধারিত সময়ে, বছরজুড়েই চলে সেবা সংস্থাগুলোর খোঁড়াখুঁড়ি

পরের সংবাদ

মেহের ও জোবায়দার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশিত: অক্টোবর ২, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ২, ২০২১ , ১২:৫০ পূর্বাহ্ণ

বিখ্যাত ভ্রাতৃদ্বয় পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ বি এম আব্বাস এ টি এবং এক কালের উপ-প্রধানমন্ত্রী এস এ বারী এ টির বোন মেহেরুন্নেসার ম্যাট্রিকুলেশনের সময়কার নাম বাবার নাম সংযুক্ত হয়ে মেহের তৈমুর। তিনি দিনাজপুর সরকারি বালিকা বিদ্যালয় থেকে হিন্দু ও মুসলমান ছাত্রীদের মধ্যে প্রথম দুই লেটারসহ প্রথম বিভাগ পেয়ে স্কুলে আনুষ্ঠানিকভাবে পুরস্কৃত হয়েছেন। ১৯৩৬ সালে তিনি ভর্তি হলেন কলকাতার বেথুন কলেজে। তার বড় বোন কামরুন্নেসা ছিলেন বেথুন কলেজের প্রথম মুসলমান ছাত্রী। দুই বোনের মাঝখানে আরো দুজন মুসলমান নারী বেথুনে যুক্ত হন- সৈয়দা জাহানারা বেগম এবং আখতার ইমাম। বেথুনে তার শিক্ষকদের একজন ছিলেন গণিতের স্বর্ণপদক বিজয়ী ফজিলাতুন্নেসা জোহা।
মেহের দুই বছর পর রসায়ন শাস্ত্রে বিএসসি পড়তে চলে এলেন স্কটিশ চার্চ কলেজে। ১৯৩৮ থেকে ১৯৪২ স্কটিশ চার্চ পর্ব শেষে ভারত সরকারের একটি গবেষণা বৃত্তি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নে অধ্যাপক জে কে চৌধুরীর অধীনে গবেষণায় যোগ দিলেন; এই বিখ্যাত অধ্যাপকের অধীনে তখন আরো একজন মেধাবী গবেষক মোহাম্মদ মোকাররম হোসেন কাজ করছেন। গবেষণা বৃত্তি ছিল ৭৫ টাকা, যার প্রায় সবটাই ঘোমটা ঢাকা ঘোড়ার গাড়ির ভাড়া শোধ করতে ফুরিয়ে যেত। এসে নামতেন প্রমীলাবর্জিত কার্জন হলে। কলকাতার অভ্যাসমতো দুধ আর বিস্কুট দিয়ে লাঞ্চ সারছিলেন দেখে ডক্টর ওসমান গনি (ষাটের দশকের ভাইস চ্যান্সেলর) কিছুদিন তার জন্য সলিমুল্লাহ হল থেকে দুপুরের খাবার আনিয়ে দিতেন। মেয়েদের হলে সিট পেয়ে থাকার পর এসব সমস্যা মিটে যায়।
১৯৪৪-এর মার্চে রসায়ন গবেষণাগারে সলভেন্ট রি-এজেন্ট হিসেবে ব্যবহারের জন্য নাইট্রিক এসিড আনার সময় বেয়ারার অসতর্কতায় বোতল বিস্ফোরিত হয়। তার দু’পায়ের অনেকটা অংশ পুড়ে যায়। মিটফোর্ড হাসপাতালে তিন মাস চিকিৎসার পর সেরে ওঠেন। ঢাকার সম্ভ্রান্ত ক’টি পরিবারের সঙ্গে তার সখ্য গড়ে ওঠে। তিনি বিশেষ করে তৈফুর সাহেব ও সারা তৈফুরের তিন সংগীত শিল্পকন্যার কথা স্মরণ করেন- লুলু বিলকিস বানু, লায়লা আর্জুমান্দ বানু এবং মালকা বানু।
ইংরেজির অধ্যাপক মিস চারুপমা বোস ছিলেন উইমেন্স হোস্টেলের সুপার। ১৫-১৬ জন ছাত্রী থাকতেন, মেস পদ্ধতিতে তাদের খাওয়া-দাওয়া চলত। ১৯৪৪ সালে হোস্টেলের ছাত্র ইউনিয়ন নির্বাচনে মেহের হলেন ভিপি আর করুণা গুপ্ত জিএস। ‘সে বছরই ডাকসুর ভিপি বিশেষ কারণে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করলে আমি ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হই কিছুদিনের জন্য।’
তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সঙ্গে মুনীর চৌধুরী নানাভাবে জড়িত, সে সূত্রে তার বড় ভাই কবীর চৌধুরীর সঙ্গে তার পরিচয়, প্রণয় ও বিয়ে।
বেশ ক’টি কলেজে অধ্যাপনা ও অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালনের পর রোকেয়া হলের প্রভোস্টের দুই বছরের শিক্ষাকালীন ছুটির সময় ১৯৬৩ থেকে দুই বছর প্রভোস্টের দায়িত্ব পালন করতে নিযুক্ত হন, সেই সঙ্গে ফলিত রসায়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপকও থাকবেন। তখন ভাইস চ্যান্সেলর ড. ওসমান গনি। অন্যান্য হলের প্রভোস্টরা ছিলেন ড. মফিজউদ্দিন আহমদ, ড. মুখলেসুর রহমান, ড. মতিন চৌধুরী, ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব ও শফিউল্লাহ। প্রভোস্ট হওয়ার কারণে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হওয়া ছাড়াও ড. শহীদুল্লাহ, অধ্যাপক মনসুর উদ্দিন, কাজী মোতাহার হোসেন প্রমুখ পণ্ডিতের সঙ্গে রেডিও অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার দুর্লভ সুযোগ পেতেন।
মেহের কবীরের কর্মজীবনের একটি স্মরণীয় অধ্যায় রোকেয়া হলের দুই বছরের প্রভোস্ট জীবন। তিনি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তার রসায়ন শিক্ষকদের অন্যতম ছিলেন প্রফেসর জে কে চৌধুরী, ড. সর্বানীসহায় গুহঠাকুরতা, ড. এ টি সেন প্রমুখ। কিন্তু তাদের ছাড়িয়েও নিকট সম্পর্ক স্থাপিত হলো প্রফেসর সত্যেন বোস, ড. জুনারকর, ড. মহেশ্বরী, ড. আয়ার, ড. সুশীল কুমার দে, ড. এইচ এল দে, ড. মাহমুদ হোসেন, ড. কাজী মোতাহার হোসেন- প্রথিতযশা বহু মনীষীর সঙ্গে। ‘প্রফেসর সত্যেন বোসের দেয়া একটি টেস্টিমোনিয়াল আজো আমার নিজস্ব সম্পদের মধ্যে সযতেœ রক্ষিত আছে।’
মেহের কবীর জানাচ্ছেন ড. সাদানী, ড. মাজাহারুল হক, ড. জিলানী, অধ্যাপক সমর সেন, এ কে দাশগুপ্ত, ড. এস এন রায়- সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আলোকিত রাখতেন। তিনি প্রফেসর আন্দালিব সাদানীকে নিয়ে একটি ব্যক্তিগত কাহিনী তুলে ধরেছেন :
কার্জন হলের সামনে বিরাট উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে চায়ের আসর বসেছে; কিছু সম্মানিত অতিথি অধ্যাপকবৃন্দ ও তাদের স্ত্রী এবং আমরা কয়েকজন ছাত্রী। আমি বসেছি যে টেবিলে সেখানে ছয়জন। আমার স্থান পড়েছে ড. সাদানীর পাশে। দু’একটা কথার পর আমাকে বললেন : আই অ্যাম প্রাউড টু বি প্লেসড নেয়ার সাচ এ চার্মিং ইয়াং লেডি।
