হাইকোর্টের রুল : সরকারি কর্মচারী গ্রেপ্তারে পূর্বানুমতি কেন অবৈধ নয়

আগের সংবাদ

উৎসবের গণটিকায় ভোগান্তিও

পরের সংবাদ

অন্য এক অনন্যা

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৮, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ২৮, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কেউ তখন বেঁচে আছে আমি জেনেছি, অনেক পরে। আমার চেতনাজুড়ে তখনো ছিল রাসেল নামের ছেলেটি, আমারই সমবয়সি কিশোরটি শুধু বঙ্গবন্ধুর সন্তান হওয়ার কারণেই সম্পূর্ণ নিষ্পাপ অবস্থায় খুন হলো শুনে বুকের ভেতর যে আগুন জ্বলছিল, তা প্রকাশের জন্য অনেক বেশি সচেষ্ট ছিলাম। বিদেশে থাকাতে দুবোন বেঁচে যান, এটাই আজ আমাদের পরমতম সৌভাগ্য। আজ শেখ হাসিনা জননেত্রী, প্রধানমন্ত্রী, মানবতার জননী, সর্বোপরি সফল এক রাষ্ট্রনায়ক। আমি সেই শেখ হাসিনার কথা তার জন্মদিনে বলতে আসিনি। আমি বলতে চাই অন্য এক শেখ হাসিনার কথা। যিনি সেখানেও অনন্যা। আমি বলতে চেয়েছি, লেখক শেখ হাসিনার কথা। শেখ হাসিনার লেখক সত্তা আমাদের সামনে ভিন্ন এক বার্তা নিয়ে দাঁড়ায়।
শেখ হাসিনা দেশে ফিরেন আরেক বৃষ্টিস্নাত ভোরে। বাংলার মানুষ তাকে বীরোচিত সংবর্ধনা জানালো। তিনি তখন হয়ে গেলেন এই অবরুদ্ধ মানচিত্রের অযুত-নিযুত মানুষের শত-সহস্র প্রত্যাশার রক্তিম সূর্য। তিনি তখন হয়ে উঠলেন জননেত্রী। আজ একুশ শতকের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দ্বিধাহীন চিত্তে, উদাত্ত কণ্ঠে বলতে পারি তিনি সেই প্রত্যাশা পূরণে সক্ষম হয়েছেন। তিনি সেদিনের জননেত্রী থেকে আজকের সফল রাষ্ট্র নায়ক। বিশ্ব আজ যে ক’জন সফল রাষ্ট্র নায়ককে ঋভু সম্মানে শ্রদ্ধা করে এর মধ্যে একজন শেখ হাসিনা। তার এই অর্জনের পেছনে আছে অনেক ত্যাগ, অনেক দৃঢ়তা আর সাহস। একই সঙ্গে ধৈর্য আর নির্লোভ নেতৃত্বের গুণাবলি। তারপরও ‘কিন্তু’ থেকে যায়। তারপরও ‘প্রশ্ন’ থেকে যায়। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়- এই বিশাল প্রাপ্তির পরও কি শেখ হাসিনার সেই নিসঙ্গতা কেটে গেছে? ঐ ভয়াল দুঃস্বপ্নের ভোর কি হয়েছে? বাবা-মা-ভাই-ভ্রাতৃবধূ হারানোর বেদনা কি তার ভেতর থেকে মুছে ফেলা সম্ভব হয়েছে? আমি শেখ হাসিনার সামনে দাঁড়িয়ে কিংবা তার ওজস্বিনী ভাষায় প্রেরণাদায়ক (গড়ঃরাধঃরড়হধষ ঝঢ়ববপয) বক্তৃতা শুনে ঐ প্রশ্নের মেলেনি উত্তর। কারণ দ্বিতীয়টা সম্ভব হলেও প্রথমটা সম্ভব হয়নি।
