×

সাময়িকী

স্মৃতির পাতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিমু

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১২ নভেম্বর ২০২০, ০৭:৩০ পিএম

স্মৃতির পাতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিমু

হিমু উপন্যাসের নায়ক হিমু চরিত্রটি ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ তার হৃদয়ের বিশ্বকর্মাকে জাগ্রত করে অতি নিখুঁতভাবে নির্মিত করেছেন। তার লেখালেখিতে হিমু ও মিসির আলি চরিত্র সৃষ্টির জন্যই তিনি সাহিত্যাঙ্গনে অনেকদিন টিকে থাকবেন- এটি নিঃসন্দেহে বলা যায়। প্রকৃতপক্ষে হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে থাকতে এত খ্যাতি ও জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করেছিলেন বাংলাদেশে সাহিত্য জগতের অন্য কোনো লেখকের জীবনে এরকম ঘটেনি। তার জীবনে বই লিখে লক্ষ্মী দেবীর আশীর্বাদে শূন্য ঘড়া পূর্ণ হয়েছিল। এরকম দৃষ্টান্তও বাংলাদেশের অন্য কোনো লেখকের জীবনের ত্রিসীমানায় আসেনি। বলা যায় তিনি ক্যারিশমাটিক লেখক ছিলেন। পাঠকের অন্তরের পালস ধরতে পেরেছিলেন।

হুমায়ূন আহমেদ হিমু উপন্যাসে হিমালয় নাম থেকে হিমু চরিত্রের সৃষ্টি করেছেন। তিনি হিমু উপন্যাসে হিমুর বাবাকে একজন অস্বাভাবিক ব্যক্তি হিসেবে চিত্রিত করেছেন। বলা চলে হিমুর বাবা একজন বিকারগ্রস্ত ব্যক্তি। তার বিশ্বাস ছিল চিকিৎসক, প্রকৌশলী যদি প্রশিক্ষণ দ্বারা তৈরি করা যায় বা সৃষ্টি করা যায় তাহলে একজন মহাপুরুষও প্রশিক্ষণ দ্বারা তৈরি করা সম্ভব হবে। এই ধারণা থেকেই হিমুকে মহাপুরুষ তৈরির প্রশিক্ষণ দিতে থাকেন। হিমুর ঠাকুরদা হিমুর নাম রাখতে চেয়েছিলেন চৌধুরী ইমতিয়াজ টুটুল। কিন্তু হিমুর বাবা এই নাম না রেখে হিমালয় নাম রাখেন। পরে হিমালয় নামকে সংক্ষেপ করে হিমু নাম রাখেন।

হিমু চরিত্রকে হুমায়ূন আহমেদ একজন খামখেয়ালিপনা ব্যক্তি হিসেবে চিত্রপটে এঁকেছেন। আমাদের সামনে লেখকসত্তায় তার আবেগ অনুভ‚তির জগতের চৈতন্য দিয়ে হিমু চরিত্রটি অত্যন্ত বিচক্ষণতায় তুলে ধরেছেন। হিমুর পোশাক গেরুয়া বসনের প্রতীক হলুদ বর্ণের। যে পোশাক আমরা দেখতে পাই মরমী সাধন জগতের বাউলদের পরনে। এমন পোশাক ছিল হিমুর। পকেট ছিল না। পায়ে কোনো জুতা বা স্যান্ডেল থাকত না। মাঝে মাঝে মনে হয় এক ধরনের অতিপ্রাকৃত শক্তির দ্বারা হিমু পরিচালিত হয়। আবার মনে হয় এটি তার খামখেয়ালিপনা। তবে হিমুর আচার-আচরণ অস্বাভাবিক এবং বিশৃঙ্খল। কখনো মনে হয় হিমু আধ্যাত্মিক শক্তির দ্বারা পরিচালিত আবার কখনো মনে হয় এটা তার ভণ্ডামির মায়াজাল। রাত্রিতে সে ঢাকা শহরের রাস্তা দিয়ে খালি পায়ে একা একাই হেঁটে চলে। মানুষের সমস্যায় সে এগিয়ে আসে। আবার ভবিষ্যদ্বাণী করে মানুষের হৃদয়ে আলাদা জায়গা করে নিতে চায়। অনেক সময় হিমুর এই ভবিষ্যদ্বাণী মিলেও যায়। চাকরির সুযোগ থাকলেও চাকরি না করে হিমুরা সবসময় বেকার থাকে। মানুষের বিভিন্ন সমস্যায় তার আচরণ গোলকধাঁধার মতো। একটা ধোঁয়াশার সৃষ্টি করে। সমাজে হিমুর অনেক ভক্ত গড়ে ওঠে। তারা হিমুকে অসাধারণ গুণসম্পন্ন মহাপুরুষ হিসেবে দেখে। তার ফুফাতো ভাই বাদল তার অন্ধভক্ত। আবার অন্যশ্রেণির লোকেরা হিমুকে ভণ্ড বিভ্রান্তিকর লোক মনে করে। প্রকৃত কথায় হিমুর জীবন বাউণ্ডুলে। তবে লেখক হুমায়ূন আহমেদ হিমু চরিত্রকে আলো আঁধারির একটি মায়াজাল সৃষ্টি করে চরিত্রকে বিশেষায়িত করেছেন এবং এক নতুন মাত্রায় পাঠক সমাজের কাছে উপস্থাপন করেছেন।

