×

রাজনীতি

জলজট-যানজট হকারের দৌরাত্ম্য শ্রীভূমি সিলেটে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ জুন ২০২৩, ০৭:৫৩ এএম

জলজট-যানজট হকারের দৌরাত্ম্য শ্রীভূমি সিলেটে
দেশের ঐতিহ্যবাহী দুটি শহর রাজশাহী ও সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচন দোরগোড়ায়। দুই মহানগরীই এখন ভোটের প্রচারণায় সরগরম। স্বাভাবিকভাবেই এ সময়ে সামনে চলে এসেছে নাগরিক সেবা ও উন্নয়নের প্রশ্ন। বিগত দিনে কতটা উন্নয়ন হলো, কোন কোন সমস্যা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সমাধান করতে হবে, কী কী নাগরিক সেবা নিশ্চিত করতে হবে- এসব নিয়ে কথা বলেছেন স্থানীয় সাধারণ ভোটারসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। দুই সিটির উন্নয়ন ও নগরবাসীর প্রত্যাশা নিয়ে রাজশাহী ও সিলেট থেকে আমাদের পৃথক দুটি প্রতিবেদন। ঘড়ির কাঁটা তখন বেলা সাড়ে ১১টা ছুঁই ছুঁই। সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে মহানগরীর প্রবেশমুখে ৬ নম্বর ওয়ার্ডের খাসদবিরের ন্যাশনাল টি গার্ডেন এলাকা। ছোট্ট চায়ের টং ঘরের সামনে বেঞ্চে বসা জনপাঁচেক বর্ষীয়ান ব্যক্তি। তাদেরই একজন আশেক মিয়া বললেন, ‘দেওবা, বালা কইরা বেশি মিডা দিয়া মেয়র মার্কা চা দেও। ভুটের সময় বেশি মিডা না অইলে জমতো নয়!’ (ভালো করে বেশি চিনি দিয়ে এক কাপ চা দাও। ভোটের সময় বেশি মিষ্টি না হলে জমে না।) প্রবীণ আশেক মিয়ার প্রতি কথায় সবাই ‘হ্যা হ্যা’ করে উঠলেন। এভাবেই ছোট্ট চায়ের আড্ডা জমে উঠল রাজনৈতিক আড্ডায়। আড্ডায় শুধু ভোট কিংবা জনপ্রতিনিধি নির্বাচনই নয়; উঠে এলো ২০ বছরের পুরনো সিলেট মহানগরীর দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার চিত্র। ২০ বছরে টগবগে যুবকের দাপট নিয়ে দাবড়ে বেড়ানোর কথা ছিল, জয় করার কথা ছিল দিগ্বিদিগ; কিন্তু নগরীর বুকের ওপর জলজটের গভীর ক্ষত, যানজট, নিয়ন্ত্রণহীন হকারদের উৎপাতে শ্রীভূমি আজ বড়ই শ্রীহীন। দীর্ঘদিনের নাগরিক দাবি আর সরকারের প্রয়ে দেড় হাজার কোটি টাকার প্রকল্পও ফেরাতে পারেনি পুণ্যভূমির শ্রী। নতুন নগরপিতা আর তার সহযোদ্ধাদের কাছে জলজট-যানজট এবং হকারদের দৌরাত্ব্য থেকে মুক্তি চান নগরবাসী। কথার ফুলঝুরি নয়; তারা চান স্থায়ী সমাধান। সুন্দর, সাজানো গোছানো দুটি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ সিলেট- যে সিলেট নগরবাসীর সুস্থ আবাসনের ঠিকানা হবে। অন্যদিকে ভ্রমণপিপাসুদের জন্য দেশের অন্যতম পর্যটন নগরীতে পরিণত হবে। সিলেট শহরের পরিসর ধীরে ধীরে বাড়ছে। প্রথমে ওয়ার্ড ছিল ২৭টি। ১৫টি নতুন ওয়ার্ড যুক্ত করে এখন দাঁড়িয়েছে ৩৯টিতে। তবে বাড়েনি নাগরিক সুবিধা। শহরটি অপরিকল্পিতভাবে বেড়ে উঠছে বলে নগরবিশেষজ্ঞদের মত। এছাড়া যানজট, পানির সংকট, জলাবদ্ধতা, মশার উপদ্রবসহ নানা নাগরিক দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন নগরের বাসিন্দারা। স্থানীয়রা বলছেন, যানজটের