শুভ জন্মদিন : প্রেমিক কবি ফারুক মাহমুদ

আগের সংবাদ

দক্ষিণাঞ্চলে পেয়ারা বাজার মন্দা

পরের সংবাদ

শিক্ষার বন্ধ্যত্বে অবিরাম অতিকথা

প্রকাশিত: জুলাই ১৭, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুলাই ১৭, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

গোঁয়ারতুমি না করলে যে কেউই মানতে বাধ্য হবেন করোনার এই পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা সম্ভব নয়। উচিত নয়। যারা বাস্তবতা না মেনে খোলার কথা বলছেন তাদের মধ্যেও দ্বিচারিতা বিদ্যমান। খুললে তারাও সন্তানদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠাবেন না। কেন এ সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হলো, এমন প্রশ্ন ছুড়ে নির্ঘাত সরকারের সমালোচনা করবেন।
এসব আলোচনা-সমালোচনা, কথামালা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার দাবিতে বিচ্ছিন্ন আন্দোলনের মধ্যেই সশরীরে পরীক্ষা নেয়া শুরু করেছিল কুমিল্লা ও ময়মনসিংহের ত্রিশালে কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। জগন্নাথেও পরীক্ষা শুরুর বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে পরে প্রত্যাহার করেছে। পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নোটিস বোর্ডে নানান কথা ঝুলতে শুরু করেছিল। পরে সব থমকে গেছে। এ রকম অবস্থায় বন্ধের ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সবার শেষে এবং খোলার ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সবার আগে ইউনিসেফ ও ইউনেস্কো ঘোষিত এই নীতির ভিত্তিতে অনতিবিলম্বে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সুনির্দিষ্ট তারিখের দাবিও আছে।
স্কুল বিক্রির বিজ্ঞাপন, শিক্ষাঙ্গনে কুরবানির গরু বেঁধে রাখা বা কয়েক রুম ভাড়া দেয়ার সচিত্র খবরও প্রকাশ পাচ্ছে। ঘটনাগুলো মর্মবেদনার সঙ্গে হাসাহাসির বিষয়বস্তুও হচ্ছে। কোনো জাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারক প্রজন্মের পিছিয়ে পড়ার এমন ছবির আড়ালে আরো অনেক কিছু লুকিয়ে থাকছে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অভিভাবকদের দুশ্চিন্তা, শিক্ষকদের দুর্গতি ও অস্তিত্বের সংকটটি ইতিহাসের অংশ হয়ে যাচ্ছে। নিষ্ঠুর বাস্তবতার তাড়ায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও অফিস-আদালত, গাড়ি-ঘোড়া, মার্কেট-শপিংমল থেকে শুরু করে সবই খুলেছে, আবার বন্ধ হয়েছে। লকের এই আপ-ডাউনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তালা ঝুলে আছে প্রায় ৫শ দিনের মতো। সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও সেগুলোর শিক্ষক-কর্মচারীরা ঘরে বসেই মাসে মাসে বেতন পেয়ে যাচ্ছেন। কারো কারো পদ-পদায়ন, পদোন্নতিও হচ্ছে। তাই তাদের মাথাব্যথা নেই বা খুব কম। কিন্তু বেসরকারিদের? অনেকের টিউশনিও নেই। সংকটাপন্ন অবস্থার কথা তারা মুখ খুলে বলতেও পারছেন না। পেটে ভাত না থাকলেও শিক্ষকের সম্মানটা ধরে রাখতে কারো কাছে হাতও পাততে পারছেন না। তবে কেউ কেউ পরিচয় গোপন রেখে টুকিটাকি ছোট কাজও করছেন। এসবের মাঝে যে অ্যালার্মিং সিম্পটম কিংবা ওয়ার্নিং রয়েছে তা ভাবলেও গা শিউরে ওঠে।