আমার উপরের প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাওয়া যায় শেখ হাসিনার লেখক সত্তার মধ্যে। শেখ হাসিনার অন্তর্গত যন্ত্রণা, মানসিক নিঃসঙ্গতাটুকু প্রকাশিত হয়েছে তার লেখা প্রথম দুটি গ্রন্থ ‘ওরা টোকাই কেন?’ এবং ‘বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্রের জন্ম’-এর মাধ্যমে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রিধারী শেখ হাসিনার লেখা এবং সম্পাদিত প্রায় ৩০টির মতো গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। সম্পাদনা করেছেন বঙ্গবন্ধুর ভাষণ। ১৯৯৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে তার নির্বাচিত ভাষণও গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে। এ লেখায় তার সব গ্রন্থ বিবেচনায় নিইনি। কারণ আমি যে শেখ হাসিনাকে দেখার চেষ্টা করেছি, তা একমাত্র উল্লেখিত গ্রন্থ দুখানাতে খুঁজে পাওয়া যাবে। তাছাড়া আগেই উল্লেখ করেছি, তার বক্তৃতার মধ্যে তার নিসঙ্গতা আর কষ্টগুলোকে খোঁজার চেষ্টা করিনি, করবও না। যেহেতু শেখ হাসিনার আজকের প্রধান পরিচয় জননেত্রী, সফল রাষ্ট্র নায়ক, মানবতার জননী, তখন তার ব্যক্তিক কষ্টটুকু প্রকাশ পাওয়ার কথা নয়। শেখ হাসিনার অনেক ভাষণ শুনে শুনে আমার মধ্যে এই বিশ্বাস দৃঢ় হয়েছে যে, শেখ হাসিনা অনেকবার জনসমক্ষে আবেগাপ্লুত হলেও কষ্ট চেপে রেখে তার মতো হাসিমুখে কিংবা বজ্রকণ্ঠে কথার বলার মতো সংবেদনশীল মানুষ খুবই বিরল। যন্ত্রণাবিদ্ধ, বেদনাহত এমন একজন মানুষের জন্মদিন আড়ম্বরহীন পরিবেশে পালিত হওয়াই তো স্বাভাবিক। কে না জানে, ’৭৫-এর ১৫ আগষ্ট তার সমস্ত আনন্দ আর ফুর্তি কেড়ে নিয়েছে ঘাতকের দল। আমি সতত প্রবৃত্ত হই, তার গ্রন্থ দুখানা পাঠে। নিরন্তর বিচরণ করি শেখ হাসিনার আনন্দ-বেদনার সন্ধানে। গ্রন্থ দুখানার মধ্যে সেই অন্য এক অনন্য এক শেখ হাসিনাকে খুঁজে পাই।
সারল্যমাখা গ্রামীণ জীবন শেখ হাসিনার প্রিয়। তাই ঘুরেফিরে বারবার গ্রামীণ জীবনের প্রতিচ্ছবি তার লেখায় ব্যক্ত হয়েছে। ওখানেই এক স্থানে জেনে যাই, আর দশজন বাঙালি কিশোর-কিশোরীর মতো বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালি’ কৈশোরে তাকেও ভীষণভাবে আচ্ছন্ন করেছে। ‘পথের পাঁচালি’ তার নিজের গ্রাম বাইগার নদীর পাশে অবস্থিত টুঙ্গিপাড়াকে মনে করিয়ে দেয়। রবীন্দ্রনাথের গ্রামভিত্তিক ছোটগল্পগুলো তার প্রিয়। প্রিয় জয়নুলের সেই কলাগাছের ঝোপে নোলক পড়া বউয়ের স্কেচগুলো। বাউল গান, বৈষ্ণব গান, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি মাঝির গান- এসব কিছু তার উদার দুপুরের সাথি। এসব পড়তে পড়তে যে কোনো পাষাণ হৃদয়েরও মায়া হয়। চোখ অশ্রæসিক্ত হয়। শেখ হাসিনা কিন্তু এও জানেন ‘পথের পাঁচালি’র অপু, দুর্গা কিংবা তার গ্রামের সেই সুন্দর দিনগুলো আর কখনো ফিরে আসবে না। একে একে সব হারিয়ে গেছে। তিনিও গ্রাম পতনের খবর পেয়ে যান। হ্যাঁ পাবেনই তো। কারণ তিনি যে শুধু জননেত্রী, মানবতার মাতা নন তিনি একজন সংবেদনশীল লেখকও বটে। এখনো যখন গণভবনে বড়শি দিয়ে মাছ ধরতে যান, রিকশায় চড়ে টুঙ্গিপাড়া ঘুরতে চান তখন গ্রামীণ জীবনের প্রতি ভালোবাসার সত্যতা মেলে।
