ডিআরআরএ আয়োজিত ওয়েবিনার : প্রতিবন্ধী ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধা বাড়ানোর দাবি

আগের সংবাদ

মহামারিতেও আনন্দময় হোক ঈদ

পরের সংবাদ

শখের বাক্স

প্রকাশিত: জুলাই ১৯, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুলাই ১৯, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

একটি শখের বাক্স বানাতে ইচ্ছে করল। টাকা-পয়সা অধিক থাকলে মানুষের মনে অনেক শখের জন্ম নেয়। কোন শখ পূরণ করবে, কোনটা করবে না তা নিয়ে দ্বিধায় পড়তে হয়। হাজারো শখের মধ্য থেকে বাক্সের শখটা বেশ মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। মোকাদ্দেসুর রহমান তখনো ডক্টরেট ডিগ্রি উপাধি পাননি। তিনি তার ম্যানেজার বাহারউদ্দিন সাহেবকে ডেকে নিয়ে বিষয়টি জানালেন। বাহার সাহেব বললেন, এটা কোনো ব্যাপার নয় স্যার। ব্যাংক ব্যালেন্স মাশাল্লাহ ভালো আছে। শুধু সরকারের কাছ থেকে একটা পারমিশন নিতে হবে স্যার।
মোকাদ্দেসুর রহমান মুখটা কিঞ্চিত কুঞ্চিত করলেন। না বললেই নয়, এমন অনিচ্ছার ভঙ্গিতে বললেন, আমার টাকায় আমি বাক্স বানাব, তাতে আবার সরকার নাক গলাবে কেন?
: এটা স্যার রাষ্ট্রের নিয়ম।
: কিন্তু আমি তো ট্যাক্স-ভ্যাট সবই দিচ্ছি। কষ্টিপাথরে যাচাই করা খাঁটি সোনার মতো খাঁটি টাকা আমার।
: আপনার কথা একদম ঠিক স্যার। তবু যেহেতু সরকারের একটা নিয়ম আছে-। আপনি ভাববেন না স্যার- ওসব সরকার-ফরকার আমি ম্যানেজ করব। আপনি স্যার বাক্স চেয়েছেন, মনে করেন বাক্স বানান শুরু হয়ে গেছে।
বাহার সাহেবের কথা শুনে হা করে থাকেন মোকাদ্দেসুর রহমান। চোখের সামনে দেখতে পেলেন নিজের একটি বাক্স। অর্থাৎ টিভি চ্যানেল। যেন কতদিনের স্বপ্ন বলামাত্রই পূরণ হয়ে গেল। মনে মনে ভাবলেন, বাহারউদ্দিন ঠিকই পারবেন। এমন একজন ম্যানেজার থাকলে মন্ত্রী-টন্ত্রী ম্যানেজ করা কোনো ব্যাপার না। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন লাগলে, সেটাও সম্ভব। সুতরাং তিনি বাহারউদ্দিনের কথায় ধরে নিলেন তার চ্যানেল হয়ে গেছে।
আকিজ গ্রুপের মতো অত বড় কোম্পানি না হলেও মোকাদ্দেসের কোম্পানি একেবারে খেলনা নয়। তিনি জানেন আকিজ বিড়ি দিয়ে ব্যবসা শুরু হয়েছিল। এখন সিমেন্ট, টাইলস কত কী! মোকাদ্দেসের ব্যবসাও শুরু হয়েছিল মুদি দোকান দিয়ে। এর আগে অবশ্য, গ্রামে থাকতে, হাটবাজারে চটের ওপর পলিথিন বিছিয়ে বিড়ি, সিগারেট, ম্যাচ, বিস্কুট, চানাচুর ইত্যাদি বিক্রি করতেন। সেটাও এক প্রকার মুদি দোকান। তিনি তখন মাত্র ১৬ বছরের কিশোর। এরপর ঢাকায় এসে দিলেন ছোট্ট একটা মুদি দোকান। আস্তে আস্তে দোকান বড় হলো। সাথে যোগ হলো ভাতের হোটেল। আবার যোগ হলো ফাস্ট ফুডের দোকান। এরপর দিলেন মেগাশপ। তিন-চারটি দোকান চালাতে তিনি তখন হিমশিম খাচ্ছেন। সে-সময় বিয়ে হয়ে গেল এক ব্যবসায়ীর কন্যা ফারিয়া চৌধুরীর সাথে। একমাত্র কন্যা হওয়ার কারণে পিতার সকল সম্পত্তি পেয়ে গেলেন। কপাল আর কাকে বলে? এখন তিনি আকিজ গ্রুপের সাথে মনে মনে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করেন।
