×

সাময়িকী

জোছনা ও জননীর গল্প

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১২ নভেম্বর ২০২০, ০৭:১৭ পিএম

জোছনা ও জননীর গল্প

বাঙালি চেতনা ও মুক্তির মূল উৎস হলো মহান মুক্তিযুদ্ধ। এ সময়ের চিন্তা ও ঘটনার সমাবেশ হয়েছে বাংলা সাহিত্যে। এবং বৃহৎ পরিসরে বিবৃত হয়েছে নানান উপন্যাস। তাতে সমকালীন সাহিত্যের অনুষঙ্গ হিসেবে মুক্তিযুদ্ধও এসেছে। অন্য সাহিত্যিকদের পাশাপাশি কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ তা ধারণ করেছেন। তিনি সংলাপপ্রধান নতুনশৈলীর জনক। মুক্তিযুদ্ধের হতাশা বেদনা আনন্দ নিয়ে সাহিত্যচর্চা করেছেন তিনি। যা পারিবারিকভাবে তার শিরা-উপশিরায় অনুরণিত ছিল। তাই তার শৈল্পিকতা ও বুননকৌশলে বহুমাত্রিকতার স্পর্শ রয়েছে। উপন্যাসে বহিঃবাস্তব চিন্তা ও সংগ্রামী জনতার অংশগ্রহণ প্রকাশেও তিনি যতœশীল ছিলেন। যা তার উপন্যাসে বিধৃত হয়েছে রক্তঝরা কাহিনী এবং বিজয়ের ঝলকানি। বলাবাহুল্য তিনি ঐতিহ্যসচেতন ও বাস্তববাদী শিল্পী। তার অসামান্য উপন্যাস হলো- ‘জোছনা ও জননীর গল্প’।

উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ঐতিহ্যকে ধারণ করে নিজের ও তার সমকালীন বিষয় বিবৃত হয়েছে। ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ উপন্যাসটি ‘ ভোরের কাগজ’ এ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিতও হয়েছিল। লেখা বন্ধ হওয়ায় প্রকাশ বিরতি ঘটে কিন্তু তার অসুস্থ মানসে নাড়া দেয় সমাপ্তকরণের স্বাদ। কেননা লেখালেখি লেখকের আত্মতুষ্টি এবং সমাজের ঋণ বা দায়। প্রকৃত লেখকের মনে-চিন্তনে যা বিদ্যমান থাকে। সে দায়বোধ বা উদার মানসিকতা থেকে তিনি উপন্যাসে দ্বিতীয়বার হাত লাগান, ধারাবাহিকতা বজায় রেখে সমাপ্তও করেন। এবং কথাসাহিত্যে বিযুক্ত হয় মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস।

সত্য ও অভিজ্ঞতাকে ধারণ করে উপন্যাসের বিষয়বস্তু নির্মাণ করা ঔপন্যাসিকের কারুকাজ। তিনি তা নিবিড়ভাবে করেছেন। যা দেখা মেলে তার তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও আত্মনির্ভরতার মাধ্যমে। উপন্যাসের কাঠোমোয় তা আদৃত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়াদের পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক নিপীড়ন ও নির্যাতনের ধারাভাষ্য ফুটে উঠেছে স্বকীয় সচেতনতায়। অন্যান্য বিষয় বহুমুখী চিন্তন দক্ষতায় অনুসৃত হয়েছে। তার উপাদান সংগ্রহ, পরিবেশন দক্ষতা, বিশ্লেষী ভাব এবং নির্মাণকৌশল বেশ চমৎকার। যা পাঠককে টেনে নিয়েছে চেতনা ও ইতিহাস-ঐতিহ্যের দিকে। কালের ধুলা, ঐক্য-অনৈক্য নিরীক্ষণ করে জাতির অন্তঃকরণে ঝঙ্কার দিয়েছে। তাতে মনে হয়েছে তিনি ছিলেন সময়ের পর্যবেক্ষক।

যুদ্ধকালীন বাঙালির সাদামাটা জীবনপ্রবাহ ও বৈবাহিক জীবনযাপনের চিত্রও উপন্যাসে তুলে ধরা হয়েছে। শাহেদ ও আসমানী, কলিমউল্লাহ ও মাসুমা তারই চরিত্ররূপ। শাহেদের অগোছালো অফিস হলো সাদামাটা দৃশ্যের অবতারণা। শাহেদের স্ত্রী আসমানী রাগ করে বাসা ছেড়েছিল। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সে বাসা ত্যাগ করে। সামান্য কিছুতে সে রেগে যায়। বৈবাহিক জীবন ও শূন্যতা গ্রথিত হয়েছে। মাসুমা কলিমউল্লহ কবিতা রচনা রূপবদলের চিন্তা মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা প্রবাহকে ধারণ করে।