এরপরও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে কথা হচ্ছেই। হবেই। কিন্তু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে। স্বয়ং শিক্ষামন্ত্রীকেও এই তোড়ে মাঝেমধ্যেই বেশি কথা বলতে হচ্ছে। একেকদিন একেক কথা। কবে নাগাদ খুলবে, কবে নাগাদ পরীক্ষা হবে- এ বিষয়ক সম্ভাব্য ক্ষণও বলছেন তিনি। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার বলেছেন, মহামারি পরিস্থিতির উন্নতি হবে ধরে নিয়ে নভেম্বরে এসএসসি এবং ডিসেম্বরে এইচএসসি পরীক্ষা নেয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার। শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের উদ্বেগের মধ্যে ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এসে সরকারের এই পরিকল্পনার কথা জানান শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি। সঙ্গে বাড়তি আরো কিছু কথা যোগ করেছেন। জানিয়েছেন সীমিত পরিসরে সংক্ষিপ্ত সিলেবাস, সময় ও নম্বর দুটিই কমিয়ে গ্রুপভিত্তিক শুধু ৩টি নৈর্বাচনিক বিষয়ে পরীক্ষা নেয়ার প্রস্তুতির কথাও। আর অটোপাস না দেয়া, পরীক্ষা না হলে অ্যাসাইনমেন্ট মূল্যায়নের ওপর ভিত্তি করে সম্ভাব্য রেজাল্ট দেয়ার চিন্তাও যোগ করেছেন।
করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার ভয়ে ২০২০ সালের ১৬ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ওই সময় থেকে বন্ধ ক্লাস-পরীক্ষাও। এরই মাঝে এক শিক্ষাবর্ষের পরীক্ষার্থীদের অটোপাস দেয়া নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়। স্কুলে যেতে না পারায় শিশু-কিশোরদের যে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে, তা হয়তো কখনোই পুষিয়ে দেয়া যাবে না। শিক্ষাঙ্গনের তালা আর কখনো খুলবে না- এমন কোনো লাল সংকেত নেই। শিগগিরই খুলবে- তেমন বার্তাও নেই। কবে নাগাদ খুলবে এ জবাব ঘুরছে বেশকিছু যদি, তবে, কিন্তুতে। এ বিষয়ক আশ্বাস-ভরসাগুলো এরই মধ্যে অসার প্রমাণ হয়েছে। তবে এ নিয়ে শব্দবোমা চলছে অবিরাম। তাও অতিমাত্রায়।
কিছুদিন পর পর নানান তারিখ পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণার পাশাপাশি এসব শব্দবোমায় প্রতিক্রিয়াটা বেশি হয়েছে। অমুক তারিখের বা সপ্তাহের পর, রোজার পর, ঈদের পর খোলার কথামালায় বিভ্রান্তিটা বেড়েছে। মাসখানেক আগে শিক্ষামন্ত্রী সংবাদ সম্মেলন ডেকে জানিয়েছেন, ১৩ জুনের পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হবে। অল্প ক’দিনে সেটা থেকেও সরে গেছেন। বন্ধের ঘানি টেনে নিয়েছেন ৩০ জুন পর্যন্ত। সংক্রমণ ৫ শতাংশের নিচে নামলে খোলা হবে- এমন কথাও বলেছেন। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে বলেছেন, সব ছাত্র-শিক্ষককে ভ্যাকসিন দিয়েই তবে বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হবে।