যখন এই মোকাদ্দেসুর রহমান গ্রামে ছিলেন, তখন তাকে সবাই ডাকত ‘মকু’ বলে। সেই মকু যখন ঢাকায় এসে মুদি দোকান দিলেন তখন তার নাম হয়ে গেল মোকাদ্দেস। বিয়ের সময় থেকে নাম হলো মোকাদ্দেসুর রহমান। এখন তিনি ড. মোকাদ্দেসুর রহমান। এই ডিগ্রি পাওয়ারও একটা ইতিহাস আছে। সত্যি বলতে কি, টিভি চ্যানেলটাই মোকাদ্দেস সাহেবের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। মুদি দোকানের মালামাল বেচতে একটু ভেজালের কারবার করলেও এখন তিনি খাঁটি মাল চান।
টিভি চ্যানেলের অনুমোদন পাওয়ার সাথে সাথে তার অফিসে ভিড় জমাতে শুরু করলেন দেশের বিশিষ্টজন। সাংবাদিক, কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, নির্মাতা থেকে শুরু করে বিজ্ঞাপনদাতাদের প্রতিনিধি পর্যন্ত। চ্যানেলের নাম এমআরটিভি। যদি ডিগ্রিটা কিছুকাল আগে পাওয়া যেত, হয়তো চ্যানেলটির নাম হতো ডিএমআরটিভি। এমআর-ডিএমআর বিষয় নয়, বিষয় হলো একটি চ্যানেলের গুরুত্ব। একটি চ্যানেল রাতারাতি কারো জীবনধারাকে পাল্টে দিতে পারে। কাউকে অনেক জনপ্রিয় করে তুলতে পারে।
এমআরটিভির অফিস খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। প্রথমেই নিয়োগ দিতে হবে একজন পিএস। ফাইল সংরক্ষণের ব্যাপার আছে, এমডি সাহেব অর্থাৎ মোকাদ্দেসুর রহমানকে সহযোগিতা করার ব্যাপার আছে। যদিও চেয়ারম্যান হয়েছেন স্ত্রী ফারিয়া চৌধরী, কিন্তু এখানে তিনি অতটা সময় দিতে পারবেন না। তাকে সংসার দেখতে হয়, অন্য প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর ডিসিশন দিতে হয়। বাহার সাহেব বলেছেন পিএস হিসাবে মহিলা হলেই ভালো হয়। সেই মোতাবেক ইন্টারভিউ নেয়া হচ্ছে আজ।
এক এক করে তিনটি মেয়ে ইন্টারভিউ দিয়ে গেল। দ্বিতীয়জনকে একটু একটু পছন্দ হয়েছে মোকাদ্দেস সাহেবের। আরো বেশ কিছু ক্যান্ডিডেট আছে। পরে যে মেয়েটি এল দেখতে খুবই সুন্দর। অনেকখানি লম্বা। অনেক স্মার্ট মনে হলো। বসতে বললে, বসার স্টাইলটাই অবাক করে দেবার মতো। তার নাম তাহেরা তাবাসসুম মুনিরা। কিছু কথা জিজ্ঞাসাবাদের পর সে বলল, স্যার আমি আপনার সাথে একটু একান্তে কথা বলতে চাই।
বাহার সাহেব গলা খাকারি দিয়ে বললেন, ঠিক আছে স্যার, আমি আমার রুমে যাচ্ছি। প্রয়োজন হলে ইন্টারকমে কল করবেন।
বাহার সাহেব চলে যাবার পর উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকলেন মোকাদ্দেসুর রহমান। মুনিরা মিষ্টি করে হাসল। ওড়না ঠিক করতে গিয়ে আরেকটু ফাঁক করে ফেলল বুকের অংশ। ঠোঁটের কোণায় হাসি রেখে বলল, স্যার আমি আপনার সম্পর্কে সব না জানলেও কিছু কিছু জানি। আপনি আজ এতদূর উঠে এসেছেন শুধু পরিশ্রম দিয়ে। স্যার জীবনে শুধু অর্থবিত্তের পেছনে ছুটেছেন। হয়তো অর্থপ্রাপ্তির আনন্দ পেয়েছেন-।
মুখটা একটু মলিন করে বললেন মোকাদ্দেস সাহেব, আপনি কী বলতে চাচ্ছেন ঠিক বুঝতে পারছি না-।
: স্যার, আমি কি আপনার কাছে একটু আসতে পারি?
