একাই কোকোর কবর জিয়ারত করলেন রিজভী

আগের সংবাদ

বঙ্গবন্ধু হত্যার পরিবেশ তৈরি করে পাকিস্তান ও আমেরিকা

পরের সংবাদ

স্মৃতিময় এস এম হল, চল্লিশের দশক

প্রকাশিত: আগস্ট ১৪, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ১৪, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

চল্লিশের দশকের আগে স্যার ফিলিপ হার্টগ (১.১২.১৯২০-৩১.১২.১৯২৫), প্রফেসর জর্জ হ্যারি ল্যাঙলি (২৬.১.১৯২৬-৩০.০৬.১৯৩৪), স্যার আহমদ ফজলুর রহমান (১.৭.১৯৩৪-৩১.১২.১৯৩৬) এবং প্রফেসর রমেশচন্দ্র মজুমদার (১.১.১৯৩৭-৩০.৬.১৯৪২) চারজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন।
রমেশচন্দ্র মজুমদারকে দিয়ে চল্লিশের দশকের সূচনা। একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু পর্যন্ত রমেশচন্দ্র মজুমদারের পর ৮ জন দায়িত্ব পালন করেছেন : প্রফেসর মাহমুদ হাসান (১.৭.১৯৪২-২১.১০.১৯৪৮), প্রফেসর সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন (২২.১০.১৯৪৮-৮.১১.১৯৫৩), প্রফেসর ওয়াল্টার অ্যালেন জেঙ্কিন্স (৯.১১.১৯৫৩-৮.১১.১৯৫৬), বিচারপতি মোহাম্মদ ইব্রাহিম (৯.১১.১৯৫৬-২৭.১০.১৯৫৮), বিচারপতি হামুদুর রহমান (৫.১১.১৯৫৮-১৪.১২.১৯৬০), প্রফেসর মাহমুদ হোসেন (১৫.১২.১৯৬০-১৯.০২.১৯৬৩), প্রফেসর এম ওসমান গনি (২০.২.১৯৬৩-১.১২.১৯৬৯) এবং বিচারপতি আবু সায়ীদ চৌধুরী (২.১২.১৯৬৯-২.৩.১৯৭১)। ১৯৪০ দশকের শুরুতে এস এম হলের প্রভোস্ট ছিলেন ডক্টর মাহমুদ হোসেন।
হলের হাউস টিউটর ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। ১৯৪০-৪৪ বর্ষের ছাত্র অশীতিপর আনোয়ার হোসেন খান লিখেছেন তার শহীদুল্লাহ স্মৃতি। জ্ঞানতাপন শহীদুল্লাহ তার মামার বন্ধু। মামাকে নিয়ে হাউস টিউটরের বাসায়, তারা কম্পারেটিভ রিলিজিয়ন নিয়ে আলাপ করছিলেন, সে সময় মামা আক্ষেপ করে কোনো একটি বই কোথাও না পাওয়ার কথা বললেন। ‘দেখি, মুচকি হেসে শহীদুল্লাহ উঠে দাঁড়িয়েছেন। তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে বাঁ কোণে দাঁড় করানো ছোট্ট হালকা একটি মইয়ের দিকে এগিয়ে গেলেন। মই তুলে সারিবদ্ধ আলমারিগুলোর একটির মাথায় ঠেকিয়ে চটপট মই বেয়ে উপরে উঠলেন। বইয়ের তাক থেকে একটি বই বেছে তরতর করে নেমে আসলেন। বইটি একটি কাপড়ের ডাস্টার দিয়ে মুছে মুছে বন্ধুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, নিন এটা সেই বই।
চল্লিশের দশকের আগের হলেও জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট রমেশচন্দ্র মজুমদারের চোখে শহীদুল্লাহ কেমন জানা দরকার। রমেশচন্দ্র প্যারিস গেলেন, সেখানে পুরনো বন্ধু শহীদুল্লাহর সঙ্গে দেখা হলো, তিনি প্যারিসেই থাকছেন এবং প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেছেন।
