হাসেম ফুডে অগ্নিকাণ্ড : ৩ মাস পর দগ্ধ ছেলের মরদেহ পেলেন বাবা

আগের সংবাদ

রোহিঙ্গাদের অস্ত্র-অর্থের উৎস কী

পরের সংবাদ

স্মরণ : বিপ্লবী মহীয়সী লীলা রায় স্মরণে

প্রকাশিত: অক্টোবর ১, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ১, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

২ অক্টোবর ২০২১ বিপ্লবী লীলা রায়ের ১২১তম জন্মবার্ষিকী। ১৯০০ সালের এই দিনে আসামের গোয়ালপাড়ায় তার জন্ম। তার পিতার নাম গিরীশচন্দ্র নাগ এবং মাতার নাম কুঞ্জলতা নাগ। পিতা দর্শন শাস্ত্রের কৃতী ছাত্র ছিলেন। প্রথম জীবনে অধ্যাপনা শুরু করলেও পরে তিনি আসাম সিভিল সার্ভিসে যোগদান করেন। তাদের পৈতৃক নিবাস ছিল মৌলভীবাজার জেলার পাঁচগাঁও গ্রামে। লীলা রায়ের জন্মের সময় তিনি গোয়ালপাড়ার মহাকুমা হাকিম ছিলেন। লীলা রায়ের পরিবার ছিল উচ্চ শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত, সেই সঙ্গে জাতীয়তাবাদী চেতনা ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ। লীলা রায়ের নাম ছিল লীলাবতী নাগ। ১৯৩৯ সালে বিপ্লবী অনিল রায়ের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর থেকে তিনি লীলা রায় নামে পরিচিত হন। ১৯১৭ সালে তিনি ঢাকার ইডেন গার্লস স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাস করে ১৯২১ সালে কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে ইংরেজিতে সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে এমএ ক্লাসে ভর্তি হন। উল্লেখ্য যে, সেই বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় এবং লীলা রায় ছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী। সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে সহশিক্ষার ব্যবস্থা ছিল না বলে প্রথমে তার আবেদনপত্র বিবেচনা করা হয়নি। কিন্তু লীলা রায়ের তীব্র প্রতিবাদের মুখে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ড. ডব্লিউ হার্টগ তাকে শেষ পর্যন্ত ভর্তির অনুমতি দিতে বাধ্য হন।
সে সময় নারীদের কোনো ভোটাধিকার ছিল না। লীলা রায় নারী ভোটাধিকার আদায় কমিটির সহ-সম্পাদিকা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বেথুন কলেজে থাকাকালেই তিনি দেশসেবার ব্রত গ্রহণ করেন। তখন থেকেই তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়সহ বাংলার বিভিন্ন মনীষীর সঙ্গে পত্র লেখার মাধ্যমে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তিনি সমাজে পিছিয়ে পড়া নারীদের অধিকার আদায়ে তাদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার জন্য সংগ্রাম শুরু করেন। এই উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে ১৯২৩ সালে তিনি ১২ জন সদস্য নিয়ে ঢাকায় দীপালি সংঘ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংঘের উদ্দেশ্য ছিল ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ বাংলার নারী সমাজকে শিক্ষাদীক্ষা জ্ঞান ও কর্মের মাধ্যমে সমাজে মাথা উঁচু করে চলতে সাহায্য করা। ঢাকার পাড়ায় পাড়ায় দীপালি সংঘের শাখা স্থাপিত হয়। প্রতিষ্ঠার কয়েক বছরের মধ্যেই দীপালি সংঘের নারী মুক্তির আন্দোলন দেশ মাতৃকার মুক্তির বৈপ্লবিক আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। দীপালি সংঘের উদ্যোগে লীলা রায় ঢাকায় নিউ হাইস্কুল, নারী শিক্ষা মন্দির, শিক্ষা ভবন ও শিক্ষা নিকেতন এই চারটি উন্নতমানের স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া তিনি ১২টি অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ বেশ কিছু নৈশ বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন।
লীলা রায় উপলব্ধি করেছিলেন যে মাতৃভূমির মুক্তির সঙ্গেই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল মানুষের মুক্তি নিহিত। লীলা রায় প্রথম জনসমক্ষে বক্তৃতা করেন ১৯২৩ সালে ঢাকায় হিন্দু সমাজে সম্পত্তির উত্তরাধিকার সংক্রান্ত প্রচলিত দায়ভাগ প্রথার বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে। একটি বক্তৃতার মাধ্যমেই সারা ঢাকা শহরে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে। তিন বছর পর তারই অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ৮ ফেব্রুয়ারি (১৯২৬) ঢাকায় দীপালি সংঘের সাধারণ সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদান করেন। সেবার রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক তাকে দেয়া সংবর্ধনায় যোগ দিতে ঢাকায় আসেন। রবীন্দ্রনাথ তার বক্তৃতায় উল্লেখ করেন যে এশিয়ার কোথাও তিনি এত বড় মহিলা সমাবেশ দেখেননি। রবীন্দ্রনাথ লীলা রায়ের সাংগঠনিক দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে তাকে শান্তিনিকেতনে যোগদানের আহ্বান জানান। কিন্তু লীলা রায়ের চিন্তায় ছিল সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে দেশকে ব্রিটিশ শাসনমুক্ত করা। এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে দীপালি সংঘ বিপ্লবী প্রতিষ্ঠান ‘শ্রীসংঘ’-এর সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে। ১৯২৮ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে লীলা রায় বাংলার নারী আন্দোলনের ইতিহাস সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা দেন। তার বক্তৃতা শুনে নেতাজি অভিভূত হয়ে পড়েন। ওই বছর বিপ্লবী যতীন দাস একটানা দুই মাস লাহোর জেলে অনশন করে আত্মাহুতি দেন। তার স্মরণে কলকাতার হলওয়েল মনুমেন্টে অনুষ্ঠিত সভায় পুলিশ লাঠিচার্জ করলে নেতাজি আহত হন। এর প্রতিবাদে লীলা রায়ের নেতৃত্বে মেয়েদের যে বিরাট মিছিল হয় তা দেখে ঢাকাবাসী বিস্মিত হয়ে যায়। ঢাকার রাজপথে মেয়েদের মিছিল ছিল সেকালে অকল্পনীয়। ১৯৩৯ সালের ২৯ জানুয়ারি ত্রিপুরীতে কংগ্রেসের অধিবেশনে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে নেতাজি সুভাষ বসুর দ্ব›েদ্ব অনীল রায় এবং লীলা রায় দৃঢ়ভাবে সুভাষ বসুকে সমর্থন করেন। কংগ্রেসের সেই অধিবেশনে সভাপতি নির্বাচনে প্রফুল্ল ঘোষের নেতৃত্বে বাংলার ৭৯ জন সদস্য সুভাষ বসুর বিরুদ্ধে গান্ধী সমর্থিত সিতারামাইয়ার পক্ষে ভোট প্রদান করেন। এমনকি স্বরাজ পার্টির নেতা কিরণ শংকর রায়ও সেদিন সুভাষের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন, শুধু গান্ধীকে সন্তুষ্ট করার জন্য। বাংলার হিন্দু নেতাদের গান্ধীর প্রতি এবং মুসলমান নেতাদের জিন্নাহর প্রতি নিঃশর্ত সমর্থন বাংলা ও বাঙালির জীবনে অনেক দুর্ভোগের কারণ হয়েছিল। সুভাষ বসু কংগ্রেস ত্যাগ করে ফরওয়ার্ড ব্লক গঠন করলে লীলা রায় নেতাজির আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে এই দলে যোগদান করেন।
লীলা রায়ের জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে ‘জয়শ্রী’ পত্রিকা প্রকাশ। মেয়েদের দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ করে কর্মক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রেরণা জোগানোর উদ্দেশ্যে তিনি একটি পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কাছে চিঠি লিখেন। রবীন্দ্রনাথ পত্রিকাটির ‘জয়শ্রী’ নামকরণ করেন এবং নিম্নোক্ত বাণী প্রদান করেন :