কোনো কথাই শেষ কথা নয়। কথার পিঠেই আসছে আরেক কথা। সর্বশেষ চলতি বছরের এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষা নিয়েও অনিশ্চয়তা মধ্যেই ফেললেন। পড়াশোনার চেয়ে জীবনের বেশি দামের আবেগময় সত্যতা স্মরণ করিয়ে বলেছেন, এক বছর পরীক্ষা না দিলে তেমন ক্ষতি হবে না। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে অটোপাসের ইঙ্গিতও মিলেছে তার কথায়। বলেছেন, শিক্ষার্থীরা যাতে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। পরীক্ষা নেয়া সম্ভব না হলে কী পদ্ধতিতে তাদের পাস করানো হবে সেই প্রস্তুতিও নেয়া হচ্ছে। অভিজ্ঞতাদৃষ্টে বিকল্পের মানেটা অটোপাসই ভাবা হচ্ছে। দেশে গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা ভাইরাস শনাক্ত রোগী এবং ১৮ মার্চ প্রথম শনাক্ত রোগীর মৃত্যু হয়। গত বছরের মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত বন্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। করোনা পরিস্থিতির কারণে গত বছর এইচএসসি-সমমান পরীক্ষায় অটোপাস দেয়া হয়। জেএসসি-জেডিসি ও এসএসসি-সমমান পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে এই ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে।
কারো কারো মতে, দেশজুড়ে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করার মতো পরিস্থিতি কখনোই তৈরি হয়নি। তা গত বছরের মার্চে যখন করোনা হানা দেয়ার তথ্য স্বীকার করা হয় তখনো নয়। এখন পর্যন্তও নয়। যুক্তি হিসেবে বলা হয়, করোনা আসার পর আমাদের সবচেয়ে খারাপ অবস্থার মতো এত ভালো অবস্থা ইতালিতে এখনো আসেনি। যুক্তরাজ্য-যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও তাই। ওইসব দেশে প্রতিদিন হাজার হাজার মৃত্যুর সময়ও দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়নি। প্রতিবেশী ভারতেও বন্ধ করা হয়েছে কেবল লকডাউন বা রেড জোন ঘোষিত এলাকায়।
ক’দিন আগে ইউনিসেফ ও ইউনেস্কো এক যৌথ বিবৃতিতে সব দেশের সরকার ও নীতিনির্ধারকদের আহ্বান জানিয়েছে যে পুরো একটি প্রজন্মকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে নিরাপদে স্কুল খুলে দিতে হবে। সবাইকে টিকা দেয়া পর্যন্ত অপেক্ষায় না থেকে স্কুল খুলে দিয়ে শ্রেণিকক্ষে ক্লাস শুরুর আহ্বান এসেছে জাতিসংঘের দুই সংস্থা ইউনিসেফ ও ইউনেস্কোর তরফ থেকে। সংগঠন দুটির যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে সংক্রমণ কবে শূন্যের কোঠায় নামবে, সেজন্য আর অপেক্ষায় থাকা যায় না। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলো সংক্রমণ ছড়াতে মুখ্য ভূমিকা রাখছে না- এমন দাবিও করা হয়েছে বিবৃতিটিতে। কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষে এই দাবি বা পরামর্শ মেনে নেয়ার অবস্থা নেই। এরও আগে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা বা বন্ধের একটি ম্যাপ প্রকাশ করেছে ইউনেস্কো। ম্যাপে দেখা যায়, বিশ্বে দেশজুড়ে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করেছে বাংলাদেশসহ ১৬টি দেশ। বাকি দেশগুলো হলো উত্তর কোরিয়া, মিয়ানমার, সৌদি আরব, মেক্সিকো, আজারবাইজান, তুরস্ক, ভেনিজুয়েলা, পেরু, উরুগুয়ে, সুরিনাম, মাদাগাস্কার, ইরাক, লাওস, কম্বোডিয়া ও ফিলিপাইন। এগুলোর কোনোটিরই করোনা পরিস্থিতি ভারত, ইতালি, যুক্তরাজ্য বা যুক্তরাষ্ট্রের পর্যায়ে নয়। বাংলাদেশ অন্য সব দেশের চেয়ে বিশেষভাবে আলাদা। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আবাসিক হলগুলোতে ছাত্রছাত্রীরা যেভাবে গাদাগাদিতে থাকে সেগুলো খোলা আসলেই ঝুঁকিপূর্ণ।

মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়