মোকাদ্দেস সাহেবের অনুমতির জন্য অপেক্ষা না করেই মুনিরা উঠে তার কাছে গেল। টেবিলের অপরদিক থেকে যেতে তার বেশ কিছুটা সময়ও লাগল। কিন্তু দম বন্ধ অবস্থা যেন মোকাদ্দেস সাহেবের। কোনো কথা বলতে পারছেন না। মুনিরা তার মুখের সাথে নিজের উন্নত বুক চেপে ধরে বলল, স্যার সুখ- স্যার আনন্দ-। এই আনন্দ আর সুখ যদি না থাকে স্যার, এত টাকা-পয়সা ধনদৌলত দিয়ে কী হবে?
মোকাদ্দেস সাহেব সত্যি সত্যিই কিছুটা সুখ অনুভব করছেন। কিন্তু কিছু বলতে পারছেন না। তার মতো একজন কদাকার মানুষের সাথে এত সুন্দরী একটি মেয়ের আদুরে স্পর্শ, তিনি ঝেড়ে ফেলতে পারছেন না। মুনিরা বলে যেতে লাগল, আমাকে নিয়োগ দিলে আমি আপনার জন্য সব ব্যবস্থা করব স্যার-।
: মানে?
: আমাকে আপনার পছন্দ না হলে দরকার নেই। ভেবে দেখুন স্যার- সংগীতশিল্পী, নাট্যশিল্পী, নিউজ প্রেজেন্টার-।
: তুমি সামনে গিয়ে বসো।
তুমি বলায় ভীষণ খুশি হলো মুনিরা। মোকাদ্দেস সাহেবের মুখে হালকা করে একটি চুম্বন দিয়ে সামনে গিয়ে বসল। মোকাদ্দেস হাঁ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকেন।
মুনিরা হয়ে গেল এমআরটিভির ডান হস্ত। আগে সে সালোয়ার-কামিজ পরত, এখন পরে উঁচু হিলের সাথে প্যান্ট আর পাতলা ফিনফিনে শার্ট। ভেতরের ব্রা স্পষ্ট দেখা যায়। অনুষ্ঠানের জন্য শিল্পী নির্বাচনেও তার ভূমিকা থাকে। এমনকি অনুষ্ঠান অধ্যক্ষও তার কাছে যেন জিম্মি। মুনিরার সাথে কথা বলে নিতে হয় অধ্যক্ষ মহোদয়কে। ভেতরে ভেতরে নানা গুঞ্জন। এই গুঞ্জন প্রথম দিকে মুনিরা আর মোকাদ্দেস সাহেবকে নিয়ে চলত। এখন গুঞ্জন বহুমাত্রিকতা পেয়েছে। ফলে বিষয়টা অত গুরুত্বের দাবিদার হতে পারে না। অনেক নিউজ প্রেজেন্টার, মহিলা কর্মকর্তা এখান থেকে চাকরি ছেড়ে অন্যত্র চলে গিয়েছেন। তাদের অনেকেই ভালো চাকরি ছেড়ে এসেছিলেন, স্যালারি হ্যান্ডসাম দেখে। চলে যাওয়ার পরও তারা বাইরে গিয়ে গোপন কথা প্রকাশ করেন না। কেননা যেসব সহকর্মীরা এখানে আছেন তাদের জন্য এটা লজ্জাস্কর বিষয় হবে। এটাই স্বাভাবিক। আবার জায়গা খালিও থাকছে না। কেউ কেউ সময়ের সাথে ও সম্পর্কের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে। কেউ কেউ পারে না। কে ভালো, কে মন্দ, সে বিশ্লেষণ পরের কথা।
প্রোগ্রাম অফিসার মাঝে মাঝে নির্মাতা বা শিল্পীকে মুনিরার কাছে পাঠিয়ে দেন, সরাসরি কথা বলতে। ওখান থেকে অ্যাপ্রæভাল নিতে হবে, তারপর প্রচার। ভালো একজন নাট্যনির্মাতা মাহমুদুল হক সুজন। ইতোমধ্যে তার নির্মিত বেশ কয়েকটি নাটক প্রশংসিত হয়েছে। সে এসে ধরল মুনিরাকে। বলল, আপনি একটু বললেই নাকি আমার নাটকটা প্রচার করা সম্ভব।