সমস্যা ধীরে ধীরে বাড়ছে। বিভিন্ন এলাকায় সুপেয় পানির তীব্র সংকট আছে। দিনে-রাতে সমানতালে মশা কামড়ায়। অপ্রশস্ত রাস্তাঘাট, ফুটপাত বেদখল, অনেক বিপণিবিতানে পার্কিংয়ের ব্যবস্থা না থাকা, গণশৌচাগারের খুব অভাব আছে। নিয়ম না থাকলেও অনেক সময় দেখা যাচ্ছে- দিনের বেলা ট্রাক নগরের রাস্তা দিয়ে চলছে। এসব দূর করাসহ নগরের বিভিন্ন রাস্তা দখল করে তৈরি হওয়া অস্থায়ী সিএনজি ও মাইক্রোস্ট্যান্ড উচ্ছেদ করা প্রয়োজন। বেদখল হওয়া ফুটপাত থেকেও হকারদের সরাতে হবে। এছাড়া নগরে যেসব অবৈধ রিকশা ও যানবাহন চলাচল করছে, এসবও ঠেকাতে হবে। পাশাপাশি অপ্রশস্ত রাস্তাঘাটও প্রশস্ত করা উচিত বলে মনে করছেন তারা। জানতে চাইলে সিলেট চেম্বারের সভাপতি তাহমিন আহমদ ভোরের কাগজকে বলেন, নগরীর প্রধান সমস্যা ফুটপাত দখল ব্যবসা। এতে যানজটে নাকাল হতে হয় নগরবাসীকে। তিনি হকারদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে ফুটপাত দখলমুক্ত করার দাবি জানান। জলাবদ্ধতা সম্পর্কে তিনি বলেন, অপরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থার কারণে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। সিসিকের সুস্পষ্ট পরিকল্পনা না থাকায় সরকারি টাকায় অপচয় আর লুটপাট হয়েছে, কিন্তু জলাবদ্ধতার নিরসন হয়নি। স্থানীয়রা বলছেন, একসময় সিলেট শহর প্রচুর গাছপালাবেষ্টিত ছিল। পাহাড়-টিলায় ভরপুর ছিল। এসব কেটে কোনো ধরনের পরিকল্পনা ছাড়াই ইচ্ছেমতো বাসাবাড়ি তৈরি করা হচ্ছে। একটি সুউচ্চ ভবনঘেঁষে আরেকটি বহুতল ভবন তৈরি করা হচ্ছে। সেসব ভবনে যাওয়ার রাস্তাও একেবারেই সরু। সিটি করপোরেশন যদি কঠোরভাবে বিষয়টি দেখভাল করত, তবে অপরিকল্পিত নগরায়ণের সুযোগ খুব একটা ছিল না। স¤প্রতি নগরের আয়তন দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। বর্ধিত ওই এলাকায় যদি এখনই পরিকল্পনা মাফিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করা না হয় তবে একটা সময় বর্ধিত এলাকার অবস্থা হবে পুরনো নগরের এলাকার মতোই। গত দশ বছরে নগরের উন্নয়ন হয়েছে, তবে পরিকল্পিত উন্নয়ন হয়নি। মূল সমস্যার দিকে নজর দেয়া হয়নি। সিলেট নগরীর বর্ধিত ৩৪নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা ব্যাংকার আব্দুল মুমিত জানান, সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত হলেও তারা এখন পর্যন্ত সুপেয় পানিও জলের মতো জরুরি সেবা থেকে বঞ্চিত। নির্বাচনের পরপরই ড্রেনেজ ব্যবস্থার আধুনিকায়নসহ জরুরি সেবাসমূহ চালুর দাবি জানান তিনি। দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয়েও মিলেনি সুফল : ১৪ বছরে ১ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা খরচ করেও মিলেনি সুফল। বুধবার একরাতের বৃষ্টিতেই ভেসেছে সিলেট নগরী। শুধু সড়কে নয়, অনেকের ঘরেও প্রবেশ করেছে পানি। জানা যায়, ২০১৮ সালে নির্বাচনী ইশতেহারে জলাবদ্ধতা শতভাগ দূর করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বর্তমান মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। কিন্তু পাঁচ বছরেও ভোগান্তি না কমায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন নগরবাসী। জলাবদ্ধতা নিরসনে গত ১৪ বছরে প্রকল্প হয়েছে ৪টি। এর মধ্যে তিন প্রকল্পে সরকার বরাদ্দ দেয় ১১ কোটি টাকা। ২০০৯ সালে এই প্রকল্পের আওতায় নগরীর ছড়াগুলো উদ্ধার কার্যক্রম চালায় সিটি করপোরেশন। এরপর ২০১৩ সালে একই লক্ষ্যে নেয়া হয় ২০ কোটি টাকার আরেকটি প্রকল্প। এরপর ২০১৬ সালে নেয়া হয় ২৩৬ কোটি ৪০ লাখ টাকার প্রকল্প। এর মধ্যে এই ৩টি প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিসিকের নির্ধারিত একশন প্ল্যান না থাকায় প্রকল্পগুলো থেকে দৃশ্যমান অগ্রগতি চোখে পড়েনি। যার ফলে দুর্ভোগ আরো বেড়েছে, কমেনি মোটেও। সবশেষ ২০২০ সালের ডিসেম্বেরে জলাবদ্ধতা নিরসন, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ও অবকাঠামো নির্মাণের জন্য ১ হাজার ২২৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় সরকার। প্রশ্ন উঠেছে, গেল একযুগ ধরে এত প্রকল্প, এত বরাদ্দ স্বত্ত্বেও কী পেল নগরবাসী? তারা না জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পেয়েছে, না বন্যার গ্রাস থেকে মুক্তির সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছে। সব মিলিয়ে আসন্ন বর্ষার আগেই শঙ্কায় সিলেট নগরবাসী। এ ব্যাপারে লিডিং ইউনিভার্সিটির স্থাপত্য বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক স্থপতি রাজন দাস সিলেট মহানগরীর উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে বলেন, কোনো কাজেই পরিকল্পনা নেই। নগর কর্তৃপক্ষ তাদের ইচ্ছেমাফিক কাজ করছে। আগুপিছু না ভেবেই তারা উন্নয়ন কাজ করছে। যে কারণে সমস্যা সমাধানের চেয়ে আরো বাড়ছে। নগরবাসীকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। সিলেট প্রেস ক্লাবের সভাপতি ইকবাল সিদ্দিকী ভোরের কাগজকে বলেন, সিলেট নগরীর অন্যতম প্রধান সমস্যা জলাবদ্ধতা। অল্প বৃষ্টিতেই এই সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করে। এর কারণে ময়লা-অবর্জনার স্তূপ থেকে দুর্গন্ধ ছড়ায়। বাসা-বাড়ি ও রাস্তাঘাটে যত্রতত্র ভেসে উঠে আবর্জনার স্তূপ। সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজ করতে হবে বলে মনে করেন তিনি। নগরীর আরেকটি বড় সমস্যা যানজট নিয়ে সুজনের জেলা সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, সিলেট নগরীর সড়কে গাড়ির চাপ বেড়ে যাওয়া, উন্নয়নের জন্য রাস্তাঘাটের বিভিন্ন স্থানে খোঁড়াখুঁড়ি ও পাড়া-মহল্লার অপ্রশস্ত রাস্তা- সিলেটের যানজটের মূল কারণ। যানজটের জন্য সিলেটে বিআরটিএর ভূমিকা অনেকাংশে দায়ী বলেও মনে করেন তিনি। বিআরটিএর সমন্বয়হীনতার কারণে সিলেট নগরীতে রিকশার চেয়ে সিএনজি অটোরিকশা বেশি বলে জানান তিনি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App