×

রাজনীতি

ক্লিন সিটি খ্যাত রাজশাহীর মানুষ অনেক সেবা পান না

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ জুন ২০২৩, ০৭:৪৮ এএম

ক্লিন সিটি খ্যাত রাজশাহীর মানুষ অনেক সেবা পান না
দেশের ঐতিহ্যবাহী দুটি শহর রাজশাহী ও সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচন দোরগোড়ায়। দুই মহানগরীই এখন ভোটের প্রচারণায় সরগরম। স্বাভাবিকভাবেই এসময়ে সামনে চলে এসেছে নাগরিক সেবা ও উন্নয়নের প্রশ্ন। বিগত দিনে কতটা উন্নয়ন হলো, কোন কোন সমস্যা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সমাধান করতে হবে, কী কী নাগরিক সেবা নিশ্চিত করতে হবে- এসব নিয়ে কথা বলেছেন স্থানীয় সাধারণ ভোটারসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। দুই সিটির উন্নয়ন ও নগরবাসীর প্রত্যাশা নিয়ে রাজশাহী ও সিলেট থেকে আমাদের পৃথক দুটি প্রতিবেদন। ক্লিন সিটি ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য রাজশাহী শহরের সুনাম রয়েছে দেশজুড়ে। আন্তর্জাতিকভাবেও শহরটি প্রশংসা কুড়িয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হতে দেখা গেছে নগরীর বিভিন্ন সড়কের সুন্দর দৃশ্য। বর্তমানে এখানে চলমান রয়েছে বেশ কয়েকটি সৌন্দর্যবর্ধক প্রকল্পও। কিন্তু এসবের আড়ালে চাপা পড়ে গেছে নাগরিক সেবার মান। অল্প বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা, শব্দদূষণ, মশার উপদ্রব, সুপেয় পানির সংকট, যানজট, নগরীর অর্ধেক জনগোষ্ঠী গ্যাস সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকা, ভঙ্গুর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও নড়বড়ে চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে। সেইসঙ্গে কর্মসংস্থানের অভাবে বেকারত্ব বাড়তে থাকা, উন্নয়নের নামে দিন দিন সবুজায়ন কমতে থাকা, শিক্ষার ক্ষেত্রে ভর্তি জটিলতা, সংস্কৃতি চর্চার জায়গা না থাকা, খেলার মাঠ কমে যাওয়া, একের পর এক পুকুর ভরাট, হেরিটেজ স্থাপনা কমে যাওয়া, ফ্লাইওভারসহ অপ্রয়োজনীয় অপরিকল্পিত বিভিন্ন প্রকল্প, সিটি করপোরেশনের ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে গলাকাটা চিকিৎসাব্যবস্থা গড়ে ওঠা, পাবলিক টয়লেট সংকট, আশ্বাসের পরও শিল্পায়ন গড়ে না ওঠা- এসব নিয়েও দুঃশ্চিন্তা যাচ্ছে না নগরবাসীর। ফলে তাদের মুখ্য দাবি হয়ে উঠেছে, অপ্রয়োজনীয় অপরিকল্পিত প্রকল্প বাদ দিয়ে নাগরিক সেবা বাড়ানোর বিষয়টি। যদিও আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজশাহীতে যে উন্নয়ন ঘটেছে তা নজিরবিহীন বলছেন সব মহলের মানুষ। এই উন্নয়নকে জনবান্ধব করে নাগরিক সুবিধা বাড়ানোর দাবি জানিয়েছে তারা। সেইসঙ্গে শহরকে ৩টি উপশহরে ভাগ করে একটি মহাপরিকল্পনা করার কথা জানিয়েছেন কেউ কেউ। সুশীল সমাজের দাবি, সিটি করপোরেশন যদি উপশহর হিসেবে ভাগ করে একটি মাস্টার প্লান পাশ করে তাহলে সাধারণ জনগণই নিজের টাকা দিয়ে পরিকল্পিত নগরী গড়ে তুলবে। তবে, ওই নকশায় নির্দিষ্ট করে বলে দিতে হবে- কোথায় পুকুর থাকবে, কোথায় ভবন থাকবে, আর কোথায় খেলার মাঠ থাকবে। সরজমিন গতকাল