জন্মদিন : প্রমথ চৌধুরীর সাহিত্যচিন্তা

আগের সংবাদ

বঙ্গবন্ধুর চোখে বঙ্গমাতা

পরের সংবাদ

শতবর্ষে স্মৃতিময় এস এম হল

প্রকাশিত: আগস্ট ৭, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ৭, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আমার এই লেখাটিকে যিনি সহজ করে দিয়েছেন তিনি সলিমুল্লাহ হলের প্রাক্তন শিক্ষার্থী সমিতির (ছাত্র লেখা থেকে বিরত রইলাম কারণ এই হলের সঙ্গে ছাত্রীরাও অ্যাডাচড হতেন) সভাপতি, করোনাকাল শুরুর ঈষৎ আগে ১২ আগস্ট ২০১৯ প্রয়াত মীজানুর রহমান শেলী ২০০৩ সালের মার্চ মাসে আমাকে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ও তথ্যবহুল বই উপহার দেন। একটির শিরোনাম- ‘স্মৃতিময় এস এম হল’, আমার লেখাটিরও প্রায় একই শিরোনাম; অন্যটি সলিমুল্লাহ হল অ্যালামনি এসোসিয়েশনের মেম্বার্স ডিরেক্টরি ২০০৩। মানতেই হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য কোনো আবাসিক হল এবং এমনকি খোদ বিশ্ববিদ্যালয়েরই এ ধরনের এবং এমন মানের কোনো প্রকাশনা নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং এস এম হল উভয়েই শতবর্ষী, যাত্রা একই সঙ্গে ১৯২১ সালের জুলাই মাসে। প্রথমে হলটির নাম ছিল মুসলিম হল, ঢাকা মেডিকেল কলেজের পুরনো ভবনই সে হল। আর দুটি হলের একটি জগন্নাথ হল, অন্যটি ঢাকা হল। বর্তমান ভবনটি এখন ৯০তম বছরে; ১১ আগস্ট ১৯৩১ ভবনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর ও গভর্নর স্যার স্ট্যানলি জ্যাকসন এবং ১৯৩২ সালের ডিসেম্বর থেকে হলটি আনুষ্ঠানিকভাবেই সলিমুল্লাহ মুসলিম হল হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। ১৯৭২ সালে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ দেশে পুনঃনামায়ন হয়; সলিমুল্লাহ হল।
এই হলের জমিসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় পুরোটাই নবাব সলিমুল্লাহর দান- এ দাবি করা হয়; কেউ এ দাবির প্রতিবাদও করেন। নাম পরিবর্তন হলেও এখনো পূর্ণ নাম এস এম হলই সবার মুখে মুখে, এমনকি স্মৃতিগ্রন্থটির নাম রাখা হয়েছে স্মৃতিময় এস এম হল। হলের প্রথম প্রভোস্ট স্যার এ এফ রহমান, ১৯২১ থেকে ১৯২৬ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছেন, তিনিই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম ভাইস চ্যান্সেলর। তার পর ১৯৭১ পর্যন্ত যারা প্রভোস্টের দায়িত্ব পালন করেছেন তারা হচ্ছেন ফখরুদ্দিন আহমদ (১৯২৬-১৯২৭), এন এউ এ সিদ্দিকী (১৯২৭-১৯২৮, অবাঙালি), মাহমুদ হাসান (১৯২৮-১৯৩২, ১৯৩৩-১৯৪২; পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সলর), মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১৯৩২-১৯৩৩), সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন (১৯৪২-১৯৪৮), এম শফিউল্লাহ (১৯৪৮-১৯৪৯), মুহম্মদ ওসমান গনি (১৯৪৯-১৯৫৬), আবু হেনা (১৯৫৬-১৯৫৯), মফিজউদ্দীন আহমেদ (১৯৬৩-১৯৭০), মফিজউল্লাহ কবীর (১৯৭০-১৯৭১)। তাদের মধ্যে ফকরুদ্দিন আহমেদ, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও এম শফিউল্লাহ ছিলেন ভারপ্রাপ্ত প্রভোস্ট।
