পরীমনরি ঘনষ্ঠি কে এই কবীর

আগের সংবাদ

তালিকায় হাইপ্রোফাইলদের নাম

পরের সংবাদ

বঙ্গবন্ধুর গ্রিন সিগন্যাল

প্রকাশিত: আগস্ট ৮, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ৮, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

১৯৬৬ সালের শুরুর দিকের ঘটনা। বঙ্গবন্ধু তখন আলফা ইন্স্যুরেন্সে কাজ করতেন। সেখানে বসেই আলাপ হচ্ছিল প্রখ্যাত সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর সঙ্গে। ছয় দফা কর্মসূচি সামনে রেখে আন্দোলনে যাবেন কিনা তা নিয়ে। সেই কথোপকথন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ‘ধীরে বহে বুড়িগঙ্গা’ থেকে তুলে ধরলাম ‘… মুভমেন্ট তো শুরু করতে চাই, কিন্তু জোরালো সমর্থন পাচ্ছি না অনেকের কাছ থেকে। ‘ইত্তেফাকের’ মানিকমিয়া দ্বিধাগ্রস্ত, আমার দলের প্রবীণ নেতারা ভীত। অথচ দলের তরুণ ও ছাত্রদের মধ্যে অদম্য উৎসাহ। তাদের ইচ্ছা আমি এগিয়ে যাই। বললাম, তাহলে তো আপনাকে এগিয়ে যেতেই হবে।
: আমি গ্রিন সিগন্যালের অপেক্ষায় রয়েছি। বঙ্গবন্ধু বললেন।
: আপনাকে আবার গ্রিন সিগন্যাল কে দেবেন?
: তোমাদের ভাবি।’
এর আগে জেনে নেই ‘তোমাদের ভাবি’র আড়ালে থাকা সেই প্রজ্ঞাময়ী নারীর কথা। বঙ্গবন্ধুর ভাষ্য মতে, ‘রেণুর দাদা আমার দাদার চাচাতো ভাই।’ কীভাবে এই নারীকে তিনি জীবনসঙ্গিনী হিসেবে পেলেন তার বর্ণনা মেলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রচিত ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে-
‘আমি শুনলাম আমার বিবাহ হয়েছে। তখন কিছুই বুঝতাম না, রেণুর বয়স তখন বোধহয় তিন বছর হবে। রেণুর যখন পাঁচ বছর বয়স তখন তার মা মারা যান। একমাত্র রইল তার দাদা। দাদাও রেণুর সাত বছর বয়সে মারা যান। তারপর, সে আমার মায়ের কাছে চলে আসে। আমার ভাইবোনদের সাথেই রেণু বড় হয়…
…যদিও আমাদের বিবাহ হয়েছে ছোটবেলা। ১৯৪২ সালে আমাদের ফুলশয্যা হয়…’
মাত্র ৩ বছর বয়সে ‘রেণু’ শেখ মুজিবের স্ত্রী হলেন, ৭ বছর বয়সে এতিম আশ্রয় পেলেন শ্বশুরের গৃহে আর ১২ বছর বয়সে স্বামীসঙ্গ। আজকের প্রেক্ষপটে মনে হতে পারে পুতুল খেলার মতো সবকিছু। কিন্তু এই বয়সেই কী অসাধারণ ধীশক্তি আর ধৈর্য নিয়ে তিনি সংসারের হাল ধরেছিলেন তার বড়কন্যা শেখ হাসিনার লেখা থেকে আমরা পাই ‘…সংসার চালাতে হচ্ছে, আওয়ামী লীগের নেতাদের সাহায্য করতে হচ্ছে। কে অসুস্থ তাকে টাকা দিতে হচ্ছে। কখনো অভাব কথাটা মায়ের কাছ থেকে শুনিনি। এমনও দিন গেছে বাজার করতে পারেননি। আমাদের কিন্তু কোনো দিন বলেননি আমার টাকা নেই, বাজার করতে পারলাম না। চাল-ডাল দিয়ে খিচুড়ি রান্না করেছেন, আচার দিয়ে বলেছেন প্রতিদিন ভাত ভালো লাগে নাকি; আজকে আমরা গরিব খিচুড়ি খাব। এটা খেতে খুব মজা। আমাদের সেভাবে তিনি খাবার দিয়েছেন। একজন মানুষ তার চরিত্র দৃঢ় থাকলে যে কোনো অবস্থা মোকাবিলা করার মতো ক্ষমতা ধারণ করতে পারে। অভাব-অনটনের কথা, হা-হুতাশ কখনো আমার মার মুখে শুনিনি।’