হিমুদের সংসার থাকতে নেই। ভালোবাসতে নেই। মায়াবী প্রেয়সিনীর আঁচলে বাঁধা পড়তে নেই। এদের বয়স ১৮ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে হতে হবে। এরা মানুষের উপকারে এগিয়ে আসবে। এদের চেহারা সুন্দর না হলেও কোনো সমস্যা নেই। এদের চোখ সুন্দর ও মুখে হাসি থাকবে। সবসময় হলুদ পাঞ্জাবি পরা থাকবে তবে পকেটবিহীন। মাথায় চুল ও মুখে দাড়ি থাকবে। হিমু ঢাকা কলেজ থেকে পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে এমন বর্ণনা হিমু উপন্যাসে পাওয়া যায়। যেমন বাংলা সাহিত্যের অপরাজেয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্রীকান্ত চরিত্র তেমনি হিমু বাংলা ভাষার কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ সৃষ্ট জনপ্রিয় ও কল্পনার রাজ্যের একটি অসাধারণ গুণসম্পন্ন চরিত্র। লেখক হিমু হওয়ার জন্য অনেক উপদেশ দিয়েছেন সেগুলো নিম্নরূপ। এ জন্য অন্য এক কল্পনার জগতে প্রবেশ করতে হবে। মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসতে হবে। সত্য ও ন্যায়পথে থাকতে হবে। অসত্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। বৃষ্টির টাপুর টুপুরে ভিজতে হবে। চাঁদের সৌন্দর্যে অবগাহন করতে হবে। জোছনা দেখার আনন্দে মশগুল থাকতে হবে। এমনভাবেই হিমু চরিত্রের ডাক দেন লেখক হুমায়ূন আহমেদ হিমু উপন্যাসের সিরিজ গ্রন্থগুলোতে।

এক কথায় বলা যায়, হিমু চরিত্রটি লেখকের শৈল্পিক একটি চরিত্র আবার রহস্যময় জাদুকরী স্পর্শকাতর সত্তার একটি চরিত্র। কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক বলেই এমন চরিত্র লেখক সৃষ্টি করতে পেরেছেন। এ উপন্যাসের প্লট আকর্ষণীয়। আনন্দ ও আলো-আঁধারির মধ্য দিয়ে সুবিন্যস্তভাবে কাহিনীর স্তরগুলো লেখক পাঠকের সামনে উপস্থাপিত করেছেন। মানুষের জীবনের আশা-আকাক্সক্ষা, সুখ-দুঃখ, স্বপ্ন-স্বপ্নভঙ্গ, ঘৃণা-ভালোবাসা সবকিছুই উপন্যাসে উঠে এসেছে যা উপন্যাসকে সার্থক উপন্যাসে রূপান্তরিত করেছে। উপন্যাসের চরিত্রগুলো সৃষ্টিতে লেখক হুমায়ূন আহমেদ অত্যন্ত বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। তার লেখকসত্তা অত্যন্ত সংবেদনশীল। যেমন, হিমু চরিত্রটিতে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে তার মধ্যে ভালো-মন্দ, শুভ-অশুভ, সুনীতি প্রভৃতি গুণের সমন্বয়ে চরিত্রটি সৃষ্ট। হিমু উপন্যাসের সংলাপগুলো উপন্যাসের বাস্তবতাকে আরও বৈচিত্র্যময় ও নিশ্চিত করে লেখক আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন যা ঘটনাস্রোতে পাঠকের বিচারবুদ্ধির প্রকাশ ঘটাতে সহজ হয়। এ উপন্যাসের কাহিনী অত্যন্ত বাস্তবসম্মত। এরকম ঘটনা বাস্তবে ঘটেই থাকে। এ উপন্যাসে সৃষ্ট চরিত্রগুলোর মধ্যে বিশ্বাস, আচার, প্রথা, রীতি-নীতি, স্থান, কালের স্বাভাবিকতা বাস্তবধর্মী ও বিশ্বাসযোগ্য। এ উপন্যাসের ভাষাগত শৈলী, জীবন দৃষ্টি, উপস্থাপন, চরিত্রের স্বরূপ অত্যন্ত আবেদনবাহী। প্রকৃত কথায় লেখকের সৃষ্ট সাহিত্যের মধ্যে লেখক জীবনসত্তার বা জীবন দর্শনের অনিবার্যতা খুঁজে পাওয়া যায়। এক কথায় বলা চলে উপরিউক্ত আলোচনায় হিমু উপন্যাসটি অত্যন্ত সার্থক শিল্পরূপ। এটি মনস্তাত্তি¡ক উপন্যাসের একটি সার্থক ও উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