: কিন্তু জানেন তো সুজন ভাই, আমি ইচ্ছে করলেই পারি না। আমি বড়জোর স্যারকে বলতে পারি।
অনুমতি দেয়ার মালিক তিনি। আপনি চাইলে স্যারের সাথে দেখা করিয়ে দিতে পারি। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হবে বলে মনে হয় না। সব তো আল্টিমেটলি আমার হাত দিয়েই যায়।
: তাহলে একটু ব্যবস্থা করুন না মুনিরা আপু?
দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তির মতো অনুরোধ যেন, আমাকে একটু হাসপাতালে পৌঁছে দিন প্লিজ-। মুনিরা মুচকি হেসে বলল, আপনারা তো সবই জানেন। আমাদের স্যার কত বড় নির্লজ্জ। নাটকে কোন নায়িকা অভিনয় করেছে সেটা আগে। তার সাথে দেখা হওয়াটা জরুরি।
সুজন বলল, একবার বিজ্ঞাপনের জন্য নায়িকা জরুরি, একবার প্রচারের জন্য। আমরা কোথায় যাব বলুন-।
: তাহলে বোঝেন ঠেলা।
মুনিরা হাসতে থাকে। সুজন টাকা লগ্নি করে বিপদে আছে। তার বিপদটা নায়িকার চেয়েও কঠিন। কেননা ইতোমধ্যে অনেক ভালো ভালো অভিনেত্রী ঝরে পড়েছে। এ ধরনের প্রস্তাব পেলে তারা আর অভিনয় করতে রাজি হয় না। যারা অভিনয়ের ‘অ’ জানে না, ভাষাটা পর্যন্ত শুদ্ধ করে বলতে পারে না, যাদের মধ্যে রূপ ছাড়া কোনো গুণাগুণ নেই, তারাও এখন দাপটের সাথে কাজ করে যাচ্ছে। সুজন মুখে হাত দিয়ে বসে থাকে মুনিরার সামনে।
এমআরটিভির প্রচার শুরুর আগেই বাহারউদ্দিন সাহেবের প্রমোশন হয়েছে। ম্যানেজার থেকে তিনি এখন জেনারেল ম্যানেজার, অর্থাৎ জিএম। বলতে গেলে অফিসটা তিনিই চালান। তারপরও মুনিরার গুরুত্ব অনেক। তার কথা কেউ ফেলতে পারে না। অনেকে বলাবলি করে, মুনিরা হলো স্যারের সেকেন্ড ওয়াইফ। আরো একটা কথা কেউ কেউ বলে। সেটা বাংলায় বললে খারাপ শোনা যায়। এসব নিয়ে মুনিরার মাথাব্যথা নেই। তবে সে কিছুটা হিংসে করে এপিএস অদিতিকে। অদিতি মণ্ডল আসার পর থেকেই স্যারের সাথে সম্পর্ক গড়ে নিয়েছে। এটাও এক ধরনের প্রতিযোগিতা। অদিতি মণ্ডল নিশ্চয়ই চাইবে এপিএস থেকে পিএস পদটা পেতে। মুনিরার চেয়ারটা দখল করা মানেই স্বর্গ লাভ করা। অফিসে আসা-যাওয়ার জন্য তাকে স্পেশাল গাড়ি দেয়া হয়েছে। একটি মাইক্রোতে যেখানে ৮/৯ জন অফিসার লেভেলের লোককে আনা-নেয়া করা হয়, সেখানে একজনের জন্য একটা গাড়ি। ভাবা যায়? অদিতির লোভ থাকলেও, সেই যোগ্যতা নেই। এটা মুনিরা ভালো করেই জানে। তবু মনের মধ্যে সংশয় দানা বাঁধে। এইতো, সেদিনো একটি কাণ্ড করেছে অদিতি। মোকাদ্দেস সাহেবের কাছে গিয়ে কপাল খুঁটতে খুঁটতে বলল, স্যার একটা কথা বলব, কিছু মনে করবেন না।
: তোমার কথায় আমি কি কখনো কিছু মনে করি?
