শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি : চলতি সপ্তাহেই শতভাগ শিক্ষক টিকার আওতায়

আগের সংবাদ

উৎসবের গণটিকায় বিশৃঙ্খলা

পরের সংবাদ

আজন্ম বিপ্লবী মুবিনুল হায়দার চৌধুরী

প্রকাশিত: আগস্ট ৯, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ৯, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মুবিনুল হায়দার চৌধুরী অসুস্থ ছিলেন জানতাম, কিন্তু তাকে দেখে কখনো মনে হয়নি তার কোনো প্রকার অসুখ ছিল। প্রসন্ন থাকতেন; এবং সর্বদাই অবিচলিত। আসলেই অত্যন্ত শক্ত ছিল তার মেরুদণ্ড। মেরুদণ্ড সবারই থাকে, থাকতে হয়; কিন্তু শক্ত মেরুদণ্ড বেশ বিরল। আমাদের এই কমরেডের মেরুদণ্ড ছিল বিস্ময়কর রকমের দৃঢ়। কোনো অবস্থাতেই তিনি নড়তেন না। সংকটে থাকতেন ধীর ও স্থির।
হায়দার ভাই রাজনীতিক ছিলেন। আমাদের দেশের রাজনীতিতে দল অনেক; কিন্তু ধারা দুটি। একটি ধারা রক্ষণশীল, অন্যটি বিপ্লবী। রক্ষণশীল ধারার মধ্যে এপার ওপার আছে; কেউ কট্টরপন্থি, এমনকি প্রতিক্রিয়াশীল; অন্যরা উদারনীতিক। উদারনীতিকরা সংস্কারপন্থি হতে পারেন, এমনকি বিপ্লবের কথা বলাও তাদের জন্য অসম্ভব নয়। কিন্তু উদারনীতিকরাও শেষ পর্যন্ত রক্ষণশীলই। বিপ্লবীরা সমাজ বিপ্লবে বিশ্বাস করেন। পথের পার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু তারা চান সমাজে ও রাষ্ট্রে মৌলিক পরিবর্তন। ধারা দুটি স্বতন্ত্র। হায়দার ভাই বিপ্লবী ধারার রাজনীতিক ছিলেন।
কিশোর বয়সেই তাকে বিপ্লবের স্বপ্নে পেয়েছিল। আমৃত্যু সেই স্বপ্নকে লালন করেছেন। কিন্তু তিনি তো বিপ্লবকে পাননি। না-পাওয়ার কারণ আমরা সবাই জানি। সমাজে ও রাষ্ট্রে অনেক কিছুই ঘটেছে; কোনো কোনো পরিবর্তন বেশ বড় রকমের, কিন্তু আসল বিপ্লব যে সমাজ বিপ্লব সেটা ঘটেনি। হায়দার ভাই সেই বিপ্লবকে সম্ভব করার জন্য নিজের জীবনকে নিযুক্ত করেছিলেন। সরেননি, নড়েননি।
ব্যক্তি হিসেবেও হায়দার ভাই ছিলেন অসাধারণ। আমার সুযোগ হয়েছিল তার সঙ্গে একবার কলকাতায় যাবার। সময়টা ছিল নজরুল জন্মশতবর্ষের। সোশ্যালিস্ট ইউনিটি সেন্টার অব ইন্ডিয়া পশ্চিমবঙ্গ শাখা বিপ্লবী কবির জন্মশতবর্ষ উদ্যাপন করছিল। সে উপলক্ষেই যাওয়া। সেখানে অনেকের সঙ্গে দেখা হয়েছে, আলাপ হয়েছে; অংশগ্রহণ ঘটেছে। সবটাই ছিল আনন্দের। কিন্তু সবচেয়ে বেশি আনন্দের ছিল হায়দার ভাইয়ের সঙ্গ। কলকাতা ছিল তার নখদর্পণে। ছেলেবেলায় আমিও কিছুকাল ওই শহরে কাটিয়েছি। আমরা দুজনে অনেক জায়গায় গেছি। দেখেছি সাংস্কৃতিকভাবে তিনি কতটা উন্নতমানের ছিলেন।
বস্তুত সংস্কৃতিতে ছিল তার বিশেষ অবস্থান। তার নিজের সংস্কৃতিতে ছিল পরিচ্ছন্ন রুচি ও বৈজ্ঞানিকতা। সংস্কৃতিকে উন্নত না করতে পারলে যে সামাজিক বিপ্লব ঘটবে না এটা তার দল জানত, হায়দার ভাইও জানতেন বিশেষভাবে। আর ছিল নৈতিকতার বোধ। রাজনৈতিক নীতির প্রশ্নে যেমন অবিচল ছিলেন তেমনি ব্যক্তিগত নৈতিকতার ব্যাপারেও ছিলেন অত্যন্ত শক্ত। শক্ত হতে তিনি অন্যদেরকেও বলতেন। নৈতিক মেরুদণ্ড যে দৈহিক মেরুদণ্ডের চাইতেও অধিক কার্যকর এটা তাকে দেখে নতুন করে বুঝতাম।
মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর ভেতর আত্মপ্রকাশের কোনো আগ্রহ ছিল না। নিজেকে তিনি প্রচ্ছন্ন রাখতে চাইতেন। সেটাও ছিল তার সংস্কৃতি ও নৈতিকতার অংশ। ভাবতেন তিনি জীবিত ও জীবন্ত থাকবেন তার কাজের মধ্যে। কাজই হবে তার পরিচয়। কাজে তার বিরাম ছিল না। কিন্তু আবার অস্থিরতাও দেখিনি। রাজনীতিকদের মধ্যে তার মতো অঙ্গীকারবদ্ধ অথচ মৃদুভাষী মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। যুক্তি ছাড়া কথা বলতেন না; অথচ বিশ্বাসের ক্ষেত্রে ছিলেন অনড়।