শুক্রবার দেখা যায়, রাজশাহী নগরী ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় ঠাসা। এগুলো নিজের খেয়ালখুশি মতো চলাফেরা করায় নগরীর বিভিন্ন স্পটে সৃষ্টি হচ্ছে দীর্ঘ যানজট। প্রধান শহরজুড়ে সুপ্রশস্ত রাস্তা ও ফুটপাত গড়ে তোলা হয়েছে। সড়কগুলোতে শোভা পাচ্ছে নানা ধরনের ফ্লাড লাইট। যেগুলো নজর কাড়বে যে কারো। তবে, বেশির ভাগ ফুটপাতই দখলে চলে গেছে। প্রভাবশালী মহল সেগুলো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও চা দোকানিদের কাছে ভাড়া দিয়ে দিয়েছেন। বর্তমানে বৃষ্টি কম থাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি না হলেও, পরিকল্পিত সুয়ারেজ ব্যবস্থা না থাকায় হালকা বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় বলে জানিয়েছেন নগরবাসী। রাজশাহী শহরের সমস্যার বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক মলয় ভৌমিক ভোরের কাগজকে বলেন, রাজশাহীতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও প্রধান সমস্যা হচ্ছে নাগরিক সেবার মান কমে যাওয়া। সেইসঙ্গে রাজশাহীকে শিক্ষা নগরী বলা হলেও এখানকার মানুষের শিক্ষা-দীক্ষা ও রুচিশীলতার অভাব রয়েছে অনেক। ওয়ার্ড পর্যায়ে উন্নয়ন ঘাটতি রয়েছে। সাংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্র ও খেলার মাঠের অভাব আছে। রাজশাহীতে গ্যাস পাইপলাইনের সংযোগ দেয়া হলেও ৫০ শতাংশ মানুষ এই সুবিধার বাইরে রয়েছে। অর্থাৎ কেউ গ্যাসের সুবিধা পাচ্ছে, কেউ বঞ্চিত হচ্ছে। এসব বিষয়ে পরিকল্পিত উদ্যগ নেয়া যেতে পারে। রাজশাহী চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মাসুদুর রহমান রিংকু ভোরের কাগজকে বলেন, রাজশাহীর প্রধান সমস্যা এখানে শিল্পায়ন গড়ে ওঠেনি। শিল্পায়ন যে গড়ে উঠবে, সেজন্য অতিপ্রয়োজনীয় গ্যাসের সংযোগ দেয়া হচ্ছে না। তবে, সদিচ্ছা থাকলেই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী রাজশাহীতে কৃষিভিত্তিক ইকোনমিক জোন করা সম্ভব। আমের পাশাপাশি বর্তমানে এখানে প্রচুর পরিমাণে টমেটো, পেঁয়াজ, আলু, শাকসবজি উৎপাদন হচ্ছে। দুঃখের বিষয় আম রপ্তানির জন্য ল্যাব টেস্ট করাতে ঢাকা পাঠাতে হচ্ছে। অথচ রাজশাহীতে ল্যাব রয়েছে, কৃষি গবেষণা কেন্দ্র রয়েছে। চাইলে এখানেই সম্ভব। মোটকথা আমরা আর ঢাকাকেন্দ্রিক হয়ে থাকতে চাই না। নতুন মেয়র যিনি হবেন, এসব বিষয় দেখবেন বলে আশা করি। রাজশাহী প্রেস ক্লাবের আজীবন সদস্য আহমেদ শফিউদ্দিন ভোরের কাগজকে বলেন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও সেবার মানে পিছিয়ে পড়েছে রাজশাহী সিটি করপোরেশন। প্রধান সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম অপরিকল্পিত সুয়ারেজ ব্যবস্থা। হাজার হাজার বাসা-বাড়ির নোংরা পানি সরাসরি ড্রেনে জমা হচ্ছে। হালকা বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা হচ্ছে। ওই নোংরা পানি নানা রোগের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। পদ্মা নদীর পাড়কে ঘাসের গালিচা থেকে কনক্রিটে মুড়ে দেয়া হয়েছে। প্রশস্ত রাস্তার প্রশংসা করি; কিন্তু অপরিকল্পিত