প্রফেসর ইমেরিটাস সিরাজুল হক ১৯২৩-১৯২৭ ব্যাচের শিক্ষার্থী। তিনি তার হলের প্রভোস্ট ইতিহাসের রিডার এ এফ রহমান সম্পর্কে লিখেছেন : ‘পরিপাটি বেশভূষা, অসাধারণ প্রজ্ঞা ও অমায়িক ব্যবহারের জন্য তিনি খুব শিগগিরই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক, কর্মচারী, কর্মকর্তা সকলের নিকট একজন জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। নিজস্ব মনন, প্রতিভা ও মতাদর্শ বলে তিনি মুসলিম হলের সামগ্রিক পরিবেশ গড়ে তোলেন। এ কাজে তিনি অক্সফোর্ডের প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগান। হলে তিনি ছাত্রদের ইউনিয়ন, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, ভোজ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ক্রীড়ানুষ্ঠান ও বিভিন্ন সমাজসেবামূলক তৎপরতার সূচনা করেন। প্রথম হল ম্যাগাজিন প্রকাশের কৃতিত্বও তারই। এমনি অসংখ্য শিক্ষামূলক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড স্যার এ এফ রহমানের মুসলিম হল থেকে সূচিত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য হলে তা বিস্তার লাভ করে।… ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নানাভাবে এই মনীষীর নিকট চিরঋণী।’
তিনি আরো জানাচ্ছেন, সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো গাড়ি ছিল না। চারজন চড়ার সুন্দর ব্যবস্থা করা ঘোড়ার গাড়িতে শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে ভাড়া লাগত আট আনা। এ এফ রহমানকেও তিনি ঘোড়ার গাড়িতে চড়তে দেখেছেন। ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে কোচোয়ানরা তার বাড়ির সামনে ঘুরঘুর করত, তাকে যে গাড়িতে তুলতে পারবে সেই ভাগ্যবান। কোচোয়ানরা জানত তিনি কখনো ১ টাকার কম ভাড়া দেন না।
মুসলিম হলে সংযুক্ত ছিলেন খোদেজা খাতুন, ১৯৩৫-১৯৩৯ ব্যাচের শিক্ষার্থী। ১৯৩৫ সালেই তিনি একমাত্র মুসলমান নারী শিক্ষার্থী। তিনি লিখেছেন : ‘১৯৩৭-৩৮ সালে ৩-৪ জন মুসলমান মেয়ে বিএ, এমএ ও এমএসসি পড়ার জন্য এসে ভর্তি হয়। আমি ভর্তি হওয়ার এগারো বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেগম ফজিলাতুননেসা অঙ্কশাস্ত্রে এমএ ডিগ্রি লাভ করে বিলেতে পড়তে যান।’
সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে সংযুক্ত হলেও ছাত্রীদের থাকার সুযোগ সেখানে ছিল না, খোদেজা খাতুনসহ আরো ক’জন থাকতেন ১০ নম্বর বাংলোতে, সেখানে আটজনের থাকার বন্দোবস্ত ছিল। তিনি যখন এমএ শেষ পর্বে উইমেনস রেসিডেন্স তখন বদলে গেল, তারা পেলেন আরো বড় এবং সুন্দর চামেরি হাউস (এখন সেন্টার ফর ইন্টেগ্রেটেড রুরাল ডেভেলপমেন্ট-সিরডাম, আশির দশকের শুরুতে এটা ছিল পাবলিক সার্ভিস কমিশন অফিস)। খোদেজা খাতুন ১০ নম্বর বাংলোর স্মৃতিচারণই বেশি করলেন :
বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গেই ছিল ১০ নম্বর বাংলো। প্রায় সময়ই ক্লাসের ঘণ্টা শুনে তবে আমরা ক্লাসে ছুটতাম বাংলো থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের বাড়িতে সে সময় ছিলেন মরহুম মনীষী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। প্রতি ঈদপর্বে ড. শহীদুল্লাহ ড. হাসান (মাহমুদ হাসান, পরে এস এম হলের প্রভোস্ট এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর), ড. মোয়াজ্জেম হোসেন এবং আরো অনেক শ্রদ্ধেয় প্রফেসর আবাসিক ছাত্রীদের সাদর আমন্ত্রণ জানাতেন। সেইসব স্নেহসিঞ্চিত মুহূর্তগুলো জীবনের অমূল্য সম্পদ।
ইডেন কলেজের অধ্যক্ষ খোদেজা খাতুনকে আমি দেখেছি, কথা বলেছি। তার একমাত্র পুত্র মাহবুব হোসেন খান ১৯৬৯ ব্যাচের সিএসপি, লেখক, দীর্ঘদিন তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছি। আমার বগুড়া চাকরি জীবনে খোদেজা খাতুনের ভাই কবি শমসের আলীকে পেয়েছি। ১৯৩৫-১৯৩৬ ব্যাচের মোনায়েমউদ্দিন আহমেদ ১৯৩৬ থেকে ১৯৩৮ পর্যন্ত ছিলেন ১৬৩ নম্বর রুমে, পরের বছর ওয়েস্ট হাউসের ৯৪ নম্বর রুমে। তখন প্রভোস্ট মাহমুদ হাসান, ইস্ট হাউসের টিউটর ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ওয়েস্ট হাউসে আবদুল হাদি তালুকদার। তার ইংরেজি স্মৃতি কথায় হলের পাক্ষিক উন্নত খাবার ভুনা খিচুড়ি এবং মাসিক ফিস্ট পোলাও-রেজালার প্রশংসা করেছেন। তিনি সিভিল সার্ভেন্ট ছিলেন। তার পুত্রদের তিনজনকে সরাসরি সহকর্মী হিসেবে পেয়েছি : একজন মেজর জেনারেল মনসুর আহমেদ; একজন পরবর্তীকালে বিমানে ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোসাদ্দিক আহমদ।
১৯৩৬-এ জিন্নাহ অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের সভাপতি হিসেবে এস এম হলে ছাত্রছাত্রীদের সমাবেশে যে কথা বলেছেন, মোনায়েমউদ্দিন লিখেছেন, এটা তার কানে বাজে : ‘তোমরা স্টেটসম্যান হবে, পলিটিশিয়ান হবে না। স্টেটসম্যান দেশের সেবা করে আর পলিটিশিয়ান চান দেশ তার সেবা করুক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনিদের একদা সভাপতি, সরকারের কৃষি ও বনমন্ত্রী আজীজ উল হক ১৯৪০ থেকে ১৯৪৫-এর মাঝামাঝি পর্যন্ত এস এম হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন। তিনি হলের ভেতরের আঙ্গিনায় গোলাপ, গন্ধরাজসহ বিভিন্ন মৌসুমি ফুলের সমারোহ আর পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি লনের কথা বলেছেন, দেয়ালে লিখন কিংবা পোস্টার সাঁটার বিষয়টি কারো জানাই ছিল না। নির্বাচনের সময় প্রচারপত্র টাঙানোর জন্য বিজ্ঞাপন বোর্ড ব্যবহার করা হতো। ডাইনিং হলের চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন :
‘হলের অন্য ঘরগুলোর তুলনায় ডাইনিং হলটি ছিল বেশি গন্ধযুক্ত এবং হৈচৈতে ভরা’ বাংলা, উর্দু, হিন্দি ও ইংরেজির অদ্ভুত মিশ্রণে আলাপচারী হতো ডাইনিং হলে। রাগের সময় ছাত্ররা এ ধরনের পাঁচমিশালি ভাষা বেশি ব্যবহার করত।