ব্যবসা হলো জীবন-জীবিকার অনন্য উপায়। ব্যবসায়ীরা ব্যবসা বুঝে; সময় বুঝে না। তাদের ধ্যানে ও মননে আর্থিক উন্নতি ভর করে। তাই তারা চষে বেড়ায়। মঈন আরেফি চরিত্রে এমনই লক্ষ করা যায়। সে ব্যবসায়ী মননে আর্থিক উন্নতির চিন্তা, দেশ মাটি এসবে বিবেকশূন্য, তাই শাহেদকে এবং ‘জয় বাংলা’ সম্পর্কে কট‚ক্তি করে। এবং তাতে খাবার জুটবে না বলে ইঙ্গিত দেয়। গৌরাঙ্গ ও শাহেদ দু’জনের আলাপ এবং অফিস বিক্রি করে ব্যবসা গুটিয়ে মঈন আরেফি করাচি যাচ্ছে। তখন অনেকেই এভাবে পালিয়েছিল। তা উপজীব্য হয়েছে উপন্যাসের কথনে। দেওয়ান চরিত্রে মাধ্যমে বাঙালির মধ্যে যারা সংগ্রামকে কট‚ক্তি করছে। তা দেখে তিনি যে চিত্রাভাষ্য দেখিয়েছেন। তাতে অনুষঙ্গ আরও স্পষ্ট হয়েছে।

বাংলাদেশের পতাকা লাখো শহীদের রক্তে রঞ্জিত। ইরতাজউদ্দিন স্কুলের রং জ্বলা পতাকা পরিবর্তন করে কিন্তু পতাকা বদল হবে সে বিষয়ে সন্ধিহান। সে পতাকা বদল এবং দেশ স্বাধীনের সাথে হিন্দুর গোলামির কথা নিয়ে আসে। তার মগজে গেঁথে আছে চান তারা পতাকা। মূলত সে আধুনিক হলেও তার উন্নত চিন্তার অভাব রয়েছে। কিন্তু হেড মাস্টারের মাতৃটান প্রবল তাই নিয়মের দোহাই দেয় এবং পূর্ববাংলার দুঃখ দুর্দশা টেনে পতাকার প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করেছে। তার চিন্তনে রয়েছে বদলের। অথচ পতাকা হবে স্বাধীন বাংলাদেশের। হত্যা ও ধ্বংসের উৎসবে মেতেছিল পাক হানাদার বাহিনী। চারদিকে গুলি ও বারুদের শব্দ, রাস্তাঘাট জনশূন্য। চোখের সামনে ধ্বংস দেখে বারান্দায় এগিয়ে আসছে মানুষ। তারা সাধারণ মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। আগুনে আলোকিত সারা শহর। জ্বলছে আগুন পুড়ছে শহর ও মানুষ। হঠাৎ তা বন্ধ হয়েছিল।

রাস্তাঘাট মানুষ শূন্য নয় কুকুর শূন্যও হয়ে গেল। জাতির পিতার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে সবাই প্রস্তুত ছিল হঠাৎ সব থেমে গেল। কোথাও কেউ কিছু জানে না। সেদিনের বিভেষিকাময় কাহিনী ব্যক্ত হয়েছে। মেধাবী ও উদ্যমী, বলিষ্ঠ ও সংগ্রামী জনতার ভিড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের খোঁজা হচ্ছিল। যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চল ছেড়ে পলায়ন করে মানুষ। সবকিছুর মায়া ত্যাগ করে যাযাবরের জীবনও গ্রহণ করে, খোঁজে আশ্রয়ের অনুসন্ধান। বসবাসের নিরাপদ স্থান। লেখকের পরিবারও দেশ ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার বাবা ছিলেন ফয়জুর রহমান মা আয়শা বেগম তারা কলকাতায় যাত্রার প্রস্তুতি নিয়েছে। যাবার রাস্তা সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে। অনেকে যাত্রী হবে। জলদস্যুদের আক্রমণ ও মিলিটারিদের খবর ও টহল দিচ্ছে। আয়শা বেগম এমতাবস্থায় পাড়ি দিতে অসম্মত। তার ছেলেকে নিয়ে তিনি চিন্তিত। বর্ণনা এরকম- “পিরোজপুর শহর থেকে পনেরো-ষোলো মাইল দূরের অজ পাড়া গাঁ। নদীর পাশে ছোট গ্রাম। নদীর নাম মনে নেই- বলেশ্বর বা রূপসা হতে পারে। নদী যেমন সুন্দর, গ্রামটা তার চেয়েও সুন্দর। নারিকেল আর সুপারি গাছ দিয়ে অতি যতে্ন কে যেন এই গ্রাম সাজিয়ে দিয়েছে। ভরা বর্ষা- থৈ থৈ করছে নদী। জ্যোৎস্নারাতে আলোর ফুল ঝরে ঝরে পড়ে। কিছু ফুল আটকে যায় গাছের পাতায়। সব মিলিয়ে পুরো ব্যাপারটা স্বপ্নদৃশ্যের মতো। এই স্বপ্নদৃশ্যে আমি আমার মা এবং ভাইবোনদের নিয়ে বাস করছি। আমাদের মধ্যে কোনো স্বপ্ন নেই।”

