৯৯৯-এ কলে ৮ কেজি গাঁজা উদ্ধার

আগের সংবাদ

রবীন্দ্রনাথ ও বাঁশির চিত্রকল্প

পরের সংবাদ

সততায় অনন্য শেখ কামাল

প্রকাশিত: আগস্ট ৫, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ৫, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সৎ, নির্ভীক এবং তারুণ্যদীপ্ত মুক্তিযোদ্ধা শহীদ শেখ কামালের আজ ৫ আগস্ট জন্মদিন। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় সন্তান শেখ কামাল ১৯৪৯ সালে গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই বড় ছেলে জীবদ্দশায় এক পরিকল্পিত ও নির্মম ষড়যন্ত্রের শিকার হন। ’৭৫ পরবর্তী ক্ষমতা হরণকারী মোশতাক গং বিচিত্র চরিত্রে তাকে চিত্রিত করার চেষ্টা করে। বিভ্রান্তি ছড়িয়ে তার ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত করতে সাময়িকভাবে সক্ষম হলেও তারা সফল হয়নি ইতিহাসের শেষ বিচারে। এই একবিংশ শতাব্দীতে করোনা সংকটের মধ্যেও শেখ কামাল এখনো স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। শেখ কামালের বিচরণ ছিল প্রধানত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। তার হেঁটে চলা ছিল আবাহনীর মাঠে। তিনি ছিলেন আনন্দের প্রতীক। খেলাধুলার সঙ্গে যে শিশুরা আজ সম্পৃক্ত এবং যারা আবাহনীর মাঠে দৌড়ে বেড়ায় তাদের সজীবতায় মিশে আছে তার নাম। যে সবুজ চত্বরে তিনি হেঁটেছেন খোলা পায়ে সেই ঘাসের আদর মেখে এখনকার প্রজন্ম এগিয়ে চলেছে। তিনি তো সেই প্রাণের প্রতীক, যার নিজ কণ্ঠের গান ঘুরেফিরে আসে স্মৃতিকাতর বন্ধুজনের কানে। বাতাসে ভাসে তার বঙ্গবন্ধুর মতোই তেজোদীপ্ত আওয়াজ। বঙ্গবন্ধুর ২২-ঊর্ধ্ব ছেলে হয়েও তিনি মন্ত্রী-এমপি হননি। তিনি হয়েছিলেন মানুষের বন্ধু, মানবতার প্রতীক। সৎভাবে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করতে হয়েছে তাকে। প্রাণপ্রাচুর্যের কারণে তরুণদের সহজেই আকৃষ্ট করতে পারতেন তিনি। ‘স্পন্দন শিল্পীগোষ্ঠী’র তিনি ছিলেন প্রধান সংগঠক। যেখানে স্বাধীনতা-উত্তর তরুণ সমাজের সৃজনশীলতা হয়েছিল অবারিত। তার সহধর্মিণী ছিলেন সেই সময়ের প্রখ্যাত ক্রীড়াবিদ সুলতানা খুকু। ১৯৭৫ সালের ১৪ জুলাই শেখ কামাল ও সুলতানা খুকু বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন। বাঙালি সংস্কৃতির চেতনার বাতিঘর হিসেবে পরিচিত ‘ছায়ানটে’ শেখ কামাল সেতার বাজানো শিখতেন। এই গান, খেলাধুলা, অভিনয় আর আড্ডা যার প্রাণ সেই ব্যক্তিই আবার সভা-সমিতি করে মুজিবপন্থি ছাত্রলীগকে সঞ্জীবিত করেছিলেন।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে শেখ কামালের অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। ২৫ মার্চ মধ্যরাতেই তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ঢাকা ত্যাগ করেন। সেদিন রাতে বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করে নিয়ে যাওয়ার সময় ৩২ নম্বর রোডের বাড়ি তছনছ করা হয়, তখন ঢাকা জ্বলছে পাকিস্তানিদের নারকীয় তাণ্ডবে। আতঙ্ক শিহরিত এক মুহূর্তে তিনি বেড়িয়ে পড়েন অজানার উদ্দেশ্যে। তারপর ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি মুহম্মদ আতাউল গনি ওসমানীর এডিসি হন। যুদ্ধে সরাসরি লড়াইয়ের জন্য উদগ্রীব ছিলেন শেখ কামাল, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সন্তান হওয়ায় সেই সুযোগ তাকে দেয়া হয়নি। কিন্তু তার মনোজগতে তখন অনেক আলোড়ন। তিনি জানেন না পিতার পরিণতি, তিনি সংবাদ পাচ্ছেন কিন্তু মা-ভাই-বোনদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত; কখনো কখনো একাকী ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন নিঃসঙ্গ এক যোদ্ধা।
উল্লেখ্য, শেখ কামাল ছিলেন উদ্দীপ্ত যৌবনের দূত ও পরোপকারী ব্যক্তিত্বের পুরোধা। ৩০ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই তিনি এদেশের মানুষের কাছে আদর্শের মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। যারা তার সান্নিধ্যে এসেছেন তারা অনুভব করেছেন তার স্নিগ্ধ ও হাস্যোজ্জ্বল মমত্ববোধ। খেলার মাঠ থেকে নাটকের মঞ্চ, সংগীত জগৎ আর সভা-সমাবেশে তিনি আলোড়ন তুলেছিলেন। তরুণদের মধ্যে নতুন প্রতিভা দেখলে কাছে টেনে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পরিচয় করিয়ে দিতেন। অন্যদের ভালো কাজে উৎসাহ দেয়া তার অন্যতম ও স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য