×

রাজনীতি

‘পরিকল্পিত সিলেটে’ প্রাধান্য

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ জুন ২০২৩, ০৮:১৬ এএম

‘পরিকল্পিত সিলেটে’ প্রাধান্য
নির্বাচন এলে প্রার্থীদের সামনে তাদের সমস্যা ও প্রত্যাশার কথা তুলে ধরেন সাধারণ মানুষ। ভোটারের মন ভোলাতে নানা প্রতিশ্রুতি দেন প্রার্থীরাও। সিলেট ও রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। বাস্তব-অবাস্তব প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি ছড়াচ্ছেন মেয়র প্রার্থীরা। কে কী করবেন, কীভাবে করবেন-তার বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরছেন নির্বাচনী ইশতেহারে, সভা-সমাবেশ ও গণমাধ্যমের কাছে। দুই সিটির মেয়র প্রার্থীর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি নিয়ে সিলেট ও রাজশাহী থেকে আমাদের পৃথক দুটি প্রতিবেদন- সকাল থেকেই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি পড়ছে ঝমঝম। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা বাড়ছিল পাল্লা দিয়ে। যেন বর্ষার তুমুল বরিষণে ভাসিয়ে নেবে সবকিছু। বর্ষার বৃষ্টি, সঙ্গে উজানি ঢল- সুরমার জলও বাড়ছে আগ্রাসী রূপে। তবে বর্ষা, বৃষ্টি, সুরমার পানি বেড়ে বন্যার পদধ্বনি- সব ছাপিয়ে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নগরী সিলেট এখন ভাসছে প্রতিশ্রুতির জোয়ারে। উন্নয়নের নানা চমক জাগানিয়া স্বপ্ন দেখিয়ে শাহজালালের পুণ্যভূমির সেবক হতে চাইছেন তারা। স্মার্ট বাংলাদেশের আদলে স্মার্ট সিলেটসহ গুচ্ছ গুচ্ছ পরিকল্পনা নিয়ে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছেন মেয়র প্রর্থীরা। অঙ্গীকার করছেন ২০ বছরের পুরনো জলাবদ্ধতা নিরসনের, ড্রেনেজ ব্যবস্থা আধুনিকায়নের, হকার পুনর্বাসনের, নারীবান্ধব ও সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রযুক্তিবান্ধব অত্যাধুনিক সিলেট নগরী উপহার দেয়ার। উন্নয়নের অঙ্গীকারে প্রাধান্য পাচ্ছে অপরিকল্পিত নগরায়ণের দুর্দশার অবসান ঘটিয়ে পরিকল্পিত সিলেট গড়ার বিষয়টি। তবে প্রতিশ্রুতি কি শুধুই ভোটারদের ভোলানোর জন্য, নাকি আক্ষরিক অর্থেই সিলেটবাসীর স্বপ্নের সিলেট রূপদান করা সম্ভব- এমন প্রশ্নও রয়েছে নগরীর অলিগলিতে। অবশ্য অবিশ্বাস্য গতিতে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সুযোগ্য নেতৃত্বে সিলেটও এগিয়ে যাবে- এই প্রত্যাশা সবার। এবারের সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক) নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৮ জন। তারা হলেন- আওয়ামী লীগ মনোনীত মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী (নৌকা), জাতীয় পার্টির নজরুল ইসলাম বাবুল (লাঙ্গল), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের হাফিজ মাওলানা মাহমুদুল হাসান (হাতপাখা) ও জাকের পার্টির মো. জহিরুল আলম (গোলাপ ফুল)। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে মোহাম্মদ আবদুল হানিফ কুটু (ঘোড়া), মো. ছালাহ উদ্দিন রিমন (ক্রিকেট ব্যাট), মো. শাহজাহান মিয়া (বাস গাড়ি) আব্দুর রউফ মোস্তফা মিয়া (হরিণ) প্রতীকে নির্বাচন করছেন। এরমধ্যে বরিশাল ও খুলনা সিটি নির্বাচনে নৌকার প্রতিদ্বন্দ্বা ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের হাতপাখা সিলেট ও রাজশাহী নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দিয়েছে। সিসিক নির্বাচনে হাতপাখার কোনো প্রচারণাও নেই। এছাড়া ক্রিকেট ব্যাট, হরিণ, গোলাপ ফুল প্রতীকেরও কোনো প্রচারণা চোখে পড়েনি। মাঠে লাঙ্গল ও ঘোড়া প্রতীকের প্রচারণা কিছুটা থাকলেও ভোটের মাঠে খুব একটা প্রভাব পড়বে না বলে মনে করছেন সিলেটের বিভিন্ন পর্যায়ের লোকজন। আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তিন মেয়াদের উন্নয়ন, নৌকার প্রার্থী