উন্নয়ন বেশি হচ্ছে বলে আমরা মনে করি। যদি শহরকে ৩টি উপশহরে ভাগ করে মাস্টার প্লান পাশ করা হয় তাহলে সাধারণ মানুষ ওই প্লান অনুযায়ী পরিকল্পিত শহর গড়ে তুলবে। অপরিকল্পিত উন্নয়নের উদাহরণ টানতে গিয়ে তিনি বলেন, শহরের পাশে ৮০০-৯০০ কোটি টাকা করে খরচ করে দুটি ফ্লাইওভার করা হয়েছে। যা তেমন কাজে আসছে না। শহরের ভেতরে আরো ৫টি করা হবে বলে শুনছি, যা অপ্রয়োজনীয় হবে। সদর হাসপাতালটিতে ২০০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি পড়ে থাকলেও চালু করা যাচ্ছে না। অথচ অনেকে সিটি করপোরেশনের ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে যত্রতত্র ক্লিনিক গড়ে তুলে সাধারণ মানুষের গলা কাটছে। সড়ক করা হচ্ছে, অথচ লেন আলাদা করে মার্কিং করা নেই, সড়ক ব্যবহারের চিহ্নসম্বলিত কোনো সাইনবোর্ড লাগানো হয়নি। মোটকথা ট্রাফিক সিস্টেম ভেঙে পড়েছে। উন্নয়ন প্রকল্পের পাথর ভাঙা, মাত্রাতিরিক্ত হর্ন বাজানোর কারণে শব্দদূষণ হচ্ছে। অপরিকল্পিতভাবে ভবন নির্মাণ হতে থাকায় সেগুলোর বালি রাস্তায় রাখা হচ্ছে, যা বাতাসে উড়ে বায়ুদূষণ করছে। আগে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় পশু জবাই হতো, এখন যে যেখানে পারে জবাই দিচ্ছে। ফলে পশুর রক্ত বাতাসে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। মশার উপদ্রবেও নগরবাসী অতিষ্ঠ। রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. জামাত খাঁন ভোরের কাগজকে বলেন, আয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মানুষ তার জীবিকা নির্বাহ করে। রাজশাহীতে শিক্ষাকে কেন্দ্র করে উপার্জন করা মানুষের সংখ্যা বেশি। যে আয় খুব বেশি নয়। এরপরও পানি ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। এটি না বাড়ালে ভালো হতো। পাশাপাশি যিনি আসন্ন নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হবেন তিনি যদি যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নে উদ্যোগ নেন- বিশেষ করে ট্রেনের লাইন ডাবল করা, বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক করা, পদ্মা নদী ড্রেজিং করে নৌ যোগাযোগ বাড়ানো তাহলে সবাই উপকৃত হবে। ওয়াসকরনী নামে একজন চা দোকানি ভোরের কাগজকে বলেন, ‘চাকরি বলতেই আমাদের মানুষজন ঢাকা দৌড় দেয়। রাজশাহীতে কর্মসংস্থানের সুযোগ কম। এটা যদি কেউ ঠিক করতে পারতো ভালো হইত। এছাড়া আমরা শহর নিয়ে আমরা গর্ব করি। এত সুন্দর শহর বাংলাদেশের কোথাও নাই।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন বলেছেন, ২০০৮ সালে বর্তমান নৌকার মেয়র প্রার্থী এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন- গার্মেন্টস শিল্প স্থাপন করে ৬০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান করবেন, কিন্তু তিনি সেই প্রতিশ্রুতি রাখেননি। যিনি মেয়র হবেন, এ ধরনের কর্মসংস্থান করলে সামগ্রিকভাবে রাজশাহীবাসীর উপকার হবে। সেইসঙ্গে জোর দিতে হবে সবুজায়নেও। শহরটিতে কিশোর গ্যাং কালচার ও মাদকের চালান বেড়েছে বলেও অভিযোগ করেন অনেকে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App