আমার অবস্থা ভাবুন, আমি বললাম, প্লিজ স্যার, আই ফিল সে অ্যাম্বারাসড। তিনি আমার কাঁধে হাত রেখে ফিসফিস করে বললেন, ‘হোয়াট, ইউ হ্যাভ দ্য মোস্ট স্পার্কলিং ওয়াল্ডারফুল আইস দ্যাট আই হ্যাভ এভার সিন!’ যারা ড. সাদানীকে চেনেন তারাই জানেন তার কথার ভঙ্গি চমৎকার উদ্দীপক এবং ছোট ছোট কাহিনী ও কোটেশনে ভরা থাকত তার গল্প। এই হৃদয়বান ব্যক্তিটির সঙ্গে পরবর্তীকালে আবার আমি একত্রে নিকটতম হয়েছি তার শেষের জীবনে, পাকিস্তানের মারিতে, এক সাহিত্য সম্মেলনে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ স্মরণ করতে গিয়ে স্মৃতির মিছিলে অধ্যাপক আন্দালিব সাদানীর নাম অবশ্যই এসে যাবে। উর্দু ও ফার্সি সাহিত্যের স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব আন্দালিব সাদানীর জন্ম ১৯০৪ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের মুরাদাবাদে। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী সাদানী দিল্লির হিন্দু কলেজে কিছুকাল শিক্ষকতার পর ১৯২৮ সালে উর্দু ও ফার্সি বিভাগ খোলার জন্যই তাকে আমন্ত্রণ জানান। তিনি সাফল্যের সঙ্গে কাজটি করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা অবস্থায় ভারতের মুসলমান ঐতিহাসিকদের নিয়ে সন্দর্ভ রচনা করে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি লাভ করেন। ১৯৪৭ সালে তিনি অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পান। উর্দু ভাষার প্রতি তার জন্মগত দুর্বলতা ও পক্ষপাত থাকার পরও ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ অনুষ্ঠানের আয়োজনে তারও ভূমিকা ছিল।
২৯ জুলাই ১৯৬৯ সালে তিনি ঢাকাতেই মৃত্যুবরণ করেন।
ডাকসুতে কাজ করতে গিয়ে তিনি কয়েকজন ‘অকৃত্রিম অনুজপ্রতীম বন্ধু’ লাভ করেন- তাদের মধ্যে রয়েছেন কে এম আহসান, আহমেদুল কবির, সানাউল হক, সৈয়দ নুরউদ্দীন, খায়রুল কবীর। সবাই মিলে ‘এসাইলাম’ নামে একটি ঘরোয়া সংঘও সৃষ্টি করেছিলেন। ১৯৪৫ সালে মেহের ও কবীর চৌধুরীর বিয়েতে ‘এসাইলাম’-এর পক্ষ থেকে সানাউল হক একটি কবিতায় এবং সৈয়দ নুরউদ্দীন একটি চিঠিতে নবদম্পতিকে স্বাগত জানিয়েছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার চল্লিশের দশকের দিনগুলো- স্মৃতিকোলাজ থেকে আরো দুজন শিক্ষকের কথা উদ্ধৃত করছি :
‘আমাদের ভাইস চ্যান্সেলর ড. মাহমুদ হাসান।… ড. হাসান অবশ্য সপ্তাহে কয়েক ঘণ্টা ইংরেজি বিভাগের ক্লাস নিতেন। আমরা ছাত্রী নিবাসের মেয়েরা এবং ডাকসুর প্রতিনিধিরা তাকে কাছ থেকে দেখার প্রচুর সুযোগ পেয়েছিলাম। জ্ঞানী, যশস্বী এই পুরুষটির মার্জিত হৃদয়ের কমনীয়তা ও সহানুভবতা মিশ্রিত সহযোগিতার বহু প্রমাণ আমরা পেয়েছি।’ ১৯৬৯ সালে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের একটি ইন্টারভিউতে তার সঙ্গে ড. হাসানের শেষ সাক্ষাৎ যখন তিনি তাকে হোম ইকোনমিক্স কলেজের রসায়নের প্রফেসর হিসেবে মনোনয়ন দান করেন এবং তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের জন্য বৃত্তি লাভ করেন।