বিদেশে গিয়েও কয়েকটি ভারতীয় প্রথা তিনি মেনে চলতেন। প্রথমত দেখতাম যে, তিনি সর্বদাই একটি বদনা (জলের পাত্র) সঙ্গে নিয়ে যেতেন। প্যারিসের বাইরে যেতে হলেও বদনাটি সঙ্গে নিতেন। দ্বিতীয়ত মুরগিকে জবাই করা হত না বলে তিনি তার মাংস খেতেন না। শহীদুল্লাহ খুব অমায়িক এবং সাদাসিধা ধরনের মানুষ। ওই দেশি ছাত্রেরা তাকে খুব পছন্দ করত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার সৈয়দ বদরুদ্দিন হোসাইন ছিলেন ১৯৪২-১৯৪৬ বর্ষের এস এম হল অধিবাসী। হল জীবনের স্মৃতি তাকে এতই আপ্লুত করে রেখেছে যে ইংরেজি গানের বাণী তিনি স্মরণ করেছেন যার ভাবার্থ- পুরনো একটি দিনের বিনিময়ে ভবিষ্যতের দিনগুলো বিকিয়ে দিতে চাই। হল তার কাছে শুধু একটি ইট-পাথর আর চুন-সুরকির ইমারত নয়, সেখানে পড়ে আছে ভোলা অসম্ভব এক জীবন। ‘ইচ্ছে হয় হলের করিডোরে কান পেতে শুনি অতীতের অনেকের পদধ্বনি, যারা আজ আমার জীবন থেকে দূরে সরে গেছে, আরো অনেক দূরে- এ পৃথিবী থেকেই চলে গেছে।’
স্মৃতিতে সবচেয়ে বেশি দোলা দেয় ডাইনিং হল। ‘আমাদের আহার্য তৈরি করে দুবেলা ডাইনিং হলের টেবিলে সাজিয়ে রেখেছে যে বাবুর্চি, বেয়ারা তাদের ছাড়া কি অতিক্রম করতে পারতাম হল জীবনের চার বছর?… স্মৃতির মিছিলে আরো আসে হল রেস্টুরেন্টের মালিক ফজলু মিয়া, আসে দুধওয়ালা করিম, মিষ্টি বিক্রেতা অনাথ বন্ধু। পরাটা কাবাব চপ ডালপুরি নিয়ে রুমে রুমে ফেরি করে ঘুরত সেই যে আধা বয়সি নাস্তাওয়ালা তার কথা কি ভোলা যায়? রেস্টুরেন্টে গিয়ে ঢুকলেই শোনা যেত ফজলু মিয়ার সেই নিত্যদিনের অভিযোগ- এত টাকা বাকি পড়লে রেস্টুরেন্ট চালাই ক্যামনে? কিন্তু কোনো ছাত্রকে নাস্তা না খাইয়ে ফিরিয়ে দিত না। হাঁক দিত ‘দুইটা বাটার টোস্ট আর একটা চপ দিয়া যা।’
তিনি বৃদ্ধ অনাথ বন্ধুর কথা তিনি স্মরণ করেছেন যে অনাথ বলতেন, ভগবান আছে, ছাত্ররা আমার টাকা না দিয়া পারব না। এখন না পারে চাকরি পাইয়া শোধ করব।
ঢাকার দর্শনীয় বস্তু কিংবা স্থানের তালিকায় এস এম হলের নাম অবশ্যই ছিল। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরুর বছর এক শুভানুধ্যায়ী নবম শ্রেণির ছাত্র মফিজুল্লাহ কবীরকে মুসলিম হলের সুরম্য অট্টালিকা দেখিয়ে এতটাই মুগ্ধ করেন যে ‘ভবিষ্যতে মুসলিম হলে থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করার একটা অদম্য আগ্রহ মনে জাগে।’ সত্যিই তার অদম্য আগ্রহ বাস্তব রূপ নেয়। ১৯৪৩-১৯৪৭ শিক্ষাবর্ষের মফিজুল্লাহ কবীর পরবর্তীকালে নিজের হলের প্রভোস্ট হন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর হন।
‘আমরা যখন ঢাকায় পড়তে আসি তখন অর্থাভাব ও অন্নাভাবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে স্থানাভাব। আমরা সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ভর্তি হই, কিন্তু সলিমুল্লাহ হল ভবন তখন সরকার সামরিক হাসপাতালের জন্য দখল করে নিয়েছে। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় ভবনের (বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজ) দোতলায় স্থান পাই।’