খাবারের ধরনটা ছিল একঘেয়ে। কিন্তু গুণগতমান ও পরিমাণের দিক থেকে তা আদৌ নিকৃষ্ট ছিল না। তরকারির চাহিদা ও জোগানের মধ্যকার ব্যবধানটা পূরণ করা হতো পর্যাপ্ত ডাল আর অপরিমিত ভাত দিয়ে। মাসিক ছ’টাকা (তখনকার দিনের) চার্জের বিনিময়ে ভাত, ডাল, ভাজি এবং এক টুকরো মাছ বা গোশত পাওয়া যেত। মাসে একবার ‘ফিস্ট’ বা উন্নতমানের খাবার দেয়ার ব্যবস্থা থাকত। রোগীদের জন্য দেয়া হতো চাপাতি ও সিদ্ধ সবজি।… সে সময় ইলেকট্রিক স্টোভের চলন ছিল না। তখন ফোটানো দুধ খুবই বিক্রি হতো। করিম নামের একজন দীর্ঘকায় তুখোড় লোক সবচেয়ে বেশি জ¦াল দেয়া দুধ বিক্রি করত।
কেবল দুধ নয়, মিষ্টি নিয়ে আসত মিষ্টভাষী অনাথ বন্ধু। বিকালের দিকে অনেক ছাত্র নিয়মিত মিষ্টি খেত।
ইংরেজির বিভাগীয় প্রধান অক্সফোর্ডে পড়াশোনা করা মাহমুদ হাসান ছিলেন সে সময় প্রভোস্ট (তিনি পরবর্তীকালের ভাইস চ্যান্সেলর), তাকে সহায়তা করতেন দর্শনের লেকচারার আবদুল হাদী তালুকদার, মৃত্তিকা বিজ্ঞানের লেকচারার ড. এম ওসমান গনি (তিনিও পরবর্তীকালে ভাইস চ্যান্সেলর) আর অর্থনীতির লেকচারার ড. রকীব উদ্দীন আহমেদ, তার সময়ের সহকারী হাউস টিউটর ড. এ আর মল্লিক (পরবর্তীকালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর এবং অর্থমন্ত্রী) এবং ফজলুর রহমান।
স্মর্তব্য, এই হলেরই হোসনে আরা হক (১৯৫৫-৫৯), ইংরেজির ডাকসাইটে অধ্যাপক ছিলেন আজীজ উল হকের স্ত্রী। পাকিস্তান আমলের শেষদিকে যারা স্কুলের ওপরের ক্লাসে কিংবা কলেজে পড়তেন ডিপিআই ফেরদৌস খানের নাম তাদের জানা। ডিরেক্টর পাবলিক ইনস্ট্রাকশন। আমি এবং আমার ক্লাসের বন্ধুরা তাকে চিনতাম আরো আগে। তিনি অতিথি হয়ে স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানে এসেছেন, আমরা তাকে গার্ড অব অনার দিয়েছি। আর তার মেধাবী ছেলেরাও আমাদের একই স্কুলের ছাত্র- গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুল। আমি তার কাছ থেকেই তার আত্মজীবনী ‘জীবনের ঘাটে ঘাটে’ পেয়েছি, তাতে এস এম হলের স্মৃতি এবং প্রফেসর সত্যেন বসুর ছাত্র হওয়ার গৌরবের কথা লিখেছেন। ১৯৪১ থেকে ১৯৪৩ এই ছিল হলে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার অবস্থানকাল। তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞানে বিএসসি পাস করে ঢাকায় এসে এমএসসিতে ভর্তি হয়েছিলেন।
রমেশচন্দ্র মজুমদার ভাইস চ্যান্সেলর আর খান বাহাদুর নাজিরউদ্দিন আহমেদ রেজিস্ট্রার। সলিমুল্লাহ হলের এবং চার পাশের মনোরম পরিবেশে তার মনে হয়েছে রমণীয় শব্দ থেকেই রমনার নামকরণ। তিনি ভেবেছিলেন সত্যেন বসু গুরুগম্ভীর ও কড়া মেজাজের হবেন। কিন্তু তাকে ধারণা পাল্টাতে হলো- ‘টের পেলাম বেশ সহজেই তিনি আমাকে তার কাছে টেনে নিয়েছেন, বুঝলাম শিশুর মতো কোমল সংবেদনশীল দরদি তার মন। কোনো অহমিকা নেই, ছাত্রদের সঙ্গে কথাবার্তায় বেশ সহজ… তিনি যে আমারই মতো মায়োপিক মোটা চশমা ব্যবহার করছেন তাতেও একাত্মতা বোধ করছিলাম।’ দুর্ভাগ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের, তখনকার কর্তাব্যক্তিরা তাকে চায়নি। তিনি ফিরে গেছেন।