ছিল। জাতির পিতার সন্তান হয়েও তিনি সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করতেন, একই শার্ট বারবার পরতেন, বিলাস-ব্যসন পরিত্যাগ করে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নাটক ও গান নিয়ে মেতে থাকতেন। এ রকম একজন দিলখোলা, প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা মানুষকে নিয়ে অপপ্রচার করা হয়েছিল বিস্তর, যা আজ ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়েছে। আমরা সবাই জানি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়, দীর্ঘ ২১ বছর বঙ্গবন্ধু পরিবারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে মোশতাক ও জিয়া গং নিজেদের গুণকীর্তন করেছিল; লেলিয়ে দিয়েছিল দালালদের। চেষ্টা করেছিল বঙ্গবন্ধুকে কলঙ্কিত করার। কিন্তু জনগণ সে মিথ্যাচার মেনে নিতে পারেনি। রাষ্ট্রীয় প্রচার-প্রসারের বিরুদ্ধে জনগণই ঘরে ঘরে বঙ্গবন্ধু পরিবারের স্মৃতিকে সংরক্ষণ করে রেখেছিল। এ কারণে স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরও বঙ্গবন্ধু পরিবার আজ অনেক শক্তিশালী, অনেক গৌরবের আসনে আসীন। ’৭৫ পরবর্তী রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা কাজে দেয়নি জনগণের ইতিবাচক চেতনার জাগরণের কারণে। মোশতাক গং আজ ঘৃণার প্রতীক, ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলে থাকা বিশ্বাসঘাতক। শেখ কামালকে নিয়ে যে মিথ্যাচারের স্তূপ জড়ো করা হয়েছিল তা ছিল বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিপ্রেক্ষিত রচনা। বঙ্গবন্ধু পরিবার সম্পর্কে ব্যক্তিগত পর্যায়ে সৃষ্টি করা হয়েছিল গাল-গল্প। সে সময় অপপ্রচার জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে লক্ষণীয় হয়ে উঠেছিল। সেদিন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে খুন করে যারা লাভবান হয়েছিলেন, ক্ষমতায় গেছেন, তাদের আচরণ ছিল বিদ্বেষমূলক। তাদের কারণেই বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পরপরই পাকিস্তান, সৌদি আরব ও চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু যে আদর্শ লালন করে দেশ জাতিকে এগিয়ে নিয়েছিলেন তার গতিপথ রুদ্ধ করে দেয়া হলো ১৯৭৫-এর হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে। ১৯৭৪ সালের খাদ্যাভাব কিংবা বাকশাল নিয়ে যেমন অপপ্রচার করা হয়েছিল তেমনি শেখ কামালের ব্যক্তি চরিত্রে কালিমালিপ্ত করেছিল ষড়যন্ত্রকারীরা। আসলে তারা যখন বঙ্গবন্ধুকে কোনো মতে, কোনো কিছুতে টলাতে পারেনি ঠিক তখন শেখ কামালকে নিয়ে অপপ্রচারে মেতে ওঠে।
অপপ্রচারগুলো সেদিন কতটা মিথ্যা ছিল তা আমরা জেনেছি ’৭৫-পরবর্তী ইতিবাচক ইতিহাস চর্চার ধারায়। বঙ্গবন্ধুর নিজ গৃহে কোনো স্বর্ণের স্তূপ পাওয়া যায়নি। দেশ-বিদেশের কোনো ব্যাংকের হিসাব নম্বরে টাকা খুঁজে পায়নি কেউ। সেদিনের মিথ্যা প্রচারণা শেষাবধি টেকেনি। বিশিষ্টজনরা বলে থাকেন, শেখ কামালের অপকর্ম থাকলে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর আওয়ামী লীগের অসংখ্য নেতাকর্মীর নামে যেসব মামলা-মোকদ্দমা হয়েছিল, সেসব মোকদ্দমায় প্রাসঙ্গিকক্রমে তা আসতে পারত; তাও আসেনি। দেশের সামরিক-বেসামরিক গোয়েন্দা সংস্থা কিংবা ’৭৫-পরবর্তী শাসক মোশতাক-জিয়া-এরশাদ কিংবা বিচারপতি সায়েম- কেউই কোনো নথিতে শেখ কামালের বিরুদ্ধে প্রচারিত অভিযোগগুলোর অস্তিত্ব খুঁজে পাননি। দেশের একজন মানুষকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি তার মৃত্যুর পর বলেছেন, শেখ কামালের ব্যক্তিগত কর্মে তিনি ও তার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার আগে এভাবেই শেখ কামালের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তৃত করা হয়েছিল। একজন মুক্তিযোদ্ধা ও তারুণ্যের প্রতীককে এভাবেই আমরা নিয়তির করাল গ্রাসে ধ্বংস হতে দেখেছি। এই আগস্টেই তার জন্ম আবার এ মাসেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তিনি নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করে শহীদ হন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকদের বুলেটের আঘাতে তিনি প্রথম শহীদ। তার জন্ম ও কর্মময় জীবন আমাদের কাছে অতুলনীয়, কারণ সততার কষ্টিপাথরে তিনি ছিলেন অনন্য।
ড. মিল্টন বিশ্বাস : অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়