‘বিজয়িনী নাই তব ভয়
দুঃখে ও বাধায় তব জয়।
অন্যায়ের অপমান
সম্মান করিছে দান
জয়শ্রীর এই পরিচয়।’
রবীন্দ্রনাথের এই বাণীসহ ১৯৩১ সালের মে মাসে (বৈশাখ ১৩৩৮) ঢাকা থেকে লীলা রায়ের সম্পাদনায় ‘জয়শ্রী’র প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়। ১৯৩১ সালের ডিসেম্বর মাসে সরকার সশস্ত্র বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে লীলা রায়কে গ্রেপ্তার করে ‘জয়শ্রী’র প্রকাশনাও নিষিদ্ধ করে দেয়। প্রায় ছয় বছর সাত মাস কারাভোগের পর ১৯৩৮ সালের আগস্ট মাসে লীলা রায় মুক্তিলাভ করেন। তার মুক্তিলাভের পর পরই ‘জয়শ্রী’ পত্রিকা আবার প্রকাশিত হতে শুরু করে। ১৯৪২ সালে আবার লীলা রায়কে গ্রেপ্তার করা হয়। সেই সঙ্গে পুনরায় নিষিদ্ধ করা হয় ‘জয়শ্রী’ পত্রিকা। এ যাত্রায় কয়েক বছর কারাভোগের পর ১৯৪৬ সালে তিনি মুক্তিলাভ করেন। নেতাজির সঙ্গে হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণ আন্দোলনের সময়ে লীলা রায় ও অনিল রায়কে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে সে যাত্রায় এক মাস পরেই তারা মুক্তি পান। নেতাজি তার অন্তর্ধানের পূর্বে ফরওয়ার্ড ব্লকের গুরুত্বপূর্ণ কিছু দায়িত্ব লীলা রায়ের ওপর অর্পণ করে যান। লীলা রায় আজাদ হিন্দ ফৌজের সঙ্গে গোপন যোগাযোগ স্থাপন করেন।
১৯৪৬ সালের ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় তিনি মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে নোয়াখালীতে শান্তি মিশনে অংশ নিয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগ তাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে। ভারতকে অখণ্ড রাখার প্রচেষ্টায় তিনি গান্ধী, নেহরুসহ তৎকালীন জাতীয় নেতাদের দ্বারে দ্বারে ধরনা দেন, কিন্তু ব্যর্থ হন। দেশ বিভাগের পর লীলা রায় আবার ঢাকায় ফিরে আসেন। কিন্তু তার প্রতি সাম্প্রদায়িক মুসলিম লীগ সরকারের বিরূপ আচরণের কারণে ১৯৫০ সালে আবার ভারতে ফিরে যান এবং পূর্ব বাংলা থেকে ভারতে প্রত্যাবর্তনকারী উদ্বাস্তুদের পুর্নবাসনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি নেতাজির আদর্শিক রাজনীতিতে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত নিজেকে নিয়োজিত রাখেন।
যে ঢাকা শহর ছিল লীলা রায়ের প্রধান কর্মক্ষেত্র এবং ঢাকা শহরের বকশীবাজার, আজিমপুর, টিকাটুলী, উয়ারী, কয়েতটুলী, ঠাটারীবাজার, তাঁতীবাজার, বাংলাবাজার, ল²ীবাজার প্রভৃতি এলাকা যার কর্মযজ্ঞের কেন্দ্র ছিল, যিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম একমাত্র ছাত্রী সেই লীলা রায়ের নামে ঢাকার কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো হলের বা অন্য কোনো স্থাপনার নামকরণ করা হয়নি। শুধু তাই নয় তার প্রতিষ্ঠিত স্থাপনার অনেকগুলোই হয় বিলুপ্ত হয়েছে নয়তো অন্য নামে দাঁড়িয়ে আছে। হাটখোলাতে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘নারী শিক্ষা মন্দির’ নামে মেয়েদের স্কুল ও কলেজ। বর্তমানে এই কলেজের নাম ‘শেরে বাংলা মহিলা স্কুল ও কলেজ’। অভয় দাস লেনে তার প্রতিষ্ঠিত ‘দিপালী স্কুল’-এর বর্তমান নাম ‘কামরুন্নেসা হাই স্কুল’।
২০০০ সালে লীলা রায়ের জন্ম শতবার্ষিকী পালন উপলক্ষে প্রফেসর জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীকে সভাপতি এবং প্রফেসর অজয় রায়কে সাধারণ সম্পাদক করে ঢাকায় ‘বিপ্লবী লীলা নাগ জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন পরিষদ’ গঠন করা হয়। প্রফেসর মাহফুজা খানম এবং আমি এই পরিষদের যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। আমাদের বেশিরভাগ সভা অনুষ্ঠিত হতো মাহফুজা আপার রাজাবাজারের বাসায়। উদযাপন পরিষদের পক্ষ থেকে আলোচনা অনুষ্ঠান ছাড়াও একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকলন প্রকাশ করা হয়েছিল।
লীলা রায়ের জন্ম শতবার্ষিকী উপলক্ষে ২০০০ সালে কলকাতায় জয়শ্রীর উদ্যোগে দিনব্যাপী আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বিজ্ঞান ও কারিগরি সহায়তা সংক্রান্ত একটি বৈঠকে যোগদানের জন্য সে সময় কলকাতায় অবস্থানের সুযোগে আমি সেই অনুষ্ঠানে যোগদান করি। লীলা রায় ও অনীল রায়ের অনুজ বেশ কয়েকজন সহকর্মীর সঙ্গে আমার পরিচিত হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। এদের মধ্যে ছিলেন আগমনী লাহিড়ী, সাগরিকা ঘোষ, বেনুগোপাল রায়, সুনীল দাস, সমর গুহ, অপূর্ব ঘোষ, শৈলেন রায়, সন্তোষ ভট্টাচার্য প্রমুখ।
১৯৭০ সালের ১১ জুন এই মহান বিপ্লবী মহীয়সী নারীর জীবনাবসান ঘটে। তার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়