ভেতরে নিশ্চয়ই অনেক রাগ ছিল। রাগ অনুরাগেরই ভিন্ন প্রকাশ। অনুরাগটা ছিল সুন্দর এক সমাজের প্রতি। আর সে জন্যই রাগটা ছিল বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থার অমানবিকতার ওপর। অনুরাগটা ছিল অত্যন্ত প্রবল, তাই রাগটাও ছিল গভীর ও গাঢ়। ঘৃণাহীন ভালোবাসা বলে তো কিছু নেই; হায়দার ভাই ভালোবাসতেন তার স্বপ্নকে, বরং সে কারণেই ঘৃণা করতেন বিদ্যমান ব্যবস্থাকে। তার সেই প্রেম ও ক্রোধ তাকে আজীবন ব্যস্ত রেখেছে। ব্যস্ত, কিন্তু অস্থির নন। তিনি জানতেন বিপ্লব ছাড়া মুক্তি নেই।
পুঁজিবাদ এখন তার নিজেরই নিকৃষ্টতম ও নিষ্ঠুরতম পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চলছে। চলবে। সেই সংগ্রামে হায়দার ভাই ছিলেন এবং থাকবেন। তার মতো মানুষদের প্রয়োজন সব সময়েই ছিল, এখন অনেক বেশি। সমাজ বিপ্লবের পথে আমরা যতই এগুবো হায়দার ভাই ততই উজ্জ্বল হয়ে উঠবেন। তার মতো মানুষদের প্রস্থান আছে, মৃত্যু নেই।
অস্বাভাবিক এক সময়ে অস্বাভাবিক সব ঘটনা ঘটছে। আমাদের অতি আপনজন মুবিনুল হায়দার চৌধুরী অসুস্থ ছিলেন, তাই বলে এত দ্রুত চলে যাবেন, এ আমরা কেউ ভাবিনি। করোনায় আক্রান্ত হয়ে তার মৃত্যু ঘটেনি। ঘটেছে নানা জটিল রোগাক্রান্তের কারণে। আর ওদিকে দেশ ও বিশ্বব্যাপী করোনা প্রাণ হরণ করছে। আমাদের প্রত্যেকেরই আপনজনদের কেউ না কেউ চলে গেছেন। আমার আপন ভাইদের একজন। যার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল ভাইয়ের নয়, বন্ধুরও। সেও চলে গেল বছরখানেক আগে।
মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক সামাজিক ছিল না, ছিল মতাদর্শিক। কেবল আমার নয়, এদেশের বামগণতান্ত্রিক আন্দোলনের বহু, অসংখ্য মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল। সর্বোপরি মতাদর্শিত রাজনৈতিক চেতনায় ঋদ্ধ অবিচল অনড় কমরেড হায়দার তার নীতিনিষ্ঠতার জন্য ভিন্ন মতাবলম্বীদের কাছেও ছিলেন শ্রদ্ধার মানুষ। অজাতশত্রæ মানুষ সমাজে যে নেই এমন নয়; কিন্তু একই সঙ্গে রাজনৈতিক মতাদর্শ ও আন্দোলনের ব্যাপারে অনমনীয় এবং দল ও মতের সীমা অতিক্রম করে সবার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ হওয়ার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন একটি দৃষ্টান্ত। কার্ল মার্কসের সমাধির পাশে দাঁড়িয়ে ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস বলেছিলেন যে মতাদর্শগতভাবে মার্কসের বিরুদ্ধে অনেকেই ছিলেন, কিন্তু ব্যক্তিগত শত্রæ একজনও ছিল কিনা সন্দেহ; একই কথা খাঁটি মার্কসবাদী মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর সম্পর্কেও সত্য।
লড়াকু ছিলেন। লড়ছিল সে ব্যবস্থার বিরুদ্ধে, ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়। দৃষ্টিভঙ্গিটা ছিল বৈজ্ঞানিক, আবার একই সঙ্গে আবেগে সমৃদ্ধ।
মুখকে মুখোশে ঢেকে ফেলার সময় চলছে এখন। বলা হচ্ছে এটা সাময়িক। করোনা নিয়ন্ত্রণে আসবে; তা আসবে ঠিকই, তবে আরো ভয়ংকর বিপদ আসার আশঙ্কা যে ঘুচে যাবে তা নয়, সেটি থাকবে, এবং সে বিপদের মোকাবিলা করতে হলে শুধু বিপদকে নয়, যে বিশ্ব ব্যবস্থা থেকে বিপদের পর বিপদের উদ্ভব তাকে পাল্টে ফেলা চাই। চাই বিচ্ছিন্নতা হটিয়ে সংলগ্ন হওয়া, ঐক্য গড়ে তোলা। বৈপ্লবিক আন্দোলনকে বেগবান ও সর্বত্র বিস্তৃত করা। ওই আন্দোলন যত এগুবে কমরেড হায়দার ততই জীবন্ত হয়ে উঠবেন। তার মুখের অনাবিল হাসিটি সবার হাসিতে পরিণত হবে। এবং তাকে স্মরণ করা আনুষ্ঠানিক ব্যাপার হবে না, ব্যাপার হবে প্রাণের প্রতিধ্বনির। ওই আগামীকালের জন্যই তারা লড়েছে। এই লড়াই জয়ী হোক।
তার অমর স্মৃতির প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা রইল এবং কৃতজ্ঞতা রইল তার কাজের জন্য। অনিবার্য সামাজিক বিপ্লব ত্বরান্বিত হোক।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়