‘ওরা টোকাই কেন?’ এবং ‘বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্রের জন্ম’-গ্রন্থ দুখানার পনেরোটি প্রবন্ধে অধিকাংশই হচ্ছে স্মৃতি তাড়ানিয়া অতীত নিয়ে। এখানে তার গভীর সেই বেদনাবোধ উন্মাচিত হয়েছে। প্রকৃতির কাছে মানুষের অসহায়ত্বের অসংখ্য করুণ চিত্র তিনি তুলে ধরেছেন বাংলার ৬৮ হাজার দারিদ্র্যপীড়িত গ্রামে ঘুরে ঘুরে। বঙ্গবন্ধুর মতো তারই সুযোগ্য কন্যা কোথায় যাননি? বাংলার প্রায় গ্রামে তার পদধূলি পড়েছে। আর ওখান থেকে রাজনৈতিক হীন স্বার্থের বিপরীতে ‘হৃদয়ে প্রেমের শীর্ষে’ স্থান পেয়েছে অযুত-নিযুত ভাগ্যবঞ্চিত মানুষ। গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরে ঘুরে তিনি স্বজন হারানোর বেদনা ঘুচাতে চেয়েছেন। কিন্তু কতটুকুই আর তা সম্ভব। ওকানকার মানুষের দুঃখ-কষ্টগুলো নিজের মধ্যে আরো বড় হয়ে দেখা দেয়। কিন্তু এক সময় তিনি ফিরে আসেন নিজের মধ্যে। এই ফেরাটুকু বোধ করি আত্মনুসন্ধান। তার লেখকসত্তার আত্মনুসন্ধান। তাই সব কিছু ছাপিয়ে তিনি যখন বলেন, ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’, ‘ড. আবদুল মতিন আমার স্মৃতিতে ভাস্বর যে নাম’, ‘অনর্জিত রয়ে গেছে স্বপ্নপূরণ’, বঙ্গবন্ধুর সহকর্মী চট্টগ্রামের এম এ আজিজ, শহীদ ময়েজ উদ্দিন, শহীদ নূর হোসেনের কথা, ’৭১-এর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের অনুভূতি, স্মৃতির দখিন দুয়ার খুলে শৈশব, কৈশরের অসংখ্য সব চিত্ররূপময় ঘটনা আর তাকিয়ে দেখার আনন্দ-বেদনা, তখন বিস্ময়ের সীমানা ছাড়িয়ে আমাদের বোধবুদ্ধিও অন্য কোথাও অন্য কোনো স্থানে অবস্থান নেয়। তিনি লিখেছেন, “কামাল কাছ ঘেঁষে বলল, ‘হাচু পা, তোমার আব্বাকে আব্বা বলতে দেবে?’ আমার শৈশবের হৃদয়ের গভীরে কামালের ওই অনুভূতিটুকু আজো অমøান হয়ে আছে।” এসবে কি একবারও চোখের কোণে এক ফোঁটা জলের চাপ অনুভব করি না? চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে না? একজন কবির সঙ্গে আজ সভ্যতার এই সম্পর্ক। স্তব্ধ আর স্থির তাকিয়ে থাকাই তার একমাত্র কাজ যেন। সেই তার প্রতিবাদ।’ শেখ হাসিনা কবি নন। এ কথা মানি। কিন্তু তিনি নারী। নারীর হৃদয় কবির মতো সরল কোমল। দুই সত্তার অন্তর্গত মিলটায় বড় বেশি চোখে পড়ে। এখানেই তার লেখক সত্তারও আছে এক বিরাট ভূমিকা। এসব মিলিয়েই তো তিনি অন্য এক অনন্যা।
শেখ হাসিনার লেখক সত্তার প্রকাশ আজো সম্পূর্ণ উন্মোচিত হয়েছে বলে মনে করি না। জানি না তিনি স্মৃতি কথা লিখছেন কিনা। জানি না ডায়েরির পাতা ভরিয়ে রাখছেন কিনা ভাবীকালের পাঠকের জন্য। এসব লেখালেখিকে সেদিনের প্রস্তুতি হিসেবে কিন্তু অনুমান করতে পারি। আর অনুমান করি, যখন আমার মতো একজন অপরিচিত, মফস্বলবাসীর কাছ থেকে ডাকযোগে পুস্তক গ্রহণ করে পত্র দিয়ে প্রাপ্তি সংবাদ পাঠান। তখন তিনি বিরোধী দলের নেত্রী। আমি আমার প্রকাশিত প্রথম কিশোর গল্প গ্রন্থ ‘আগামীর জন্য ভালোবাস’ তার কাছে ডাকযোগে পাঠালাম। তারপর ক’দিন পর আমার ঠিকানায় বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের দপ্তর থেকে আসে একটা চিঠি। চিঠিতে তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘স্নেহের প্রীতীশ, তোমার চিঠি, পাঠানো বই এবং স্মরণিকা আছি পেয়েছি। তোমার এ মহতী প্রয়াস সফল হোক। আমি তোমার বই পড়ছি। একজন লেখক হিসাবে তুমি সফল হও। দেশ এবং জাতি তোমার কাছ থেকে প্রকৃত সত্য এবং তথ্য জানতে পাক, এই কামনা করি। অনেক অনেক শুভেচ্ছাসহ শেখ হাসিনা।’ এটা ১৯৯২ সালের নভেম্বর মাসের কথা। এর প্রায় আট বছর পর ২০০০ সালের শেষদিকে যেদিন শেখ হাসিনা প্রথমবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন শেষে তৃতীয় তত্ত্বাবধায় সরকারের প্রধান বিচারপতি লুৎফর রহমানের কাছে দায়িত্ব অর্পণ করে নির্বাচনে যোগদান করেন, সেদিন আমি টুঙ্গিপাড়া বঙ্গবন্ধুর মাজারে গিয়ে দেখি ওখানকার লাইব্রেরির একটা আলমারিতে আমার প্রদত্ত সেই বই পরম যতেœ শোভা পাচ্ছে। সাহিত্য এবং সাহিত্যিকের প্রতি স্নেহ-মমতা তো একজন প্রকৃত লেখকেরই থাকার কথা।
শেখ হাসিনার গাঢ় মানবিক মূল্যবোধ আর নিঃসঙ্গতার বার্তাবাহক হিসেবে গ্রন্থ দুটিকে বেছে নিলে শেষ হয়ে যায় না সব অনুসন্ধান। এখানে অন্য এক শেখ হাসিনাকে খুঁজে পাওয়া যায়। তিনি মানবিক শেখ হাসিনা। তিনি অনন্যা হলেও তিনি নিঃসঙ্গ, উৎকণ্ঠিত এক নীড়হারা পাখি যেন। অন্য এক শেখ হাসিনার অবয়ব যখন উন্মোচিত হয়, তখন নিজের মধ্যেই গাঢ় এক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। চিন চিন করে বুকের ভেতর যন্ত্রণা অনুভব করি। শেখ হাসিনার বাহ্যিক আবরণে প্রাণিত হয়ে অনেকে স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু রাত গভীরে গ্রন্থদ্বয় পাঠ শেষে একমাত্র বুঝে ওঠা সম্ভব হয়, তার দুঃস্বপ্নের ভোর নেই। বিস্তার আছে। আছে শুধু অন্ধকার আর আতঙ্ক। এখনো একটি বুলেট তাকে তাড়া করছে। তাকে একবার নয়, দুবার নয়, প্রায় বিশবার হত্যার চেষ্টা করেছে ঘাতকের দল। দেশে-বিদেশে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তাই শেখ হাসিনা এবং শেখ হাসিনাই বারবার মুখোমুখি হোন এই অন্ধকার আর আতঙ্কের। এরপর কি আর তার সামনে ছাদ ফাটিয়ে হাসা যায়? খিলখিলিয়ে উচ্ছ¡াস প্রকাশ করা যায়? তখন জন্মদিনের আলোকিত উচ্ছ¡াস হারিয়ে যায়, বেদনা আর দীর্ঘশ্বাসের অতলে। এই সবে মাত্র পার হয়ে গেল শোক মাস আগস্ট। তারপরও বলব, শুভ জন্মদিন জননেত্রী থেকে আজকের সফল রাষ্ট্র নায়ক, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আপনি অন্য এক অনন্যা।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়