অপরজন- ঋষিতুল্য মনীষী ড. শহীদুল্লাহর সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে বাবার বন্ধু ও বড় বোনের শিক্ষক হিসেবে। তার বাসার দ্বার আমার জন্য সর্বদা মুক্ত ছিল, যার ফলে তার স্ত্রী ও মেয়েদের সঙ্গেও অন্তরের যোগসূত্র স্থাপিত হয়েছিল। ঢাকায় আমার প্রথম দিনগুলোতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা শেষ হয়ে গেলেও তার রেশ কিছুটা মাঝে মাঝেই চলছিল। বিজ্ঞান বিভাগের হিন্দু-মুসলমান সব ছাত্র মিলে ঠিক করে দিল আমার গবেষণা কক্ষের দিকে কোন দল কখন দৃষ্টি রাখবে এবং প্রয়োজনবোধে কক্ষের পেছন দরজা দিয়ে বেড়া ডিঙ্গিয়ে রাস্তার পাশে অবস্থিত ড. শহীদুল্লাহর বাসায় আমাকে চলে যাওয়ার ইশারা জানাবে।
অবশ্য তেমন জরুরি অবস্থা কখনো সৃষ্টি হয়নি।
(একটি ভিন্ন স্মৃতি : সত্তরের দশকে যখন শক্তিমান কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমানের সঙ্গে পরিচিত হই, তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন আন্দালিব রাশদী কি কোনোভাবে আমার বন্ধু আন্দালিব সাদানীর সঙ্গে সম্পর্কিত? আমি সবিনয়ে বলেছিলাম একমাত্র আদম সূত্রে সম্পর্কিত, যতদূর জানি অন্য কোনো সম্পর্ক নেই। পাদটীকায় অধ্যাপক আন্দালিব সাদানীর কন্যা নিশাত সাদানীর কথা একটু উল্লেখ করতেই হয়। নিশাত ১৯৫৯ সালে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন। স্মৃতিকাতর কেউ কেউ যা লিখেছেন তাতে নিশ্চিত হওয়া যায় নিশাত অনেকেরই নিদ্রাহরণ করেছেন।)

হাউস টিউটরের কন্যা
জোবায়দা মির্যা চল্লিশের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, কিন্তু তার বাবা ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ৮-৯ বছর এবং ফজলুল হক হলে ১১-১২ বছর হাউস টিউটর ছিলেন। প্রক্টর হিসেবেও অনেক বছর। জোবায়দা মির্যাও ইংরেজির অধ্যাপক, ঢাকা কলেজে সরাসরি আমার শিক্ষক ছিলেন। তিনি তার বাবার ব্যাপক গণসংযোগের কথা বলেন এবং জানান বাবার কারণে অনেক নামকরা শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারের সঙ্গে তার আন্তরিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে- করুণা গুপ্তা, হেমলতা, প্রতিভা সোম (রানু), ফজিলাতুন্নেসা- প্রত্যেকেই খ্যাতিমান। আব্বুর সঙ্গে সাইকেলে চড়ে আমিও বহুবার গিয়েছি এসব বাড়িতে- কত যে সন্দেশ, নাড়–, মোয়া, বরই ইত্যাদি খেয়েছি। এদের মধ্যে করুণা গুপ্তা ও ফজিলাতুন্নেসা ছিলেন ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। প্রথম জনের বাবার নামটা সবাই ভুলেই গিয়েছিল। তিনি পরিচয় দিতেন ‘আমি করুণার বাবা’। করুণা