একটি তথ্য জানা দরকার- ‘যুদ্ধের কারণে (দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ) আমাদের সলিমুল্লাহ হল ছেড়ে বর্তমান মেডিকেল কলেজ ভবনের একাংশে সরে যেতে হয়েছিল। আর সলিমুল্লাহ হলের তখন সেনা হাসপাতাল হওয়ার কথা। অনেক বাধাবিপত্তি পেরিয়ে ফেরদৌস খান এমএসসিতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। স্মৃতিকথায় তিনি অনেকবার সত্যেন বসুর কথা বলেছেন। তিনি রবীন্দ্রনাথ থেকে উদ্ধৃতি দিতেন। তিনি ফেরদৌস খান ও তার সহপাঠী মতিন চৌধুরীকে (পরে ভাইস চ্যান্সেলর) কিছু জার্মান ভাষাও শিখিয়েছেন।
১৯৪০-১৯৪৬ এস এম হলে কবীর চৌধুরীর অবস্থানকাল। তার স্মৃতিতে হলের খাবারের যে রসময় বর্ণনা সেটাই উদ্ধৃত করতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু তিনি তো তার প্রেম ও বিয়ের কাহিনীও বলেছেন অকপটে, বরং সেটাই হুবহু উদ্ধৃত করি :
‘সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে বাসকরাকালীনই দুবার প্রেমে পড়ি। প্রথম প্রেমের শুরু হলো বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের একেবারে গোড়ার দিকে। এক ক্লাসে পড়ি, স্বাভাবিকভাবেই রোজ দেখা হয়- শ্রেণিকক্ষে, লাইব্রেরিতে, মাঝে মাঝে অন্যত্রও। মেয়েটি অন্য ধর্মের। শেষ পর্যন্ত এ প্রেম স্থায়িত্ব পায়নি, ধর্মের কারণে নয়, অন্য কারণে।
মেয়েটি অনার্স শেষ না করে বিএ পাস ডিগ্রি নিয়েই কলকাতা চলে যায় আর পড়াশোনা করেনি। সেটা ১৯৪২-এর শেষ দিক কিংবা ১৯৪৩-এর গোড়ার দিকের কথা। আর ওই ১৯৪৩ সালেই আমার দেখা হলো সেই শ্যামল রং রমণীর সঙ্গে, যার দীর্ঘ মোটা বেণি কোমর-নিতম্ব ছাড়িয়ে আরো নিচে নেমে গেছে, সাধারণ বাঙালি মেয়ের তুলনায় সে রীতিমতো লম্বা, যাকে প্রথম দর্শনেই আমার মনে হয় অত্যন্ত ব্যতিক্রমে নানা দিক দিয়ে। পড়েছে ফলিত রসায়ন, গবেষণা করেছে, কলকাতার স্কটিশ চার্চ, ডগলাস হোস্টেল আর সায়েন্স কলেজের অভিজ্ঞতা নিয়ে এসেছে, প্রত্যক্ষ সাহচর্য পেয়েছে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের।’
কবীর চৌধুরীর তো ভালো লাগারই কথা। এই মেয়েটিও সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের, ১৯৪৩-১৯৪৬ ব্যাচের রসায়নের ছাত্রী- তার চোখের দৃষ্টি দ্যুতিময়, সোজাসুজি চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলে, দাঁতে নখ কাটে না, আঙ্গুল জড়ায় না; একই সঙ্গে অমায়িক ও গম্ভীর। ‘প্রায় দুই বছর আমাদের কোর্টশিপ চলেছিল! কিন্তু ভালো একটা চাকরি পাওয়ার আগে তো বিয়ের প্রশ্ন ওঠে না। মোটা বেতনের একটা চাকরিতে ঢুকলাম ১৯৪৫-এর জুন মাসের গোড়ার দিকে। আর আমাদের বিয়ে হলো ১৯৪৫ সালের ২৯ জুন। আষাঢ়স্য পঞ্চদশ দিবসে।
১৯৪৪ এ-ই তার হল জীবনের সমাপ্তি ঘটে। সেই শ্যামল রং রমণী অধ্যাপক মেহের কবীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন, রোকেয়া হলের প্রভোস্ট ছিলেন। তিনি এবং জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী উভয়েই প্রয়াত।
ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে, নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়