: স্যার, মুনিরাকে আপনি যতই ভালোবাসেন না কেন, ও কিন্তু আপনার সম্পর্কে ক্লাইন্টদের কাছে আজেবাজে কথা বলে-।
চট করে নিজের কপাল সরিয়ে অদিতির দিকে তাকান মোকাদ্দেস সাহেব। প্রশ্ন করেন, যেমন?
: যেমন স্যার- ও বলে, আপনি নাকি লুচ্চা, নির্লজ্জ, আস্ত একটা শয়তান- এইসব বলে আর কি-।
: কোন সেন্সে বলে, এটা বোঝার সেন্স তোমার নেই। ক্লাইন্টকে ম্যানেজ করতে এসব ওকে বলতে হয়। তুমি এখন যাও।
অদিতি একটা শক্ত রিপোর্ট করেও জুত করতে পারে না। মনমরা হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। তখনই একটি সুন্দরী মেয়েকে নিয়ে ঢোকে মুনিরা। বলে, স্যার, আপনার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে আনলাম।
: দাঁড়িয়ে কেন? বসো, বসো-।
খুব আগ্রহ নিয়ে বসতে বললেন মোকাদ্দেসুর রহমান। তারা দুজন দুটি চেয়ারে বসল। মুনিরা বলল, ওর নাম কানিজ করিম। গান করে। কিন্তু অডিশনে টিকতে পারেনি। আমার কাছে এসেছিল। বলল, ও বড় শিল্পী হতে চায়। এম্বিশন আছে স্যার, আমার মনে হয় পারবে। আমি ওকে আপনার কথা বলেছি।
: ঠিক আছে, আমি তার গান শুনব। যদি ভালো লাগে, তবে সুযোগ দেব। ঠিক আছে? তুমি এখন যাও মুনিরা। আমি কানিজের সাথে কথা বলে দেখি।
এরপর মাত্র কয়েকদিন কানিজ করিমকে ঘুরতে দেখা গেল এমডি সাহেবের কাছে। মেয়েটি ভালোই তো রবীন্দ্রসংগীত গায়। জিএম সাহেবকে ডেকে পাঠালেন এমডি সাহেব। বললেন, আপনি সংগীত বিভাগের নেওয়াজ সাহেবকে বলবেন এই মেয়েটির একটি একক সংগীতানুষ্ঠান করতে।
জিএম সাহেব হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লেন। কিন্তু হঠাৎ আবার কী যেন ভেবে বললেন, মনে হচ্ছে উনি তো নতুন শিল্পী-। আগে দু-একটা গান করুক স্যার।
: নতুনদের আমরা যদি ভালো সুযোগ না দেই, কারা দেবে বলুন? আপনি নেওয়াজ সাহেবকে বলুন।
নেওয়াজ সাহেব এসে বলল মুনিরাকে, দেখুন ম্যাডাম, আমি যা দেখলাম, কানিজকে দিয়ে রবীন্দ্রসংগীত করানো ঠিক হবে না। সুর সবারই জানা। পরে চ্যানেলের বদনাম হবে। তাকে দিয়ে বরং নতুন কিছু আধুনিক গান করানো যায়-।
মুনিরা বলল, আপনার মাথা খারাপ হয়েছে, স্যারের নির্দেশ অমান্য? চলুন স্যারের কাছে যাই।
