×

রাজনীতি

বৃহত্তর ঐক্যের প্রশ্নে বিএনপিতে ধোঁয়াশা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৯:১৩ এএম

বৃহত্তর ঐক্যের প্রশ্নে বিএনপিতে ধোঁয়াশা

ফাইল ছবি

একদফা দাবিতে বিএনপির বৃহত্তর জোট গঠনের আলোচনা চলছে বেশ জোর-শোরেই। তবে এই ঐক্যজোট আদৌ হবে কিনা তা নিয়ে সন্দিহান দলের অনেকেই। একদিকে বৃহত্তর জোট গঠনের স্বার্থে জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ নিয়ে বিএনপিতে এখন শ্যাম রাখি না কুল রাখি অবস্থা। অপরদিকে ঐক্যের প্ল্যাটর্ফমে বিএনপির মৌলিক অবস্থান কী হবে? জোটের প্রধান নেতা কে হবেন? এসব বিষয় শরিক দলের নেতাদের স্পষ্ট করতে পারছে না বিএনপি। দলটির নির্ভরযোগ্য নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এমন আভাস পাওয়া গেছে। নতুন ঐক্যজোটের ভাবনায় জামায়াত ‘বাধা’ হলেও; কৌশলে জামায়াতকে সঙ্গে রেখেই ঐক্যের পরিকল্পনা করেছিল বিএনপি। কিন্তু যেসব দলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে তাদের অধিকাংশই জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করার শর্তে ঐক্যের বিষয়ে রাজি। তাছাড়া ঐক্য হওয়ার পর রাজপথে কীভাবে আন্দোলন হবে, কারা নেতৃত্ব দেবেন, আন্দোলনের লক্ষ্য কী হবে, কোন পথে সাধারণ মানুষকে ঐক্যের আন্দোলনে যুক্ত করা যাবে- এসব বিষয়ে এখনো ভাবেননি ঐক্যের উদ্যোক্তারা। তবে বিএনপির নীতি নির্ধারকরা জানিয়েছেন, সবকিছু বিবেচনায় নিয়েই তারা বৃহত্তর ঐক্যের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, আমরা একটা বৃহত্তর প্ল্যাটফর্মে আন্দোলনে নামার টার্গেট নিয়ে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে চাই। সেখানে বাম-ডান, গণতান্ত্রিক, দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক সব দলকে একত্রিত করতে চাই। সেই লক্ষ্যে আমরা পরিকল্পনা মাফিক কাজ করছি। তিনি বলেন, আমরা তাড়াহুড়া করব না, সব দলের সঙ্গে আলাদা ফরমেটে কথা বলে ঐক্যের ফরমেট তৈরি করব। আশা করছি, ভালো কিছুই হবে। বিএনপির এক সিনিয়র নেতা জানান, ঐক্য গঠন প্রক্রিয়াটি একেবারেই গোপনীয়। তবুও কিছু বিষয়ে ধারণা দেয়া যায়। তিনি বলেন, বিএনপির পক্ষ থেকে অনানুষ্ঠানিকভাবে বাম ঘরানার যাদের সঙ্গে কথা হচ্ছে, তাদের মূল আপত্তির জায়গাটা জামায়াত। বিএনপির দীর্ঘদিনের জোটসঙ্গী জামায়াত থাকলে ঐক্য প্রক্রিয়ায় না হাঁটার ইঙ্গিত দিয়েছে তারা। তবে জোটে থাকলেও জামায়াতকে নিয়ে যাতে কোনো সমস্যা তৈরি না হয়, সে রকম পরিকল্পনা করছে বিএনপি। এদিকে জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার আলোচনা বিএনপিতে দীর্ঘদিনের। এ নিয়ে আড়ালে-আবডালে কথাও বলেছেন দলটির নেতারা। তবে বিএনপি ছাড়লে সরকার আবার জামায়াতকে টেনে নেয় কিনা- এই আতঙ্ক এখনো আছে। তাই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বেগ পেতে হচ্ছে বিএনপিকে। পাশাপাশি জোট ও ফ্রন্টের শরিকদের মধ্যে বহুদিন ধরে জিইয়ে থাকা দূরত্ব কীভাবে ঘোচাবে সেই সঠিক পথ খুঁজে পাওয়া না গেলে ঐক্যের পরিবর্তে সৃষ্টি করবে অনৈক্য। অন্যদিকে বর্তমানে বিএনপির নেতৃত্বে যে ২০ দল রয়েছে তাদের অধিকাংশই এখন জামায়াতে ইসলামীর নিয়ন্ত্রণে। ফলে জামায়াতকে বাদ দিতে গেলে আবার নতুন কোনো সমস্যা হবে কিনা তাও ভাবছে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব। যদিও এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে বৃহত্তর জোটের বিষয়ে ২০-দলের শরিকদের সঙ্গে আলোচনা হয়নি; তবে