এখানে তাদের হল জীবন শুরু হলেও সামনে বড় বিপর্যয় অপেক্ষমাণ। বছরখানেকের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় ভবনও সামরিক হাসপাতালের জন্য অধিযাচন করে দিল। গরুর গাড়িতে মালামাল তুলে শুরু হয় তাদের পদব্রজ যাত্রা। থাকার জন্য নির্ধারিত হলো তিনটি স্থান- সেগুনবাগিচায় খান ম্যানসন, নিউ সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিং (এখনকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়) এবং ফজলুল হক হলের একাংশ- তার তখন ঢাকা হল। খান ম্যানসনের বাসিন্দা হিসেবে মফিজুল্লাহ কবীর, রোমাঞ্চ অনুভব করলেন। ক্লাস শুরু হলো ভিন্ন ভিন্ন জায়গায়- ‘বোমারু বিমানের বিকট শব্দে আমাদের শ্রেণিকক্ষগুলো প্রকম্পিত হতো। মাঝে মাঝে বিমান হামলার সংকেত পেয়ে আমাদের পরিখায় আশ্রয় নিতে হতো। দুটি ক্লাসের অন্তর্বর্তী সময় দ্রুতপদে এক দালান থেকে আরেক দালানে ছুটে যেতে আমরা হাঁপিয়ে উঠতাম ‘প্রাসাদোপম অট্টালিকায় বাস্তবতা তখন আবার স্বপ্নে পরিণত হয়ে গেছে। ১৯৪৫ সালে যুদ্ধাবসানে আমরা হলের মূল ভবনে স্থান পাবার আশায় বুক বাঁধলাম। সামরিক হাসপাতাল অপসারিত হবার পর আমরা মাঝে মাঝে খালি হল ভবন দেখতে যেতাম।’ এক সময় হলের দখলও নিলেন যাতে তখন হাসপাতালের কাঠামো- দুই রুমের মাঝখানের দেয়াল অপসারিত। তারপরও এই হলে আবাসিক ছাত্র হিসেবে কাটালেন আড়াই বছর আর সহকারী হাউস টিউটর হিসেবে আরো তিন বছর।
১৯৪৩-১৯৪৭ বর্ষের মেহের কবীর রোকেয়া হলের প্রভোস্ট ছিলেন। তার স্মৃতিকথায় কবীর চৌধুরীর সঙ্গে তার প্রেম পর্বটি এড়িয়ে গেছেন অবশ্য ১৯৪৫ সালে তাদের বিয়ের কথা বলেছেন। তিনি আসতেন আর্মানিটোলা থেকে। সে বর্ণনা তার লেখাতেই : তখন ঢাকার অন্যতম যানবাহন ছিল ঘোড়ার গাড়ি। আর্মানিটোলা তথা পুরান ঢাকার কোন অঞ্চল থেকে মুসলমান মেয়েরা জানালা খোলা ঘোড়ার গাড়িতে যাতায়াত করতে পারত না। আমাকেও শরৎচন্দ্র রোড থেকে রমনার কার্জন হলে যেতে হতো বন্ধ ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে। ঢাকার আর একটি মেয়ে আফিয়া তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে পড়ত। তার বাসাও ছিল পুরান ঢাকায়। আমরা দুজন একই ঘোড়ার গাড়িতে ভাড়া ভাগাভাগি করে বেশ কিছু দিন আসা-যাওয়া করি।’ সেই জানালা বন্ধ ঘোড়ার গাড়িতে রসায়ন বিভাগের ছাত্রী মেহের কবীর এসে নামতেন কার্জন হলে- সে এক প্রমীলা বর্জিত স্থান।
বাংলাদেশের প্রথম ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ আবদুল খালেক ১৯৪৩-১৯৪৮ শিক্ষাবর্ষ এস এম হলের ছাত্র ছিলেন। তিনি চল্লিশের দশকে এস এম হলের ছাত্রদের (এবং ছাত্রীদের) কারো কারো মন দেয়া-নেয়ার কাহিনী লিপিবদ্ধ করেছেন। পুলিশের সবচেয়ে বড় কর্তার বর্ণনায় এটাই কি মনে করিয়ে দেয় না যে যৌবনের ধর্ম প্রায় সবার বেলায় মোটামুটি একই রকম। কারো সুযোগ মেলে কারো মেলে না। ‘সেই সময়কার প্রেমের ঘটনাবলির মধ্যে সবচে’ আলোচিত ছিলেন