নেওয়াজ সাহেবকে একরকম হেঁচড়ে টেনে এমডি সাহেবের কাছে নিয়ে গেল মুনিরা। একজন বোদ্ধা লোক নেওয়াজ সাহেব। তার কথা শুনে এমডি সাহেব যেন আরো খুশি হলেন। শুরু হলো গীতিকার খোঁজার পালা। ভালো লিরিক লেখেন এমন একজন গীতিকবি সাহিদুন্নবী আলমাজী। শিল্পীর নাম শুনে তিনি সরাসরি নাকচ করে দিলেন, এমন শিল্পীর জন্য গান লিখবেন না। টাকার সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। লাখ টাকা দিলেও তিনি লিখবেন না। এমন কথার উত্তর অবশ্য মোকাদ্দেস সাহেব যথার্থই দিয়েছেন, না খেয়ে মরে এই গীতিকার, নাম নেই, দাম নেই-। তাদের আবার অহংকার কত? ভালো এমাউন্ট দেয়া হবে। অন্য গীতিকার দেখ।
কেউ না কেউ তো অবশ্যই রাজি হবে। গীতিকার পাওয়া গেল। একইভাবে সুরকার পাওয়া গেল। মিউজিশিয়ান ভাড়া করা ব্যাপারই নয়। রেকর্ড হয়ে গেল বেশ কিছু গান। এবার দৃশ্য ধারণের পালা। শিল্পী কানিজ করিমের সাথে একটি টিমকে যেতে হলো বিশ্বের কয়েকটি দেশে। এট্রাক্টিভ লোকেশনগুলোতে দৃশ্য ধারণ করা হলো। টিমের সঙ্গে স্বয়ং মালিক মোকাদ্দেসুর রহমান থাকায় সবাই অনেক সুবিধা ভোগ করলেন। বেশি সুবিধা পেলেন শিল্পী। শিল্পীর জন্য নতুন নতুন শাড়ি, নতুন নতুন গয়না। সোনা, হীরা- যেখানে যা পাওয়া যায়।
অনুষ্ঠান প্রচার হওয়ার আগেই অদিতি ঘটনা ফাঁস করে দিয়েছে এমডি সাহেবের স্ত্রী ফারিয়া চৌধুরীর কাছে। মোকাদ্দেস সাহেব বিদেশে অবস্থানকালে কানিজকে নিয়ে একই রুমে রাতযাপন করেছেন। ‘রাতযাপন’ অনেক মধুর হলেও এক্ষেত্রে খুব মর্মান্তিক একটি শব্দ। ফারিয়া রেগে গেলেন মোকাদ্দেস সাহেবের ওপর। জানতে চাইলেন ঘটনার সত্যতা। মোকাদ্দেস আমতা আমতা করে বললেন, যারা আমাদের সাথে ওখানে ছিল, প্রত্যেকের কাছে জিজ্ঞেস করো-।
: আমি কী জিজ্ঞেস করব? যা জানার জেনেছি। তুমি এত ছোটলোক, ইতর আমার জানা ছিল না। ঐ মেয়ের বাপের বয়সী তুমি। তোমার মুখের চেহারাও তো খেঁকশিয়ালের মুখের মতো। শুদ্ধ করে কথা বলাটাও শিখেছ আমার কাছে। কী করে পারলে তুমি? তোমারও তো দুটো ছেলেমেয়ে আছে। ওরাও বিয়ের উপযুক্ত হয়েছে-। আমি আর তোমার সাথে থাকতে পারছি না।
: কী করতে চাও তুমি?
: অবজারভেশনে রাখতে চাই। আমি আমার বাবার বাড়ি শুলশানে গিয়ে থাকব।
অনুষ্ঠান প্রচারের কয়েকদিন আগে থেকেই বিজ্ঞাপন প্রচার হতে থাকল। আসছে জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী কানিজ মোকাদ্দেসের একক সংগীতানুষ্ঠান। শিগগিরই দেখতে পাবেন এমআরটিভির পর্দায়।
দেশের মানুষ অবাক। এই শিল্পী জনপ্রিয় হলো কবে? আর নামই বা কানিজ মোকাদ্দেস হলো কীভাবে? ইতোমধ্যে কি মোকাদ্দেস সাহেব শাদিটাও সেরে ফেলেছেন? নাকি সব হাওয়াই মিঠাই গল্প?
