হাসেম ফুডে অগ্নিকাণ্ড : ৩ মাস পর দগ্ধ ছেলের মরদেহ পেলেন বাবা

আগের সংবাদ

রোহিঙ্গাদের অস্ত্র-অর্থের উৎস কী

পরের সংবাদ

প্রবীণ দিবস > নিঃসঙ্গ-অবহেলিত জীবন : এক-চতুর্থাংশ প্রবীণ পুষ্টিহীনতায়, বাড়ছে নিরাময় অযোগ্য ব্যাধি

প্রকাশিত: অক্টোবর ১, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ১, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সেবিকা দেবনাথ : ‘আপনি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ আপনি আমাদের বাস্তবতায় মিশে আছেন এবং জীবনের শেষ মুহূর্তটি পর্যন্ত আপনি গুরুত্বপূর্ণ। শুধুমাত্র কষ্টহীন মৃত্যুর জন্য নয় বরং মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত আপনার শান্তিময় জীবন নিশ্চিত করতে আমাদের পক্ষে সম্ভব সব কিছুই আমরা করব।’……প্রবীণদের উদ্দেশে এই কথাগুলো সিসিলি সন্ডার্সের। যিনি আধুনিক প্যালিয়েটিভ কেয়ার আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, দেশে মানুষের গড় আয়ু প্রায় ৭২ বছর। দেশে মোট জনসংখ্যার ৮ শতাংশ প্রবীণ, যা প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ। সাম্প্রতিক গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০৫০ সালে দেশে প্রবীণ নাগরিকের সংখ্যা ৩ কোটি ৬০ লাখে পৌঁছবে, যা মোট জনসংখ্যার ২৫ দশমিক ৯০ শতাংশ হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগে ষাটোর্ধ্বদের প্রবীণ বলা হলেও ২০১৯ সালের পর থেকে ৬৫ ঊর্ধ্বদের প্রবীণ বলে ঘোষণা করা হয়। দেশের বিশাল একটি জনগোষ্ঠী প্রবীণ হলেও তাদের কল্যাণে তেমন কোনো সুব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। প্রবীণদের কল্যাণে যেসব অবকাঠামো গড়ে তোলা প্রয়োজন যেমন, তাদের জন্য প্রথমিক চিকিৎসা ব্যবস্থা, প্রবীণ নিবাস, দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা ব্যবস্থা, আর্থিক সমর্থন, পুষ্টিকর খাদ্য, ইত্যাদি সরবরাহের ব্যবস্থা প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল। অধিকন্তু এ দেশের প্রবীণ জনগোষ্ঠী ষাটোর্ধ্ব বয়স থেকে কর্মহীনতা, আর্থিক প্রবঞ্চনা, পুষ্টিহীনতা, নিরাপদ পানি ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পারিবারিক অবহেলা, নিঃসঙ্গতাসহ নানা জটিল অবস্থার ভেতর দিয়ে দিনযাপন করেন। শহরে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তের মাঝে এই অবস্থা তেমন একটা পরিলক্ষিত না হলেও নিম্নবিত্ত ও গরিব জনগোষ্ঠীর মাঝে বঞ্চনার এই মাত্রা দৃশ্যমান।
প্রবীণদের অবস্থা প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের জনগণ পারিবারিকভাবে প্রবীণদের প্রতি যতœশীল ও শ্রদ্ধাশীল হলেও আর্থসামাজিক পরিবর্তনের কারণে দিন দিন এই অবস্থার অবক্ষয় হচ্ছে। উচ্চশিক্ষা, চাকরি, ছোট পরিবার, অভিবাসন ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাব ইত্যাদির কারণে পারিবারিক এই ঐতিহ্য ক্রমেই বিনষ্ট হচ্ছে। ফলে প্রবীণ জনগোষ্ঠী অনেকটা অবহেলা ও নিঃসঙ্গতায় জীবন