১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি। ২১ মাস বঙ্গবন্ধুকে আটক রাখার পর জেল গেট থেকে আবার গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয়। শুরু হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কার্যক্রম। প্রথম দিকে নেতাকর্মী সবাই ভয়ে সরে যায়। এই সংকট মুহূর্তে রান্নাঘর ছেড়ে আদালতে আবির্ভূত হন বঙ্গবন্ধুর প্রিয় ‘রেণু’। যার পোশাকি নাম শেখ ফজিলাতুন্নেছা। সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর বর্ণনায় ‘বিশেষ আদালতে এই মামলা চলার দিনটিতে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত বেগম মুজিব একবারও স্বামীর কাছে যাওয়ার চেষ্টা করতেন না। তিনি অন্যান্য বন্দির স্ত্রীর কাছে বসে থাকতেন। ধীরস্থির মূর্তি। হাতে পানের বাটা। মামলার তরুণ আসামিদের অনেক তরুণী স্ত্রী মাঝে মাঝে ভেঙে পড়তেন। কেউ কেউ কেঁদে ফেলতেন। তখন তারা ভাবতেন, এই ভয়াবহ ষড়যন্ত্র মামলা থেকে তাদের স্বামীদের রেহাই নেই। তারা সাজা পাবেন। কঠোর সাজা। হয় প্রাণদণ্ড, নয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। ভাগ্য খুবই প্রসন্ন না হলে কারও মুক্তিলাভের আশা নেই। মামলা চলার আগে আসামিদের কারো কারো ওপর চলেছে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য কঠোর নির্যাতন। তাদের কেউ কেউ মামলার দিন আদালতে এসে কেঁদে ফেলতেন। বেগম মুজিব তখন তাদের পাশে গিয়ে বসতেন। কারো চোখের পানি মুছিয়ে দিতেন, কারো মুখে খাবার তুলে দিতেন। নিজের চোখের পানি, নিজের বুকের বেদনা গোপন করে অকম্প কণ্ঠে তাকে বলতে শুনেছি, ‘তোমরা ভেঙে পড়ো না বোন। আল্লার ওপর বিশ্বাস রাখো।
বেগম মুজিবের কথায় কি জাদু থাকত জানি না, আশ্চর্য হয়ে দেখেছি, তাকে আদালতে দেখলে অনেক অভিযুক্তের হতাশায় ভেঙে পড়া স্ত্রী বা আত্মীয়স্বজন- এমনকি অভিযুক্ত নিজেও খুশি হয়ে উঠতেন। নতুন আশায় উদ্দীপ্ত হয়ে উঠতেন। মামলার শুনানি শেষে যখন স্ত্রী ও আত্মীয়স্বজন অভিযুক্তদের সঙ্গে দেখা করার সামান্য সময় পেতেন, তখন তারা আগে কে যাবেন তা নিয়ে তাদের মধ্যে ঠেলাঠেলি লেগে যেত। বেগম মুজিবকে সবাই সসম্মানে আগে যাওয়ার জন্য জায়গা ছেড়ে দিতেন। তিনি সবার পেছনে গিয়ে দাঁড়াতেন। হাসিমুখে বলতেন, তোমরা যুবতিরা আগে যাও। তোমাদের তো যুবক স্বামী। আমরা বুড়ার কাছে পরে গেলেও চলবে।’
এর মধ্যে গণ-আন্দোলনের মুখে আইয়ুব খান সরকারও হার্ডলাইন থেকে সরে আসে। আলোচনার ফাঁদ পেতে বঙ্গবন্ধুকে বাগে আনার জন্য প্যারলে মুক্তি দিয়ে রওয়ালপিন্ডি নিয়ে যাওয়ার তোড়জোড় শুরু করে। আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীও বঙ্গবন্ধুকে আলোচনায় যাওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু অপেক্ষা করছিলেন তার ‘গ্রিন সিগন্যালে’র জন্য। সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী সেটা জানতেন। তাই তিনি ছুটে গিয়েছিলেন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে। তিনি লিখেছেন ‘বললাম, মুজিব ভাই কি আজ রাওয়ালপিন্ডি যাচ্ছেন ভাবি?’ বেগম মুজিব নিস্পৃহ কণ্ঠে বললেন, না যাচ্ছেন না।
: তিনি গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দেবেন না?
