সবুজ বাংলাদেশকে সবুজতর করার আহ্বান আইজিপির

আগের সংবাদ

হুমকির মুখে রোহিঙ্গা জাতিসত্তা : বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের প্রস্তাব নিয়ে কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত

পরের সংবাদ

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী, জাতীয় শোক দিবস ও বঙ্গবন্ধু

প্রকাশিত: আগস্ট ১৩, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ১৩, ২০২১ , ৭:৫৪ অপরাহ্ণ

১৯৭১ সালের এপ্রিলের ৫ তারিখ News Week পত্রিকা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখেছিল, ‘Mujib can attract a crowd of million people to his rallies and hold them spellbound with great rolling waves of emotional rhetoric. He is the poet of politics. So his style may be just what was needed to unite all the classes and ideologies of the region.’ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসেও বঙ্গবন্ধু একইভাবে শ্রেণি নির্বিশেষে গোটা জাতিকে আন্দোলিত করেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শে, দেশপ্রেমের দর্শনে এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞায়। ১৯৭১ থেকে ২০২১ সাল। গোটা ৫০ বছর। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছর। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে ন্যক্কারজনক হত্যাকাণ্ডের পর ৫০ বছরের বাংলাদেশে ৪৫ বছরই শারীরিকভাবে বঙ্গবন্ধু নেই। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন বাংলার সুফলা মাটিতে, বাংলার সুনীল আকাশে, বাংলার নির্মল বাতাসে, বাংলার নদীবৃক্ষ-প্রকৃতির সমারোহে, বাংলার ফুল-পাখি-প্রাণবৈচিত্র্যের কলকাকলীতে এবং এদেশের বিস্তৃত প্রান্তরে যেখানে ধুলোমাখা মাটিতে গড়াগড়ি খায় আগামী বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন কৃষকের ফসলি মাঠে, শ্রমিকের পরিশ্রমের ঘামে এবং মেহনতি-মজদুরের অক্লান্ত জীবনযুদ্ধে। বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন বাংলার মানুষের মনে, মননে, আদর্শে, দর্শনে, দেশপ্রেমে, জাতিগঠনে এবং উন্নয়নের অগ্রযাত্রার সক্রিয় অবদানে। তাই বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যার ৪৫ বছর পরও বঙ্গবন্ধু সমান সক্রিয়তায় বেঁচে আছেন তাঁর আদর্শে এবং দর্শনে। যার অনিবার্য প্রতিফল আজকের মধ্যম আয়ের উন্নয়নশীল বাংলাদেশ। যে বাংলাদেশকে হেনরি কিসিঞ্জার ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে মশকরা করেছিল, সেই বাংলাদেশ আজ খাদ্যের স্বয়ংসম্পূর্ণতায় ‘উপচে পড়া ঝুড়ির দেশ’। প্রায় ৪৫ বিলিয়ন বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের দেশ আজ বাংলাদেশ। মধ্যম আয়ের দেশ আজ বাংলাদেশ। মহাকাশে স্যাটেলাইট উড়ানোর দেশ আজ বাংলাদেশ। দরিদ্র-বন্যাদুর্গত-পশ্চাৎপদ সেই বাংলাদেশ আজ ডিজিটাল বাংলাদেশ। এসবই সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধুর অকৃত্রিম দেশপ্রেমের আদর্শ, দেশের মানুষের প্রতি নিখাদ ভালোবাসার উত্তরাধিকার এবং গণমুখী রাজনৈতিক দর্শনের সক্রিয় পরম্পরা, যা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা রূপায়ণের প্রক্রিয়া বাংলাদেশকে পরিচালনার কারণেই সম্ভব হয়েছে। তাই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে জাতীয় শোক দিবসের স্মরণ ও স্মৃতিচারণ কেবলই শোকের মাতনের ভেতর দিয়ে না করে, শোককে কীভাবে শক্তিতে পরিণত করে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে উজ্জ্বীবিত রেখে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন, আদর্শ ও দর্শনকে সক্রিয়ভাবে কাজে লাগিয়ে দেশকে আরো সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, তা নিয়ে সক্রিয়ভাবে চিনতে হবে।
২০২১ সাল স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছর। তাই বিগত ৫০ বছরে বাংলাদেশ কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে সেটা বিচার-বিশ্লেষণ করা জরুরি, কেননা বর্তমানকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পারার মধ্যেই ভবিষ্যৎ নির্মাণের রূপরেখা তৈরি করা সম্ভব। এখানে যেটা মনে রাখা জরুরি সেটা হচ্ছে, স্বাধীনতা-উত্তর বিগত ৫০ বছরের মধ্যে সামরিক শাসন ছিল ১৫ বছর। সামরিক সমর্থিক তত্ত্বাবধায়ক ছিল ২ বছর। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ছিল ১০ বছর। সব মিলিয়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বাইরের বলয়ের শাসকরা এদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল সব মিলিয়ে প্রায় ২৭ বছর। এ ২৭ বছর বঙ্গবন্ধুর আদর্শ এবং অবদানকে মুছে ফেলার নানা ষড়যন্ত্র হয়েছে। ইতিহাসের বিকৃতির চেষ্টা হয়েছে নানা কৌশলে। স্বাধীনতার ঘোষণাকে বিতর্কিত করে বেহুদা ফায়দা নেয়ার চেষ্টা হয়েছে। রাষ্ট্র ক্ষমতায় থেকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তিকে ক্ষমতার অংশীদারিত্ব দেয়া হয়েছিল এদেশে। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করে রাজাকার, আলবদর ও আলশামসের নেতাদের গাড়িতে তুলে দেয়া হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। কিন্তু সব ধরনের বিকৃতির প্রচেষ্টা, সব ধরনের ষড়যন্ত্র ও বহুবিধ চক্রান্তকে মোকাবিলা করে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, বঙ্গবন্ধুর দর্শন এবং বঙ্গবন্ধুর উত্তরাধিকারের শক্তির বলেই আজকে এদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় বঙ্গবন্ধুর আদর্শেরই রাজনৈতিক দল। ফলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের ক্রমবর্ধমান বিকৃতি বন্ধ হয়েছে। নতুন প্রজন্ম একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের দাবি নিয়ে সামনে এসে শাহবাগের মতো নতুন ইতিহাসের জন্ম দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সরকারই এ মাটিতে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীর বিচার করেছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সব সদস্যকে যেভাবে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল, ইতিহাসের সে নিকৃষ্টতম হত্যাকাণ্ডেরও বিচার করা হয়েছে। নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি আগামী দিনের বাংলাদেশ যেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সত্যিকার সোনার বাংলায় পরিণত হয়, সে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। যাঁর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের স্রোতে ভেসে এবং ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জত-সেক্রিফাইসের ভেতর দিয়ে যে স্বাধীনতা আমরা অর্জন করেছিলাম, আমাদের কিছু নিমকহারাম এবং কুলাঙ্গার সেই জাতির পিতাকেই সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে ১৯৭৫ সালে। কিন্তু আমাদের মনে রাখা জরুরি যে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার উদ্দেশ্য কেবলই একজন ব্যক্তি, একজন রাষ্ট্রপ্রধান বা একটি দলীয় প্রধানকে হত্যা করা নয়। বরঞ্চ এ হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে একটি মাটিবর্তী আদর্শকে, একটি গণমুখী রাজনৈতিক দর্শনকে এবং একটি সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের স্বপ্নকে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছিল। জাতির শত্রু ও পাকিস্তানের প্রেতাত্মা এসব কুলাঙ্গার বুঝতে পারেনি যে, বঙ্গবন্ধু কেবল একজন ব্যক্তি নন, বঙ্গবন্ধু ইতিহাসের পরম্পরায় জন্ম নেয়া একটি দূরদর্শী রাজনৈতিক দর্শন, এদেশের মাটি ও মানুষের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির একটি স্বপ্ন, দেশ মাতৃকার জন্য আত্মত্যাগের মহিমায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এবং স্বাধীনতার মূল্যবোধ সুরক্ষায় সদা জাগ্রত একটি চেতনার নাম বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু বাংলা ও বাঙালির অকৃত্রিম দেশপ্রেমে গড়ে ওঠা একটি মজবুত ও টেকসই সোনার বাংলা গড়ার দৃঢ় প্রত্যয়ের নাম। তাই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশের সর্বত্র আজ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনা বাংলার আভা আর ঔজ্জ্বল্য। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শ এবং একটি সুন্দর, সুখী ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন আজ অনেকটা বাস্তব রূপে হাজির।
পরিশেষে বলব, ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের প্রাক্কালে গোটা জাতি যেমন জাতির জনক এবং তার পরিবারের সব সদস্যকে হারানোর স্মৃতিতে আবেগ-আপ্লুত হয়ে পিতা হারানোর বেদনায় নীল, তেমনি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আজকের বাংলাদেশের উন্নয়ন, সমৃদ্ধি এবং অগ্রগতিতে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলার খানিকটা ছায়াপাত আমাদের আত্মবিশ্বাসী করে এবং আত্মপ্রত্যয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা জোগায়। এ প্রেরণা নতুন প্রজন্মের অন্তরে এবং চেতনায় সঞ্চারিত করতে হবে যাতে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন, বঙ্গবন্ধুর দর্শন এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শ চির অমøান, অমলীন এবং জাগরূক থাকে। কেননা আজকের প্রজন্মই আগামী দিনের বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেবে এবং স্বাধীনতার চেতনার ধারক-বাহক। এভাবে নতুন প্রজন্মের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন, রাজনৈতিক দর্শন ও দেশপ্রেমের আদর্শের অবিনাশী চেতনা সঞ্চারিত করার মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা সত্যিকার বাস্তবে রূপ পাবে। তাই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে জাতীয় শোক দিবসের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে এবং দর্শনে উদ্বুদ্ধ হয়ে শোককে শক্তিতে পরিণত করতে হবে। কেননা বঙ্গবন্ধু অমর, অক্ষয় এবং অবিনাশী। কারণ বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন এবং বেঁচে থাকবেন তাঁর আদর্শ এবং দর্শনে। বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন এবং বেঁচে থাকবেন নতুন প্রজন্মের চেতনায় বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্ন গড়ার প্রেরণায়।
ড. রাহমান নাসির উদ্দিন : নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়