বাছাই, আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর ব্যক্তিগত ইমেজ ভোটে নিয়ন্ত্রক হবে বলে মনে করছেন তারা। উন্নয়নের ফুলঝুরি : গতকাল শনিবার গ্রিন-ক্লিন-স্মার্ট সিলেটের স্বপ্নপূরণে ‘আমরার সিলেট’ শিরোনামে ২১ দফার ইশতেহার ঘোষণা করেছেন নৌকা মনোনীত মেয়র প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। তার ২১ দফা ঘোষণাজুড়েই রয়েছে স্মার্ট সিলেট বিনির্মাণের স্বপ্ন বাস্তবায়নের অঙ্গীকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত রূপকল্প-২০৪১ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তার ২১ দফা নির্বাচনী ইশতেহারে রয়েছে স্মার্ট নগরভবন; পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা ও জলাবদ্ধতা নিরসন; বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পরিচ্ছন্ন নগরী ও জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন; পরিকল্পিত গণপরিবহন ব্যবস্থা চালু ও যানজট নিরসন; সুরমার নাব্য বৃদ্ধি ও অকাল বন্যা রোধে পদক্ষেপ; বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা; বঙ্গবন্ধু উদ্যান নির্মাণ; ভালো মানের কর্মমুখী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান; পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও সবুজায়ন; নিরাপদ ও শান্তির নগরী হিসাবে গড়ে তোলা; দুর্যোগ মোকাবিলায় সচেতনতা সৃষ্টি, প্রস্তুতি ও তদারকি; বিকল্প বিদ্যুৎ ব্যবস্থার জন্য সোলার প্ল্যান্ট স্থাপন বা পৃথক বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট; নগরীতে একটা মিউজিয়াম স্থাপন; সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স নির্মাণ; দক্ষিণ সুরমা থেকে সুরমা নদীর তলদেশ দিয়ে টানেল নির্মাণ; রাজধানীমুখী দ্রুতগামী ট্রেন চালু করতে ভূমিকা রাখা; পর্যাপ্ত পাবলিক টয়লেট তৈরি; খেলার মাঠের ব্যবস্থা, উদ্যোক্তা ও ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি; নগরীর তারের জঞ্জাল পরিষ্কার ও প্রযুক্তির সিলেট বিনির্মাণ। আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী সিলেট নগরীর বাইরের বাসিন্দা- শুরুতে তার প্রতিপক্ষের এমন প্রচারণা থাকলেও ধীরে ধীরে তিনি মিশে গেছেন সিলেটের জনতার কাতারে। নির্বাচনী এলাকার প্রতিটি মানুষের কাছে পৌঁছেছেন। মন জয় করার চেষ্টা করছেন সিলেটবাসীর। এবার ভোটে বিজয়ের মাধ্যমে সিলেটবাসীর সেবা করার অধিকার চাইছেন। আনোয়ারুজ্জামান বলেন, আমি স্বপ্ন দেখি স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য। সরকারের কাছ থেকে দাবি আদায় করে নগরীর উন্নয়ন করা আমার প্রধান দায়িত্ব হবে। আমি নগরপিতা হতে আসিনি, জনগণের সেবক হতে এসেছি। আমার কোনো পিছুটান নেই। জনগণের সেবার ভার নিতে আমি প্রস্তুত। এদিকে ভোটের লড়াইয়ে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকলেও প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি ছড়াতে পিছিয়ে নেই লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাবুল। আজ নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করবেন তিনি। জানতে চাইলে জাতীয় পার্টির এই মেয়র পদপ্রার্থী ভোরের কাগজকে বলেন, আমাকে যদি নগরবাসী ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেন তাহলে আমি নগরভবন থেকে দুর্নীতির মূলোৎপাটন করতে উদ্যোগী ভূমিকা নেব। অতীতের মেয়রদের কার্যকলাপ সম্পর্কে নগরবাসী অবহিত রয়েছেন। তারা শুধু ফাঁকা বুলিতেই মশগুল ছিলেন। কাজের কাজ কিছুই হয়নি। একটু বৃষ্টি হলেই নগরবাসীকে পানিতে হাবুডুবু খেতে হয়। আমি নির্বাচিত হলে মাস্টার প্ল্যানের মাধ্যমে নগরীর উন্নয়ন করব। নগরবাসীর চাহিদা পূরণে সব শ্রেণির মানুষের কল্যাণ সাধনের লক্ষ্যে কাজ করে যাওয়ার অঙ্গীকার করেন নজরুল ইসলাম বাবুল। এছাড়া স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী আব্দুল হানিফ কুটুও ১৫ দফা নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছেন গতকাল। সিলেট নগরকে একটি স্মার্ট, জনবান্ধব, জলাবদ্ধতা ও দুর্নীতিমুক্ত নগর এবং সিটি করপোরেশন গঠনের লক্ষ্যে নির্বাচন করছেন বলে দাবি করেন তিনি। তার নির্বাচনী ইশতেহারে স্থান পাওয়া ১৫ দফা হলো- পয়ঃনিষ্কাশন ও সৌন্দর্যবর্ধন, জলাবদ্ধতা নিরসন ও মশকনিধন, বিশুদ্ধ পানীয়জল নিশ্চিতকরণ, স্বাস্থ্যসেবা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন, বাসস্থান, খেলাধুলা ও বিনোদন, ট্রাফিক ও যানজট নিরসন, পরিবেশ সংরক্ষণ ও সবুজ বনায়ন, সংস্কৃতি, কর্মসংস্থান, স্মার্ট নাগরিক সেবা নিশ্চিতকরণ, সংবাদকর্ম, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। অঙ্গীকারে পিছিয়ে নেই কাউন্সিলররাও : নির্বাচনী অঙ্গীকারে পিছিয়ে নেই কাউন্সিলররাও। ভোটারদের মন কাড়তে আকর্ষণীয় প্রতিশ্রুতিতে সাজাচ্ছেন নিজেদের নির্বাচনী ইশতেহার। ৫ নং সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে (১৩, ১৪, ১৫ নং ওয়ার্ড) নির্বাচনে প্রথমবারের মতো অংশ নিয়েছেন এডভোকেট জয়শ্রী দাশ জয়া। জানতে চাইলে জয়া ভোরের কাগজকে বলেন, নগরীর প্রধান বাণিজ্যিক এলাকা মহাজনপট্টি, কালীঘাট, লালদীঘি, কাজীরবাজার এ ওয়ার্ডে অবস্থিত। বর্ষাকাল ছাড়াও আকাশে মেঘ দেখলে এ এলাকার মানুষের বুক কেঁপে ওঠে। এই বুঝি জলাবদ্ধতা দেখা দেবে। বৃষ্টি হলেই বাসাবাড়ি, দোকানপাটে পানি ওঠে। নদীতে পানি বাড়লে পানিবন্দি হয়ে পড়ে এই এলাকার মানুষ। নির্বাচিত হলে নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে সঠিক পরিকল্পনা, শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণে ভূমিকা রাখাসহ সব মৌলিক নাগরিক সেবা নিশ্চিত করা, সবুজ পরিবেশবান্ধব ও সব বয়সি নারী-পুরুষের নিরাপদ যাতায়াত এবং সংস্কৃতকবান্ধব পরিবেশ তৈরিতে ভূমিকা রাখবেন বলে জানান তিনি। নগরীর ২২ নং ওয়ার্ডটি সিলেট সিটির অন্যতম অভিজাত আবাসিক এলাকা। এ ওয়ার্ডে আবারো প্রার্থী হয়েছেন বর্তমান কাউন্সিলর এডভোকেট সালেহ আহমেদ সেলিম। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে ভোটারের কাছে স্বচ্ছ থাকা প্রয়োজন। আবারো নির্বাচিত হলে আমি উপশহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে ড্রেনেজ ব্যবস্থার আধুনিকায়নে পদক্ষেপ নেব। স্মার্ট সিলেট নগরীর জন্য সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা এবং তরুণ প্রজন্মের জন্য বিদ্যমান খেলার মাঠ সংস্কারেরও উদ্যোগ নেবেন বলে জানান। বিশ্লেষকরা কী বলছেন : নির্বাচনী ইশতেহার ও রাজনীতির কথামালার ফুলঝুরির মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। প্রার্থীরা যে নির্বাচনী ইশতেহার দিচ্ছেন এর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জিং হবে বলে মনে করছেন তারা। জানতে চাইলে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. এস এম হাসান জাকিরুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, সিলেট নগরকে স্মার্ট নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে জলাবদ্ধতা নিরসনের বিষয়টি সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পাওয়া উচিত। কেননা সিলেট বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা, এখানে জনগণের বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হয় এই জলাবদ্ধতার কারণে। এদিকে নতুন করে বেশ কিছু এলাকা সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। প্রার্থীদের ইশতেহারে এসব এলাকা নিয়ে উন্নয়নমূলক বিশেষ বরাদ্দ ও পদক্ষেপের বিষয়গুলো আসা উচিত। কেননা নতুন অন্তর্ভুক্ত এলাকাগুলোতে হোল্ডিং নম্বর, রাস্তাঘাট, ড্রেনেজ ব্যবস্থাসহ অন্যান্য নাগরিক সুবিধা তেমন কিছুই নেই।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App