অতিবাহিত করছে।
আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস উপলক্ষে দেয়া এক বাণীতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদও প্রবীণদের অসহায়ত্বের চিত্রটি তুলে ধরেছেন। বাণীতে তিনি বলেন, দেশের বিদ্যমান আর্থিক ও সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, প্রবীণ ব্যক্তিদের একটি বড় অংশ অবনতিশীল স্বাস্থ্য, আর্থিক দীনতা এবং সামাজিক নিরাপত্তাহীন অবস্থায় বসবাস করছেন। প্রবীণদের অধিকার সংরক্ষণ এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা ও সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তাদের জীবনের অবশিষ্ট সময় সুখ, শান্তি ও মর্যাদার সঙ্গে অতিবাহিত করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া খুবই জরুরি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ায় প্রবীণদের সংখ্যাও বাড়ছে। তাদের মধ্যে নিরাময় অযোগ্য অসুখে আক্রান্ত হবার সংখ্যাও বাড়ছে। এই সময়ে প্যালিয়েটিভ কেয়ারের প্রয়োজন হলেও তারা সেই সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে কোনো রোগ যখন নিরাময় অযোগ্য কিন্তু তার চিকিৎসা করা হবে, সেই সময়ে তাকে শারীরিক ও মানসিক, আত্মিক ও সামাজিকভাবে যে সহায়তা দেয়া হয়, তাকেই প্যালিয়েটিভ কেয়ার বলে। আর এটা অবশ্যই রোগী ও তার পরিবারকে দেয়া হয়।
২০১৭ সালের এক জরিপ অনুযায়ী, দেশে সাড়ে ১১ লাখ মানুষের প্যালিয়েটিভ কেয়ারের প্রয়োজন হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপ অনুযায়ী প্রায় ৪ কোটি মানুষের জন্য প্যালিয়েটিভ কেয়ারের প্রয়োজন। যার মধ্যে ৩৯ ভাগ হৃদরোগজনিত জটিলতার জন্য, ৩৪ ভাগ ক্যান্সারজনিত রোগাক্রান্তের জন্য, ১০ ভাগ ফুসফুসজনিত রোগের জন্য, ৬ ভাগ এইচআইভি/এইডস, ৫ ভাগ ডায়াবেটিসজনিত জটিলতার জন্য, অন্যান্য ব্যাধির জন্য ৬ ভাগ। তবে ৮৬ ভাগ মানুষ যাদের প্রশমন সেবা প্রয়োজন তারা সেটি পাচ্ছেন না। বিশ্বে ৮৩ জন ব্যথানাশক ওষুধ পান না। প্যালিয়েটিভ কেয়ার সেবা প্রয়োজন এমন জনসংখ্যার ৯৮ ভাগ বাস করেন নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারে।
‘নিরাময় অযোগ্য রোগীদের জন্য হোম বেসড প্যালিয়েটিভ কেয়ার : বাংলাদেশে সম্ভাবনা’ শীর্ষক এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৬০ শতাংশের বেশি ক্যান্সার রোগী। ৮৭ শতাংশই নারী। ‘বাংলাদেশে প্রবীণদের অপুষ্টির কারণসমূহ’ শীর্ষক এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের এক-চতুর্থাংশ প্রবীণ অপুষ্টিতে ভুগছেন। আর অর্ধেকেরও বেশি পুষ্টিহীনতার ঝুঁকিতে রয়েছেন। পুরুষদের তুলনায় নারীদের মাঝে অপুষ্টির হার বেশি। পুরুষের মাঝে এই হার ২২ আর নারীদের ক্ষেত্রে ২৮ দশমিক ৮ শতাংশ। জীবনসঙ্গীবিহীন (বিধবা/বিপতœীক/অবিবাহিত) প্রবীণদের মাঝে অপুষ্টির হার ২৮ দশমিক ৬ ও পুষ্টিহীনতার ঝুঁকির হার ৬৫ দশমিক ৩ শতাংশ। বিষণ্নতায় ভোগা প্রায় ৪০ শতাংশ প্রবীণ অপুষ্টিতে ভুগছেন। ‘বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে প্রবীণদের বাত-ব্যথার ব্যাপকতা’ শীর্ষক অপর এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৫২ শতাংশ প্রবীণ বাত-ব্যথায় ভুগছেন। যাদের অর্ধেকের বেশি মাঝারি মাত্রায় শারীরিকভাবে অক্ষম। পুরুষদের মাঝে এই হার ৪৩ দশমিক ৪ এবং নারীদের মাঝে ৫৬ দশমিক ৬ শতাংশ।
বিশ্ব প্রবীণ দিবসকে সামনে রেখে গতকাল বৃহস্পতিবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) আয়োজিত এক সেমিনারে এই তিনটি গবেষণার ফলাফল তুলে ধরা হয়। বিএসএমএমইউ উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন। উপচার্য বলেন, প্রবীণদের হাতটা নবীনদের শক্ত করে ধরতে হবে। কেননা, আজকে আমরা যে অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছি তা প্রবীণদের জন্য।
বিএসএমএমইউর প্যালিয়েটিভ মেডিসিন বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. নাজিম উদ্দিন আহমেদ বলেন, প্যালিয়েটিভ মেডিসিন কেয়ার শব্দটা আমরা প্রথম শুনি ২০০৩ সালে। এ নিয়ে বিএসএমএমইউতে কাজ শুরু হয় ২০০৫ সালে। প্যালিয়েটিভ কেয়ার নিয়ে আমরা কথা বলছি ঠিকই কিন্তু এটি খুব একটা স্বীকৃত না। মৃত্যু ঘটবেই সেই জন্য মৃত্যু পথযাত্রী মানুষের সেবা-যতেœর বিষয়টি আবেগের জায়গা থেকে শুনতে ভালো লাগলেও বাস্তবে তা ভাবতে গেলে বেশ খানিকটা ধাক্কা খেতে হয়। প্যালিয়েটিভ মেডিসিনের আন্তঃবিভাগ ও বহির্বিভাগ এবং হোম কেয়ার সেবায় নারীরাই বেশি।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে ন্যাশনাল প্যালিয়েটিভ কেয়ার গাইডলাইন হয়েছে। বিষয়টিকে স্বাস্থ্যনীতিতে অন্তর্ভুক্ত করতে ২০১৪ সাল থেকে পুরো বিশ্ব চেষ্টা করছে। আমাদের দেশে এই সেবাদানের যে সুযোগ তা সীমিত। ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ঢাকা শিশু হাসপাতাল, বিএসএমএমইউসহ বেসরকারি পর্যায়ে হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে এই সেবার সুযোগ রয়েছে। তবে এর সবটাই ঢাকাকেন্দ্রিক। সরকার এগিয়ে এলে সারাদেশেই এই সেবা ছড়িয়ে দেয়া যাবে। আশার কথা হলো- স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ নিয়ে কাজ করছে।
এই প্রেক্ষাপটে ‘ডিজিটাল সমতা সব বয়সের প্রাপ্যতা’ প্রতিপাদ্য নিয়ে আজ পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণী দিয়েছেন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়