: দেবেন, তবে আগরতলা মামলা তুলে নেয়া হলে, তাকে সকল বন্দিসহ মুক্তি দেয়া হলে।
: আপনাকে তিনি সে কথা জানিয়েছেন?
: তিনি জানাবেন কেন, আমিই তাকে জানিয়েছি। দেখা করতে গিয়ে মুখে বলেছি। আর ওই যে টিফিন কেরিয়ারটা দেখছেন, যেটা ভর্তি করে রোজ তার খাবার পাঠাই, তাতে ছোট্ট চিঠি লিখে ঢুকিয়ে দিয়েছি।
ভীষণ কৌতূহল হলো। বললাম, ভাবি, চিঠিতে কী লিখেছেন? বেগম মুজিবের চেহারায় কোনো ভাবান্তর নেই। বললেন, লিখেছি, আপনি যদি প্যারোলে মুক্তি নিয়ে আইয়ুবের গোলটেবিলে যান, তাহলে বত্রিশ নম্বরে আর ফিরবেন না।’
৩৯ বছরের এক গাঁয়ে বড় হওয়া, সেভাবে একাডেমিক কোনো ব্যাকগ্রাউন্ড না থাকা, এক নারীর চারিত্রিক দৃঢ়তার কথা চিন্তা করলে বিস্মিত হতে হয়। এই না যাওয়ার কারণে বাংলায় গণ-অভ্যুত্থান হয়েছিল। যার জোয়ারের তোড়ে ভেসে যেতে হয়েছিল জালিম আইয়ুব শাহীকে। বেগম ফজিলাতুন্নেছার এই এক সিদ্ধান্তের কারণে বাংলার রাজনীতি নতুন দিকে মোড় নিয়েছিল। ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় এসে ক্ষুব্ধ পূর্ব পাকিস্তানকে শান্ত করতে নির্বাচনের ঘোষণা দেন।
নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় পাওয়ার পরও সরকার গঠন নিয়ে শুরু হয় টালবাহানা। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ভাষণ। এই ভাষণেই তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে বলেন ‘এবার সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এই ঐতিহাসিক ভাষণের পেছনেও ছিল বেগম ফজিলাতুন্নেছার পরামর্শ। তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার লেখায় আমরা পাই ‘৭ মার্চের ভাষণের কথা বারবারই আমি বলি, বড় বড় বুদ্ধিজীবীরা লিখে দিয়েছেন এটা বলতে হবে, ওটা বলতে হবে, কেউ কেউ বলছেন এটাই বলতে হবে, না বললে সর্বনাশ হয়ে যাবে, এ রকম বস্তাকে বস্তা কাগজ আর পরামর্শ। গুরুত্বপূর্ণ কিছুতে যেতে হলে আমার মা কিন্তু আব্বাকে বলতেন কিছুক্ষণ তুমি নিজের ঘরে থাক, তাকে ঘরে নিয়ে তিনি একটা কথা বললেন যে, তোমার মনে যে কথা আসবে তুমি সে কথা বলবা। কারণ লাখো মানুষ সারা বাংলাদেশ থেকে ছুটে এসেছে, হাতে বাঁশের লাঠি, নৌকার বৈঠা নিয়ে। আর এদিকে পাকিস্তানি শাসকরাও অস্ত্র-টস্ত্র নিয়ে বসে আছে এই বলে যে, বঙ্গবন্ধু কি নির্দেশ দেন। তারপর মানুষগুলোকে আর ঘরে ফিরতে দেবে না। নিঃশেষ করে দেবে। স্বাধীনতার স্বাদ বুঝিয়ে দেবে, এটাই ছিল পাকিস্তানের সিদ্ধান্ত। আর সেখানে আমাদের কোনো কোনো নেতা বলে দিলেন যে, এখানেই বলে দিতে হবে যে, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। কেউ বলে, এটা বলতে হবে, ওটা বলতে হবে।’