চলতে থাকল একের পর এক কানিজ মোসাদ্দেকের একক সংগীতানুষ্ঠান। দর্শকরা গান মনোযোগ দিয়ে না শুনুক, অন্তত লোকেশনগুলো আর শিল্পীর শাড়ি-গয়না দেখার জন্য হলেও অনুষ্ঠান দেখতে বাধ্য। একটি শখের বাক্স থাকলে কী না করা যায়? মনের শখ মনে থাকে না, আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে যায়।
মোকাদ্দেস সাহেব বললেন, শুধু দেশে কেন, বিদেশেও এই চ্যানেলটির বাজার ধরতে হবে। সব দেশেই কিছু না কিছু বাঙালি আছে।
জিএম বাহারউদ্দিন শুধু বললেন, আপনি যেভাবে বলবেন স্যার।
এখন এমন অবস্থা হয়েছে মোকাদ্দেস সাহেবের একটুও অবসর নেই। কানিজকে নিয়ে বিভিন্ন দেশে যেতে হয় শুটিং করতে। আবার সভা সমিতিতেও প্রধান অতিথি হিসেবে ডাক পড়ে। এর মধ্যে কিছু শত্রæ আছে যারা প্রচার করে মোকাদ্দেসুর রহমান মূর্খ- লেখাপড়া জানে না। সুতরাং ক্লাস সেভেন দিয়ে এখন আর চলছে না। একটা ডিগ্রি নেয়া ভীষণ জরুরি। জিএম সাহেব বললেন, আপনি শুধু বলবেন স্যার।
এর কিছুদিন পরই দেখা গেল নিউইয়র্ক থেকে চিঠি এসে হাজির। এমআরটিভির নিউইয়র্ক দর্শক ফোরামের সভাপতি আহ্বান করেছেন- অসাধারণ সাফল্য আর কৃতিত্বের জন্য মোকাদ্দেসুর রহমানকে তারা ডক্টরেট সম্মানে ভূষিত করতে আগ্রহী। যাক, নামের আগে মোকাদ্দেস সাহেব ডক্টর কথাটা লিখতে পারছেন, এটা মনের প্রশান্তি।
কিন্তু চাওয়ার শেষ থাকে না। শখেরও শেষ থাকে না। তিনি এখন লেখক হতে চান। এটা তো আরো সহজ। জিএম সাহেব বললেন, আপনি শুধু বলবেন স্যার।
এমআরটিভিতে বিজ্ঞাপন প্রচার হতে থাকল, আমাদের এ সপ্তাহের নাটক ‘ফুলকন্যার বাসরঘর’। কাহিনী ড. মোকাদ্দেসুর রহমান, নাট্যরূপ দিয়েছেন ও পরিচালনা করেছেন আখম খলিলউল্লাহ গুঞ্জন। দেখবেন আগামী শুক্রবার রাত ৯টায়, শুধুমাত্র এমআরটিভিতে।
এরপর কয়েকটি কাহিনী লিখে ফেললেন তিনি। সেগুলোর নাট্যরূপ দেয়া হলো। এমআরটিভিতে প্রচার হলো। সেসব কাহিনী দিয়ে একজন প্রকাশক বইও প্রকাশ করে ফেললেন। জানা যায়, এই কাহিনীগুলো নাকি অদিতি মণ্ডলের লেখা। স্যারকে খুশি করতে সে গোপনে এগুলো লিখে দিয়েছে। তাছাড়া এত লেখার সময়ই বা কোথায় মোকাদ্দেস সাহেবের? তিনি এখন বাংলা একাডেমি পুরস্কার চান। এইবার জিএম সাহেব মাথা চুলকান। কারণ এটা তো বাক্সের প্রচার নয়। মাথা চুলকাতে চুলকাতেই জিএম সাহেব বললেন, আপনি শুধু বলবেন স্যার।