গুপ্তার হাতের এমব্রয়ডারি করা চায়না সিল্কের ফ্রকটা আমার অত্যন্ত পছন্দের বেড়াতে যাওয়ার জামা ছিল। …ফজিলাতুন্নেসার (মিসেস জোহা) দেওয়ান বাজারের মোড়ে চৌরাস্তার ছোট্ট বাড়িটা আমার স্পষ্ট মনে আছে আজো। সে বাড়িতে ছিল তার বাবা-মা, বোন সফিকুন্নেসা ও আরো দুটি বোন। …রানু সোম হলেন বুদ্ধদেব বসুর স্ত্রী প্রতিভা বসু, ফাঁকে কাজী নজরুল ইসলাম গান শোনাতেন দিলীপ রায়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে- শ্রেষ্ঠ গায়িকা হিসেবে গড়ে তুলবেন বলে। ওদিকে দিলীপ বাবু শেখাতেন রেনুকা সেনকে, যার নামের অক্ষরগুলো উল্টে নিয়ে কবিকাকা দিলীপবাবুর নামকরণ করলেন ‘কানু রে’।’ রেনুকার গানের রেকর্ড বের হলো, ‘পাগলা মনটারে তুই বাধ’ আর ‘যদি গোকুলচন্দ্র ব্রজে না এল’- এ গানের সূত্র ধরে জোবায়দা কবি নজরুল আর নিজের বাবা-মার সঙ্গে রানু সোমদের ওয়ারীর একতলা বাড়িতে এলেন, একটা সিঁড়ি চিলেকোঠা ও ছাদে চলে গেছে- ছাদে আচার ও বড়ি শুকানো হতো। সেখানে বানর এসে হামলা করত। বিকালে সে ছাদে বসত গানের আসর। পাড়ার গুণ্ডা ছেলেদের কারণে নজরুলের গান শেখানো বেশিদূর এগোয়নি, রানুর গানের রেকর্ডও বের হয়নি। তাতে কিশোরী জোবায়দার তেমন ক্ষতি হয়নি, কারণ তিনি যে আচার ও চাটনির জন্য ওই বাড়িতে ঘুরঘুর করতেন তার সরবরাহে কখনো ঘাটতি পড়েনি।
প্রাইমারি স্কুলে পড়া জোবায়দার স্মৃতি জেগে আছে হাতিরপুলের সবচেয়ে কাছের বাড়িটা মোহিতলাল মজুমদারের। একদিন গিয়েছি মোহিতবাবুর বাড়ি। সেখানে বোধহয় কোনো পূজা ছিল। সবার সঙ্গে বারান্দায় উঠতে গেছি, একজন ফিসফিসিয়ে বললো, ‘ও কিন্তু মুসলমান’। তখন ওরা আমাকে বললো, ‘তুই নিচে একটু দাঁড়া, আমরা আসছি, এক সঙ্গে বাড়ি যাব।’ আমি দারুণ ক্ষুণ্ন হয়ে মøান মুখে উঠোনে দাঁড়িয়ে রইলাম। মোহিতবাবু আমাকে দেখতে পেয়ে কাছে এসে আদর করে বললেন, ‘কী অন্যায়, ওরা তোমাকে নিল না। আচ্ছা, তুমি আমার সঙ্গে এসো।’
কবি তার কোঁচড় ভরে বাগানের ফুল আর মটরশুঁটি তুলে দিলেন। ‘ব্যবহারের ওই পার্থক্যে ওই বয়সেও আমার চোখে পানি চলে এলো। উনি তাও মুছিয়ে দিলেন।’
মোহিতলাল মজুমদারের পরের বাড়িটা ঐতিহাসিক সুশোভন সরকারের, তার পরেরটা মাদ্রাজি অধ্যাপক শ্রী বিজয় রাঘবনের। তিনি প্রফেসর পি কে গুহ, ড. সুরেশ মিত্র, ড. ধীরেন গাঙ্গুলী, ড. দেবেন ব্যানার্জির বাড়ির কথা বললেন। যেখানে এখন কলা ভবন সেখানে লাল টুকটুকে একটি বাগানবেষ্টিত বাড়ি। সেখানে থাকতেন ড. কে ডি ঘোষ। রাস্তার উল্টো দিকে ধবধবে সাদা বাড়িতে ভাইস চ্যান্সেলর রমেশচন্দ্র মজুমদার- এটাই এখন ভিসির বাড়ি। ব্রিটিশ কাউন্সিলের জায়গাটি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের প্রভোস্ট ড. মাহমুদ হাসানের মেয়ে রিফির টাট্টু ঘোড়া