তারপর ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে মুক্ত হলো বাংলাদেশ। কিন্তু বঙ্গবন্ধু পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি। ১৯৭২-এর ৯ জানুয়ারি খবর ছড়িয়ে পড়ে বঙ্গবন্ধু ফিরে আসছেন তার স্বাধীন দেশে। সাংবাদিকরা ছুটে যান বেগম মুজিবের কাছে। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২-এ কলকাতার দৈনিক যুগান্তরে ছাপা হয় তার অনুভূতির কথা। সেদিন বঙ্গবন্ধুপতœী বেগম মুজিবের একটি সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকার প্রকাশ করা হয়।
‘রাষ্ট্রের প্রধানা মহিলারূপে আপনার কেমন লাগছে?- ঢাকার ধানমন্ডিতে এক সংবাদিক রবিবার অপরাহ্নে বেগম মুজিবকে এ প্রশ্ন করে বাঙালি গৃহিণীর মনের কথা জানতে পেরেছেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে স্মিতহাস্য বেগম মুজিব বলেন, আমি বাড়ির গিন্নি। এ অবস্থায় আমার দায়িত্ব বিরাট, এক মস্ত বড় পরিবারের সব দায়িত্ব আমার ঘাড়ে। আমি রাজনীতিজ্ঞ নই। এখন আমি যদি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বেড়িয়ে বেড়াই, তাহলে আমার ঘর-গৃহস্থালি কে দেখবে? কত আটপৌরে, কত সাদামাটা ভাবনা। দেশ স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপতির স্ত্রী তার ঘর-গৃহস্থালি নিয়ে চিন্তিত। অথচ তাঁর ‘গ্রিন সিগন্যাল’ দেখে দেখে বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তির নৌকা ঘাটে ভিড়িয়েছিলেন। যে মহীয়সী নারীর প্রত্যুৎপন্নমতির কারণে এত কিছু, তিনি বলছেন, ‘আমি রাজনীতিজ্ঞ নই’। আমি বলব, উনি রাজনীতিজ্ঞদের চেয়েও অধিক বিচক্ষণ ছিলেন। বিশ্বের ইতিহাসে অনেক বড় বিপ্লবীকে দেখা যায় শেষমেশ স্ত্রীদের বেপরোয়া আচরণের কারণে কলঙ্কিত হতে। যেমন নেলসেন মেন্ডেলার স্ত্রী উইনি মেন্ডেলা কিংবা রবার্ট মুগাবের স্ত্রী গ্রেসিমুগাবের কথা বলা যায়। বেগম ফজিলাতুন্নেছা ক্ষমতা উপভোগের সেই পথে যাননি। মনোযোগ দিয়েছিলেন গার্হস্থ্য ধর্মে। মাত্র ৪৫ বছর বেঁচেছিলেন। এই স্বল্প-জীবনের পুরোটাই তিনি বঙ্গবন্ধুকে উজাড় করে দিয়েছেন। এই মহীয়সী নারী ১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। আজ তার ৯১তম জন্মবার্ষিকী। তাকে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।
ডা. এস এম মোস্তফা জামান : অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়