এই জোটের নেতাদের সঙ্গে দুই দফা চা চক্রে বসেছেন বিএনপির শীর্ষ নেতারা। শরিক দলের নেতারা আশা করছেন, তাদের পরামর্শ নিয়েই বিএনপি সামনের দিকে এগুবে। তাদের শঙ্কা, হঠাৎ করে কোনো সিদ্ধান্ত নিলে গত নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মতো হ-য-ব-র-ল পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। বিএনপির মৌলিক অবস্থান স্পষ্ট চান নেতারা : বিএনপিকে কেন্দ্রে রেখে ঐক্য গড়তে চাওয়া দলগুলোর নেতারা বিএনপির মৌলিক অবস্থান কী হবে- সে বিষয়েও স্পষ্ট ধারণা চান। এমনকি নির্বাচনের আগে আসন ভাগাভাগির ‘জাতীয় ঐক্যের’ ফরমেশনে দলগুলোর আর আগ্রহ নেই। তাদের চাওয়া ‘দাবি আদায়ের আন্দোলনে’ বিএনপির মৌলিক অবস্থান কী হবে, তা আগে পরিষ্কার হোক। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিএনপিকেই এ বিষয়টি স্পষ্ট করতে হবে। দলগুলোর নেতারা বলছেন, নির্বাচনকেন্দ্রিক দেনা-পাওনার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে রাষ্ট্র পরিচালনায় বিএনপির নতুনত্ব কী হবে। শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন, স্বাধীন প্রশাসন ও বিচার বিভাগ, স্বনির্ভর আমলাতন্ত্রসহ রাষ্ট্রের মৌলিক বিষয়গুলোতে সুস্পষ্টভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলে আগামী দিনে রাজপথের ঐক্য গড়ে উঠতে পারে। সেক্ষেত্রে জোটবদ্ধ বা যুগপৎ উভয় সম্ভাবনার দুয়ার খোলা থাকবে বলে জানান নেতারা। বিএনপির ‘আত্মপর্যালোচনা’ চায় দলগুলো : বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা জানান, বিএনপির সঙ্গে বর্তমানে জোটবদ্ধ ও অতীতে জোট ছেড়ে গেছে এমন দলগুলোও নতুন করে ‘সুষ্ঠু’ নির্বাচনের স্বার্থে ‘রাজনৈতিক সম্মিলন’ চাইছে। সেক্ষেত্রে দলীয়ভাবে বিএনপির নেতৃত্ব ও দলটির সুস্পষ্ট রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে ‘নিশ্চয়তা’ চাইছেন তারা। বিএনপির সঙ্গে জোটভুক্ত হতে আগ্রহী কয়েকজন নেতা বলেন, জোট সরকারের সময়ে সরকারের সমান্তরাল ‘হাওয়া ভবন সংস্কৃতি’ থেকে বিএনপিকে বেরোতে হবে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ঘিরে এখনো সেই কুশীলবরা সক্রিয় থাকায় আশঙ্কামুক্ত হতে পারছেন না তারা। নেতারা বলেন, বিএনপি লন্ডনের ‘জেন্টেলম্যান রিমোট কন্ট্রোলে’ পরিচালিত কিনা, সেই প্রশ্ন রয়েছে। তিনি দেশের গ্রাউন্ড রিয়েলিটি সম্পর্কে কতটা অবহিত, সেটাও বিবেচ্য। বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, সরকারের পদত্যাগ, ভোটের অধিকারসহ কিছু ইস্যুতে ন্যূনতম রাজনৈতিক ঐকমত্য বিরোধী দলগুলোতে আছে। এই ঐকমত্যকে কেন্দ্র করে সমন্বিতভাবে যুগপৎ ধারায় আন্দোলন শুরু করার প্রক্রিয়াটিও সবার উপলব্ধিতে রয়েছে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামো এবং সংবিধানের গণতান্ত্রিক সংস্কার। বিএনপির প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে তিনি বলেন, অতীতে যেসব গণবিরোধী কাজ হয়েছে, সে বিষয়ে আত্মপর্যালোচনা থাকা দরকার। বিশ্বাসযোগ্যভাবে দেশবাসীর কাছে নিজেদের আত্মসমালোচনা উত্থাপন করার পাশাপাশি ভবিষ্যৎ রূপকল্প সুনির্দিষ্টভাবে জনগণের সামনে আনাও জরুরি। তাহলে মানুষের মধ্যে আস্থা, ভরসা বাড়বে। কেবল হৈ-হৈ-রৈ-রৈ করে সরকারের পদত্যাগ দাবি করলেই হবে না। বিএনপিকে সামগ্রিক পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে : ২০১৮ সালের ১৬ অক্টোবর জেবেল রহমান গানির নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (বাংলাদেশ ন্যাপ) বিএনপি-জোট থেকে বেরিয়ে যায়। রাষ্ট্র পরিচালনায় সামগ্রিকভাবে পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে বিএনপির সঙ্গে আবারো কাজ করার প্রশ্নে ইতিবাচক জেবেল রহমান গানি। ঐক্য পশ্নে তার সাফ কথা- ‘আমরা এবার টোটাল প্যাকেজ চাই’। দেশের বর্তমান সমস্যা কেবল ঐক্য হলেই সারবে না। একটি নির্বাচনকেন্দ্রিক সমঝোতা বা একদিনের গণতন্ত্রে দেশের মানুষ বিশ্বাস রাখবে না। সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা, ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষায় সাংবিধানিক কী পরিবর্তন আনা সম্ভব, এ বিষয়ে বিএনপিকে স্পষ্ট প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করতে হবে। বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ আন্দোলনের বিষয়ে কোনো ‘ইতিবাচক অবস্থান’ না থাকলেও ‘রাজপথে কর্মসূচির মধ্য দিয়ে সরকার পতনের আন্দোলনের বিষয়ে ঐকমত্য’ রয়েছে জোনায়েদ সাকির নেতৃত্বাধীন গণসংহতি আন্দোলনের। দলের প্রধান এই সমন্বয়কারী জানান, তার দল মনে করে, চারটি দাবির ভিত্তিতে আগামী দিনে ‘আন্দোলন’ গড়ে উঠতে পারে। বর্তমান সরকারের পদত্যাগ, অন্তবর্তীকালীন সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল এবং ভোটাধিকার প্রয়োগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিতে হবে বিএনপিকে। ঐক্যের ভাবনা যেভাবে দেখছে শরিকরা : নতুন ঐক্য গড়ার আগে বিএনপিকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছ জোটের শরিকরা। বিশেষ করে অন্যতম শরিক জামায়াতে ইসলামীর বিষয়ে আগেভাগে কৌশল ঠিক করতে বলছেন শীর্ষ নেতারা। শরিক দলের কেউ কেউ বিএনপির এমন উদ্যোগ নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন। তারা মনে করছেন, অনেক দল আছে যারা নামসর্বস্ব, জোটে কিংবা রাজনীতির মাঠে তাদের ভূমিকা রাখার কোনো সক্ষমতা নেই। বিএনপি জোটের অন্যতম শীর্ষ নেতা এলডিপি প্রধান কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ বলেন, দুয়েকটি বড় রাজনৈতিক দল ছাড়া বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল নামসর্বস্ব। কোনটা আছে স্বামী-স্ত্রীর দল। তাই এসব দলের সঙ্গে বসলে রাজনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা কম। শুধু শুধুই সময় নষ্ট করা হবে। আপাতত এতটুকুই বলব। তবে বর্তমান জামায়াত নিয়ে আপত্তি করার কিছু নেই বলে মনে করেন অলি আহমেদ। তিনি বলেন, এখনকার যারা জামায়াতে আছে, তাদের মধ্যে তো যুদ্ধাপরাধী নেই। তাহলে তাদের নিয়ে আপত্তি কেন থাকবে! জোটের অন্যতম শরিক বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বলেন, বৃহত্তর ঐক্যে আমরা বিশ্বাস করি এবং এটি সমর্থন করি। জামায়াতকে জোট গঠন প্রক্রিয়ার বাইরে রাখলে জোটে টানাপড়েন বাড়বে কিনা- এমন প্রশ্নে সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বলেন, বিএনপি-জামায়াত অনেক পুরনো ও অভিজ্ঞ দল। বিশ্বাস করি, যেটা মঙ্গল হবে তারা তেমন সিদ্ধান্তই নেবে। এনপিপির চেয়ারম্যান ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, বিএনপির মতো আমরাও যুগপৎ আন্দোলনের সিদ্ধান্তে একমত। সে জন্য সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বিশেষ করে জামায়াতকে নিয়ে যাতে কোনো সমস্যা তৈরি না হয়, সেজন্য আগেভাগে কৌশল ঠিক করতে হবে। কারণ তাদের ছেড়ে দিলে সরকার নিয়ে নিতে পারে, তেমন ভয় তো এখনো আছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App