একাই কোকোর কবর জিয়ারত করলেন রিজভী

আগের সংবাদ

বঙ্গবন্ধু হত্যার পরিবেশ তৈরি করে পাকিস্তান ও আমেরিকা

পরের সংবাদ

পাচার হয়ে যাওয়া তরুণীর প্রশ্ন

প্রকাশিত: আগস্ট ১৪, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ১৪, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

উন্নত জীবনের প্রলোভন দেখিয়ে বাংলাদেশি তরুণীকে ভারতের কেরেলায় নিয়ে এসে গণধর্ষণ করা হয়েছে। নির্যাতনের শিকার ওই তরুণীর বাড়ি ঢাকার হাতিরঝিলে। অভিযুক্তরা সবাই বাংলাদেশের। ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা গিয়েছে, বছর বাইশের ওই তরুণীকে একসঙ্গে চারজন যুবক নির্যাতন করেছে। সেখানে অন্য একটি মেয়ের উপস্থিতিও দেখা যায়। ইতোমধ্যে কারো সাহায্যে নির্যাতিতা মেয়েটির ভারতীয় পরিচয়পত্রের আধার কার্ড সংগ্রহ করা হয়েছে। এ ঘটনায় টনক নড়ে ঢাকার গোয়েন্দা পুলিশের। আরো খোঁজ নিতে বেরিয়ে আসে সংঘবদ্ধ নারী পাচারকারী চক্রের সন্ধান। ভারতের কেরেলায় ওই তরুণীকে যৌন নির্যাতনের ভিডিও ধারণ করে তা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার মূল হোতা রিফাতুল ইসলাম ওরফে টিকটক হৃদয়সহ ৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছিল ভারতের বেঙ্গালুরু পুলিশ। ধারণা করা হয়েছে, এটি একটি সংঘবদ্ধ মানব পাচারকারী চক্র। তারা প্রেমের ফাঁদে ফেলে অসহায় অথচ বিদেশ গমনে ইচ্ছুক নারীদের প্রলুব্ধ করে পাচার করে। ভারতের পুলিশ ও ইন্টারপোলের সহায়তায় এ নৃশংস ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়েছে।
এরপর একে একে বেরিয়ে এসেছে নারী পাচারের লোমহর্ষক কাহিনী। ভারতে পাচার হওয়ার ৭৭ দিন পর কৌশলে দেশে ফেরা এক কিশোরী ভয়ানক এবং বীভৎস এক চিত্র তুলে ধরেছে। সে জানিয়েছে, ভারতের বেঙ্গালুরুতে পাচার সিন্ডিকেটের বিভিন্ন আস্তানায় বন্দি হয়ে আছে হাজারো বাংলাদেশি তরুণী। সেখানে তাদের আটকে রেখে শারীরিক ও যৌন নির্যাতন করা হচ্ছে। টিকটকের স্টার বানানো কিংবা পার্লার বা শোরুমের চাকরির কথা বলে বাংলাদেশের কিছু মেয়েকে ভারতে নিয়ে দেহ ব্যবসায় বাধ্য করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে জানা গিয়েছে, সাতক্ষীরা-বেনাপোল সীমান্ত পথে হাজার হাজার নারীকে পাচার করা হয়েছে। সীমান্ত এলাকায় রয়েছে পাচারকারীর সেফ হোম। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নারীদের নিয়ে এসব সেফ হোমে রাখা হয়। এরপর সেখান থেকে মোটরসাইকেলে করে ভারতীয় সীমানার ভেতর নিয়ে ভারতীয় দালালদের হাতে তাদের তুলে দেয়া হয়। দেশে ফিরে আসা ওই কিশোরীর দায়ের করা মামলায় ১২ জনকে আসামি করা হয়। পাচারের শিকার ওই কিশোরী জানায়, তার সঙ্গে ২০১৯ সালে হাতিরঝিলের ব্রিজে টিকটক হৃদয়ের পরিচয় হয়। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে নারায়ণগঞ্জের অ্যাডভেঞ্চার ল্যান্ড পার্কে ৭০-৮০ জনকে নিয়ে টিকটক হ্যাংআউট এবং ২০২০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর গাজীপুরের আরফিন গার্ডেন রিসোর্টে ৭০০-৮০০ তরুণ-তরুণীকে নিয়ে পুল পার্টির আয়োজন করে এই টিকটক হৃদয়। ২০২১ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়ার বাউল লালন শাহ মাজারে আয়োজিত টিকটক হ্যাংআউটে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে পাচারকারী চক্র এই কিশোরীকে কৌশলে ভারতে পাচার করে। পাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়ার পর পালিয়ে দেশে ফেরা পর্যন্ত তার ওপর লোমহর্ষক নির্যাতন চালানো হয়। বেঙ্গালুরুতে পৌঁছার কয়েকদিন পর এই কিশোরীকে চেন্নাইয়ের একটি হোটেলে ১০ দিনের জন্য পাঠানো হয়। নেশাজাতীয় দ্রব্য খাইয়ে কিংবা জোরপূর্বক বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করে তা পরিবারের কাছে পাঠানো হবে বলে হুমকি দিয়ে তাকে জিম্মি করে রাখা হয়। কিন্তু এই অদম্য সাহসী কিশোরী ৭৭ দিন পর পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, অবৈধ পথে ঢাকা থেকে ভারতের বেঙ্গালুরুতে পাচারের সময় আটবার হাতবদল করা হয়। কখনো ঘণ্টার পর ঘণ্টা হেঁটে, কখনো মোটরসাইকেলে করে, আবার কখনো ঝোপে-জঙ্গলে লুকিয়ে রেখে, কখনো গাড়িতে করে এবং সর্বশেষ আকাশপথে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় বেঙ্গালুরুতে। এই দীর্ঘ চলার পথে তরুণীরা গণধর্ষণের শিকার হয়।
বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর এভাবেই ভারতে পাচার হয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার অসহায় তরুণী। সীমান্তরক্ষীদের টাকা দিলেই তারা সীমান্ত পার হতে সাহায্য করে। মেয়েদের নিয়ে অনেক কাজই সহজ। মেয়েদের সঙ্গে সহজেই প্রতারণা করা যায়, মেয়েদের ভয় দেখানো সহজ, মেয়েদের বিক্রি করে দেয়া সহজ, এমনকি মেয়েদের সীমান্ত পার করানোও সহজ। এমন সহজ কাজটি তাই হয়তো অনেকেরই উপার্জনের উৎস। নারীকে তারা যৌনবস্তু বলে মনে করে। তাই নারীর ওপর তারা যৌন নির্যাতন চালায় অনায়াসেই। নারীকে তারা যৌনপণ্য মনে করে। তাই তারা সেই পণ্যকে এক শহর থেকে অন্য শহরে, এক দেশ থেকে অন্য দেশে পাচার করে দেয়। নারীকে বানিয়ে দেয়া হয় পতিতা। তারপর একদল পুরুষ দিব্যি প্রচার করে বসে- মেয়েরা স্বেচ্ছায় পতিতা হয়; তারা প্রাপ্তবয়স্ক, স্বেচ্ছায় এ পেশায় নাম লিখিয়েছে। তারা কিছুতেই স্বীকার করে না যে, পতিতাবৃত্তির সঙ্গে নারীপাচার অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বাস্তবে এ দুটি একে অপরের পরিপূরক। বেশিরভাগ পতিতাকে জোর করে বা ভুলিয়ে-ভালিয়ে বা অপহরণ করে বা পাচার করে বিক্রি করে দেয়া হয়। পতিতাবৃত্তিতে নারীদের দারিদ্র্য ঘোচে না। বরং এর ফলে লাখো-কোটি টাকা আয় হয় নারী পাচারকারী আর যৌনব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর। পতিতা প্রথা মূলত যৌন নির্যাতন ব্যতীত কিছুই নয়। আর তাতে আর্থিক লাভটা লোভনীয় বলে টিকটক হৃদয়ের মতো একদল পশু নারী পাচার করছে, যৌন ব্যবসায় জড়িত হয়ে পড়ছে। এ ব্যবসায় কাঁচামাল হচ্ছে দুর্ভাগা, অনাথ, দরিদ্র আর প্রতারিত মেয়েদের শরীর। আর তাই নিয়ে জমজমাট ব্যবসা করছে টিকটক হৃদয়ের মতো কত নাম না জানা সভ্যতার শত্রæরা।
এরা ধরা পড়ে না, ধরা পড়লেও এদের বিচার হয় না। বিচার হলেও প্রমাণের অভাবে এদের শাস্তি হয় না। পাচার হওয়া তরুণীদের অভিভাবকরা ভয়ে থাকে, অস্থির থাকে, লজ্জায় থাকে। সামাজিক বদনাম যেন তাদের ভাগ্যের ফসল। একদিকে কন্যাসন্তানের পাচার হয়ে যাওয়া, আর অন্যদিকে তা জানাজানির ফলে সামাজিক গøানির যন্ত্রণা- সবদিক থেকে যেন এক অন্ধকার ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করে পাচার হয়ে যাওয়া পরিবারের জন্য। বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়ে যাওয়া নারীদের পরিবার প্রায়ই ফোন পায় ভারতীয় নম্বর থেকে। দাবি করা হয় টাকার। বলা হয়, টাকা দিলে মেয়েদের আবার দেশে ফেরত পাঠানো হবে। টাকা না দিলে তাদের দিয়ে টিকটক-অশ্লীল ভিডিও করে তাদের দুবাই বিক্রি করে দেয়া হবে বলে হুমকি দেয়। পাচারের এমন ঘটনা বাংলাদেশে ঘটেই যাচ্ছে। সমাজ, রাষ্ট্র এবং সরকারের চোখের সামনে দিয়েই এসব ঘটে যাচ্ছে। বাংলাদেশের নারীদের প্রথমে ভারত এবং পরে ভারত থেকে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে সহজে পাচার করা হচ্ছে।
গণতন্ত্র নাকি মানবাধিকারের কথা বলে, নারী-পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলে! গণতন্ত্রের সেই সংজ্ঞাই তো থাকে না, যদি সমাজ-রাষ্ট্র নারীদের পাচার হতে দেখতে থাকে, যদি পাচারকারীর সামনে ন্যায়দণ্ডের অমোঘ বাণী নিয়ে প্রশাসন আর বিচারব্যবস্থা শক্ত হয়ে দাঁড়াতে না পারে। টিকটক হৃদয়রা গতকালও ছিল, আজো আছে। আমাদের চারপাশেই আছে। সমাজ আর রাষ্ট্র কি নিশ্চিত করতে পারবে- আগামীকালটা টিকটক হৃদয়দের জন্য সুবিধা বয়ে আনবে না?

মেজর (অব.) সুধীর সাহা : কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়