ইতোমধ্যে কানিজ মোকাদ্দেসের বেশ নামডাক হয়েছে শিল্পী হিসেবে। পত্রিকায় লেখালেখি তো শুরু থেকেই চলছে। এখন সংগীতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার নেয়ার সময় হয়েছে। সেজন্য এমআরটিভির প্রযোজনায় চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজ হাতে নেয়া হয়েছে। একজন স্বনামধন্য লেখকের কাহিনী নির্বাচন করা হয়েছে। একজন উঁচুমানের পরিচালকও নিয়োগ দেয়া হয়েছে। টাকা থাকলে সিনেমা তৈরি ব্যাপার না। পুরস্কারও ব্যাপার না। চলচ্চিত্রের কাজ এগিয়ে চলছে। তখন মোকাদ্দেস সাহেবের মাথায় এলো কানিজের সাথে দ্বৈত গানে পুরুষ কণ্ঠটি তিনি দিতে পারেন। ছোটবেলায় মাঠে বাঁশি বাজাতেন। নুহু কাকার কাছে পল্লীগীতিও শিখেছিলেন। ‘হলুদিয়া পাখি সোনারই বরণ, পাখিটি ছাড়িল কে’- গানটি গেয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে দ্বিতীয় হয়েছিলেন। সুতরাং ছোটবেলার সেই শখটা পূরণ করা যেতে পারে। জিএম সাহেব বললেন, আপনি শুধু বলবেন স্যার।
গান গাওয়ার কথাটি শুনে মুনিরা গিয়ে মোকাদ্দেস সাহেবকে জড়িয়ে ধরল। বলল, স্যার আপনার তুলনা হয় না। আপনি দেখতে একটু ইয়ে হলেও আপনার প্রতিভার প্রশংসা না করে পারি না।
: না, না। কী আর এমন প্রতিভা, তোমরা শুধু বাড়িয়ে বলো।
: না স্যার, মোটেই বাড়িয়ে বলছি না। সব কথা কি বাড়িয়ে বলা যায় স্যার। এই ধরুন কানিজ ভাবির বাচ্চা হবে। কিন্তু আপিন তো স্যার একবার বললেনও না। আমি তো আপনার কাছের বলেই মনে করি স্যার।
: তোমাকে মিথ্যে বলব না মুনিরা। ওর সাথে আমার গোপন চুক্তি একটা আছে। জানোই তো, তোমার ভাবি আর আমার সাথে থাকেন না। তিনি বলেছেন তাঁর বাবার অংশটা নিয়েই তিনি ফয়সালা করে ফেলতে চান।
: তা হলে তো স্যার এবার ডিক্লিয়ার দেয়াই যায়।
: ভাবতে হবে। কানিজের অবশ্য কোনোকিছুতেই অমত নেই। তাই তো বাচ্চাটা শখ করে নিল।
শখের বাক্সে সবই সম্ভব। ড. মোকাদ্দেসুর রহমানের গান এমআরটিভিতে প্রচারের সাথে সাথেই ভাইরাল হয়ে গেল। লক্ষ লক্ষ ভিউয়ার্স। মোকাদ্দেস সাহেব মিষ্টি করে বললেন, যারা বাজে কমেন্ট করেছে তারাই বাজে। নাহলে আমার গানের লক্ষ লক্ষ ভিউয়ার্স হলো কী করে?
এর মধ্যে ঢাকা ক্লাব, সোনারগাঁও হোটেল, ইন্টারকোনে কয়েকটি পার্টি দেয়া হয়ে গেছে, বিভিন্ন উপলক্ষে। সেসব পার্টিতে এলিট শ্রেণি ও বিশেষ লেখক শ্রেণিদের নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। তাদের বিশেষ পানীয় দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়েছে। বাংলা একাডেমি পুরস্কারের সম্ভাবনা নতুন সূর্যের মতো উঁকি দিচ্ছে।
এদিকে ভার্চুয়াল জগতে এখন একটি গান ভাইরাল হয়ে গেছে। ড. মোকাদ্দেসুর রহমান স্টেজে মাইক হাতে গাইছেন আর তার চারপাশে নৃত্য করছে অতীব সুন্দরী তরুণীগণ। গানটি হলো-
রঙ্গলীলা, রঙ্গলীলা-
সঙ্গ দিল সখী কতজন
রঙ্গে দোলে অঙ্গ, আমার
অঙ্গে নাচায় মন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়