এখানে চড়ে বেড়াত। ড. হাসান যে বাড়িটাতে থাকতেন পরে এখানে উঠেন অধ্যাপক রাজ্জাক; অন্য একটি বাড়িতে ড. এইচ এল দে। হাতিরপুলে আরো ছিলেন পি কে গুপ্ত, ড. হরিসাধন ভট্টাচার্য, ড. কে জে চৌধুরী, মিস ম্যাককে। অধ্যাপকদের মধ্যে ড. এস এন রায়, ড. জে কে চৌধুরী, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ড. কাজী মোতাহার হোসেন সেগুনবাগিচায় বাড়ি করেন।
‘এখন যেটা প্রেস ক্লাব সেখানে থাকতেন প্রফেসর সত্যেন বোস। তার মেয়েরা আমাদের সঙ্গে পড়ত। বাড়িটা সম্পূর্ণ ফুলে ফুলে ঢাকা ছিল। বড় বড় গাছগুলো থেকে আরম্ভ করে ছাদ পর্যন্ত নানা রঙের বাগানবিলাস, মাধবী, মালতী, হাসনাহেনা, আরো কত ফুল বর্ণ ও সুগন্ধি ছড়িয়ে যেন স্বপ্নপুরী সৃষ্টি করত।’
মুসলমান অধ্যাপকদের অধিকাংশই পশ্চিমা; বাঙালি দুজন- ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এবং ড. সিরাজুল হক- তাদের সঙ্গে জোবায়দার পরিবারের ‘কিছুটা আত্মীয়তার এবং অনেক বেশি সৌহার্দের’ সম্পর্ক ছিল। জোবায়দা মির্যা তার বাবা ড. কাজী মোতাহার হোসেনের কথা লিখেছেন- শিক্ষিত, অর্ধ-শিক্ষিত, অশিক্ষিত নির্বিশেষে সবার সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ‘সর্বত্র স্বচ্ছন্দ গতিবিধি চকবাজারের পনিরওয়ালা, মিটফোর্ড হাসপাতালের গেটের ধারে ছালা বিছিয়ে বসত এক মুচি, কলতাবাজারের মাখন বাবু, সিদ্দিকজারের এক শয্যাশায়ী জমিদার, যার সর্বাঙ্গে বেডসোর, হাকিম হাবিবুর রহমান সাহেব, কত নাম বলব- সবাই দাবা খেলার সঙ্গী। আব্বু সবার সঙ্গে মিশতেন অকপটে, তাই বলে স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে ফেলেননি কখনো। কলকাতায় গিয়ে ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে দাবা খেলতে বসলে বিশ্বব্রহ্মান্ড ভুলে যেতেন, রাত দেড়টা-দুটোর আগে কখনোই বাড়ি ফেরা হতো না। অথচ এরই ফাঁকে কখন মন্তব্য করেছেন যে শরৎসাহিত্যে মুসলিম সমাজচিত্র একেবারে অনুপস্থিত, যদিও মুসলমানরা এ দেশের বিরাট একটা অংশজুড়ে হিন্দুদের পাশাপাশি অবস্থান করে আসছে। তারপর লেখা হলো শরৎচন্দ্রের বিখ্যাত ছোটগল্প ‘গফুর’। এটাই লেখকের একমাত্র মুসলিম সমাজচিত্র। আব্বু এতেও খুশি হননি, বলেছিলেন- ‘নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো’- গফুর কখনো সমগ্র মুসলিম সমাজের প্রতিভূ হতে পারে না- সে হচ্ছে বিত্তহীনদের নিম্নতম স্তরের একজন মাত্র।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় যখন কথাসাহিত্য সম্রাট শরৎচন্দ্রকে উপেক্ষা করল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে প্রদান করল ডিলিট।

ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে, নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়