কবীর চৌধুরী, সৈয়দ আলী আশরাফ, সালাহউদ্দিন আহমেদ ও মোহাম্মদ নোমান- এরা সবাই ছিলেন এস এম হলের। পরবর্তীতে শুনেছি তাদের প্রেমে কোনো ভাটা পড়েনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কঠোর নিয়মের আওতায় থেকে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে আলাপচারিতা ও প্রেম জমিয়ে তোলা সত্যিই প্রতিভাবানদের কাজ বটে। ছাত্রীদের পাহারা দিয়ে শিক্ষকরা কমনরুম থেকে ডেকে এনেছেন ক্লাসরুমে, আবার পাহারা দিয়ে পৌঁছে দিয়েছেন কমনরুমে। অর্থনীতি বিভাগে আমাদের সম্মান ক্লাসে কোনো ছাত্রী ছিল না। মাস্টার্স শেষবর্ষে দেখেছি আজিজুন নেসাকে। তাকে আপা ডাকতাম তার শালীন চালচলন ও ব্যক্তিত্বের জন্য।’ একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন : ‘জনমুখিতা-গণমুখিতা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত দেখেছি মোহাম্মদ তোয়াহা, সরদার ফজলুল করিম ও আবদুল মতিনকে। তাদের নেতৃত্বেই প্রগতিশীলতা দৃশ্যমান হতে থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এস এম হলে। ১৯৪৭-১৯৫১ শিক্ষাবর্ষের জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী পরবর্তী সময়ের ইংরেজির অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা। প্রথম বর্ষে এস এম হলে পেলেন ৩ শয্যার কক্ষে একটি শয্যা, দ্বিতীয় বর্ষে ২ শয্যা কক্ষে এক শয্যা আর তৃতীয় বর্ষে জ্যেষ্ঠতার দাবি জুটিয়ে দিল এক শয্যার পুরো একটি কামরা।
প্রথম বছরই তার ট্রাঙ্ক সাফাই হয়ে গেল। রুমমেটদের কেউ একজন দরজায় তালা লাগাননি। তিনজনের একজন কুমিল্লার বজলুর রহমান তিনি দরজা খোলা রেখে পাশের কোনো এক রুমে তাস খেলতে যান, মধ্যরাতে যখন ফেরেন, ঘুমিয়া পড়া শিক্ষার্থীদের কিছুটা ঝামেলা তো হয়ই। ততদিনে জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী অভিনয়ে পাকা হয়ে উঠেছেন। এস এম হলের সামরিক হাসপাতাল পর্ব শেষ হলেও মৃত সৈনিকের প্রেতাত্মার সবই যে বিদায় নেয়নি এই হাইপোথিসিস কাজে লাগিয়ে সমস্যা সমাধানের একটি দুরভিসদ্ধি চূড়ান্ত করলেন।
‘ভাবলাম রুমমেটকে একটু অভিনয় করে ভয় পাইয়ে দিই। মধ্যরাতে রুমমেট ঘরে ঢুকলেন। আমি দেয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে আছি। দশ-পনেরো মিনিট অপেক্ষা করলাম। তারপর ‘আমি না, আমি না, আমাকে ছেড়ে দিন…।’ -এভাবে আর্তচিৎকার। রুমমেট ধরফর করে উঠে পড়লেন। তিনিও তখন উঠে বসেছেন ও আতঙ্কে থরথর করে কাঁপছেন।
কী হয়েছে রুমমেট, কী হয়েছে- বজলুর রহমানের উদ্বিগ্ন প্রশ্ন।
‘আমি একটি দুঃস্বপ্নের গল্প শোনালাম, এতেই কাজ হলো। রুমমেট একটু পরেই রুম ছেড়ে চলে গেলেন। সেই যে গেলেন আর ফিরলেন না। অন্য আর একটি রুমের বরাদ্দ নিয়ে আমার কামরা ত্যাগ করলেন।…আমার সাজানো গল্পে এক শেতাঙ্গ সৈনিকের সঙ্গে আমার সংলাপের কথা ও সৈনিকের আচরণে আমার ভয় পাওয়ার কথাটা বজলুর রহমান তার মতো করে বুঝে নিলেন। মৃত সৈনিকের আত্মা এখনো ফিরে আসছে সেই কামরায়, যেখানে তার মৃত্যু হয়েছিল।’ এই দুরভিসন্ধিমূলক অভিনয়ের গল্পটি বজলুকে আর কখনো বলা হয়নি। আর তার অভিনয় যে এমন মারাত্মক হবে তিনিও ভাবতে পারেননি।