জনগণকে আকৃষ্ট করার জন্য হিমু সর্বদা ব্যস্ত থাকে এবং ভবিষ্যদ্বাণী করে মানুষের সামনে নতুন নতুন বিষয় উপস্থাপন করে যা হিমু চরিত্রের একটি আলাদা বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে। এখানে লেখক অত্যন্ত কৌশলে হিমুর মনস্তত্ত্ব দ্বন্দ্ব তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। হিমু চরিত্রটি কি সমাজের মানুষের ওপর প্রভাব ফেলতে পেরেছে? আমি মনে করি হিমুর মতো বয়সী ছেলেদের ওপর প্রভাব ফেলতে পেরেছে। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া কিছু কিছু ছেলেরা হিমুর মতো হলুদ পাঞ্জাবি পরে উদাসীনভাবে ঘুরে বেড়ায়। তারা নিজেকে অনেক জ্ঞানী মনে করে। কিছু মানুষ হিমুর অন্ধ ভক্ত হয়ে যায়। হিমুর মধ্যে একটা দ্ব›দ্ব সবসময় কাজ করে। হিমু ছেলেবেলায় একটি টিয়ে পাখি পুষেছিল। সেই টিয়ে পাখিকে হিমুর বাবা মেরে ফেলে। এ ধরনের আঘাত হিমুকে অত্যন্ত ব্যথিত করে। মায়ের স্নেহ হিমু পায়নি। মায়ের মমতার আঁচল হিমুকে স্পর্শ করেনি। এ জন্যই হিমু মানসিকভাবে সবসময় বিপর্যস্ত। ভিতরে ভিতরে মনস্তাত্তি¡ক দ্ব›েদ্ব হিমু দাহিত। হিমুর হৃদয়কে প্রতিদিন কুরে কুরে খায়। হিমুর বাবা মানসিকভাবে অত্যন্ত অসুস্থ। হিমুর মাকেও তিনি হত্যা করেছিলেন কাহিনীগুলো পড়ে এমন বার্তা পাওয়া যায়।

আমাদের চোখের সামনে অনেক হিমু দেখা যায়। যারা বাউণ্ডুলে অতিভৌতিক ধারণায় বিশ্বাস করে এবং অনেক ক্ষেত্রে অন্যের উপকারে ব্যস্ত থাকে; তারাই হিমুর পর্যায়ে পরে। তাদের পোশাক পরিচ্ছদে কোনো চাকচিক্য নেই। হলুদ বর্ণের পোশাক পরিধান করে। ‘যেখানে রাত সেখানেই কাত’ এ ধরনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মানুষই হিমু। কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদের শতাধিক বইয়ের মধ্যে এই ‘হিমু সিরিজের ধারাবাহিক উপন্যাস’ বাংলা সাহিত্যের জগত সংসারে দীর্ঘকাল বেঁচে থাকবেন বলে আমার বিশ্বাস।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App