চল্লিশের দশকের শেষে ১৯৪৯-এ দর্শন বিভাগে ভর্তি হলেন কায়সার (নারী), (নামটা পুরুষ ধাচের বলে লালিমা পাল (পুং)-এর মতো উল্লেখ করা হলো) ঠাঁই এই হলেই, তবে আবাস চামেলি (চামেরি) হাউসের দোতলায়, প্রায় ২৫ জনের আবাসন। এই হল টানত জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীকে ‘যদি তার দেখা পাই’- এ আকর্ষণে। কায়সারই পরবর্তীকালে মিসেস জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী। এই হাউসের কারো কারো সঙ্গে হলের ছাত্রদের হৃদয়ের আদান-প্রদান ঘটেছে। জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী লিখছেন : চামেলি হাউসের ওয়ার্ডেন ছিলেন ইংরেজির লেকচারার চারুপমা বোস। ক্লাসে আমি তাকে আমার নীরব অভিনয় করে বুঝিয়েছি, তাঁর পড়াশোনায় মুগ্ধ। আসলে তা নয়, আমার গোপন অভিসন্ধি পূরণের জন্যই এই অভিনয়। এক. আমি চামেলি হাউসের রুদ্ধভবনে প্রবেশ করে চাই ওরা কেমন জীবনযাপন করছে। আর যদি তার দেখা পাই। দুই. বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি থেকে পাওয়া যায় না, অথচ তার নিজস্ব সংগ্রহে আছে বলে জেনেছি এমন কয়েকটি বই ধার করা। আমার সব উদ্দেশ্য সফল হয়নি- তবে হলে প্রবেশাধিকার পেয়েছি ও কাক্সিক্ষত বইও তিনি আমার হাতে তুলে দিয়েছেন। চারুপমা বোস তার সহপাঠী বুদ্ধদেব বসুর কথা বলতেন, ওর মতো ছাত্র হয় না।
ছাত্র ও ছাত্রীদের মধ্যে দূরত্ব বজায় রাখার ব্যাপারটি কেমন করে নিশ্চিত করা হতো লিখেছেন ১৯৪৮-১৯৫২ শিক্ষাবর্ষের ভাষাসৈনিক অধ্যক্ষ রওশন আরা বেগম।
‘যেহেতু সলিমুল্লাহ হলে যুক্ত ছাত্রী, সে কারণে আমাদের হল অফিসে প্রভোস্টের সই বা কোনো বিষয়ে অনুমতির জন্য যেতে হতো। সেখানে যাওয়ার ব্যাপারে একটু কড়াকড়ি ছিল।’ কর্তৃপক্ষের কোনো নির্দেশ নয় কিন্তু বড় আপাদের নির্দেশ যেতে হলে দল বেঁধে যেতে হবে, যেখানে কোনো ছাত্রের সঙ্গে কথা বলা যাবে না- বেগজাদি মাহমুদা আপার নির্দেশ অমান্য করে কার সাধ্য।’
আসা যাওয়ার পথে তবুও তার চোখে পড়েছে একজন ছাত্রের কক্ষ : ‘একটি চৌকিতে পাতা বিছানার মাঝখানে গর্তের মতো আর তার চারপাশে এলোমেলোভাবে বইয়ের স্তূপ। বিছানার চাদর মনে হয় জীবনেও ধোয়া হয়নি, চৌকির নিচে ময়লা কাপড়। এক কোণে পানি শুকনো সুরাই কাত হয়ে পড়ে আছে। দিনরাত পড়াশোনায় ব্যস্ত, মেধাবী ছাত্রদের রকমসকমই আলাদা।’ এই ছাত্রটিই আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, জবরদস্ত আমলা ও কিংবদন্তির কবি- আমি কিংবদন্তির কথা বলছি/আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।

ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে, নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়