মা ছেলেদের জন্য কাঁদছেন। তারা দু’জন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তারা রাইফেল নিয়ে দৌড়ায় তাই মিলিটারিরা তাদের হাতছাড়া করবে না। হত্যার মহোৎসব শুরু হয়েছে। শেষ আশ্রয় হওয়া সত্তে¡ও আয়শা বেগম অনিশ্চিত ছিলেন। হিন্দুরা বেশি আতঙ্কিত ছিল। ধরা পড়লে তাদের রক্ষা ছিল না। স¤প্রীতির দেশে পাক হানাদার বাহিনী লাফিয়ে লাফিয়ে মানুষ হত্যা করছে। বাঁচার জন্য ছুটছে বাঙালি। লেখকরাও স্থানান্তরিত হচ্ছেন কিন্তু ভরসা পাচ্ছেন না। বারবার স্থান বদল করছে। তাদের সহায়তা করছে মাওলানা সাহেব। নৌকায় ফিরায় পথে দম্পতি ও সন্তানের লাশ দেখে বিস্মিত হয়েছেন। লেখক বেশি বিস্মিত হয়েছে স্বাধীন দেশে যখন পাকসেনাদের দোসরকে স্বাধীনতা পদক দেয়া হয়েছে। এ ঘটনা দুঃখের ও অনুশোচনার।

কবে ফিরবে? স্বাধীন না করে ফিরবে না। এমন প্রত্যয় নিয়ে বের হয়েছিল বীর বাঙালি। দীর্ঘ নয়মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর, স্ত্রী-সন্তান এবং পুত্র হারিয়েছে। কেউ ফিরে এসেছে কেউ পেয়েছে কেউ পায়নি। ১৪ ডিসেম্বর মরিয়ম স্বপ্ন দেখল। সবাই ঘুমে আচ্ছন্ন সে জেগে আছে। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর স্ত্রীর সাথে স্বামীর সাক্ষাৎ দেখান হয়েছে। মরিয়ম ও নাইমুল চরিত্রের মাধ্যমে। এভাবে কত পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়েছে বা সংশয় নিয়ে বাড়ি ফিরছে। ধীরে ধীরে মুক্তির সুবাতাস পাচ্ছে। কিন্তু ফিরেনি স্বামী ও স্ত্রী পুত্র বা স্বজন। কেবল স্বপ্ন ও কল্পনা প্রসূত হয়েছে। তবুও ধমনী উজ্জীবিত হয়েছে কারণ মাটি হায়েনামুক্ত। মুক্তিবাহিনীর সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে ইন্ডিয়ান বাহিনী। পাক হানাদার বাহিনী বিপর্যস্ত হয়ে সীমানা ছাড়তে বাধ্য। সে চিত্ররূপ লেখক বাস্তবতার সাথে সঙ্গতি রেখে উপস্থাপন করেছেন। ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস। দীর্ঘ ক্ষরণের পর দেখা গেল স্বাধীনতার সূর্য। পাক হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণের পথ বেঁচে নেয়। সেখানে সাহসী ভূমিকা রেখেছে বাঙালি বীর সেনানী। জেনারেল নিয়াজী যে চিরকুট গ্রহণ করেছে। তাদের পরাস্ত করেছে কাদের সিদ্দিকীর মতো দেশপ্রেমিক। যার উপাধি বঙ্গবীর। সেসময় তার চুল লম্বা থাকায় তাকে চে-গুয়েভারার মতো মনে হতো। জেনারেল নিয়াজী করমর্দনের জন্য হাত বাড়ালে তিনি মুখের উপর বললেন নারী ও শিশু হত্যাকারীদের সাথে তিনি করমর্দন করেন না। তার মধ্যে ত্যাজ ছিল তাই তা সম্ভব হয়েছে। লেখক তখন ঢাকায় অবস্থান করছেন। স্বাধীনতার পর সব মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল। প্রিয়জনের শূন্যতা ও স্বাধীনতার পূর্ণতা তারা উপভোগ করতে লাগল। সববয়সী মানুষ জয় বাংলা স্লোগানে রাজপথ প্রকম্পিত করছে। কিন্তু স্বামী হারানোর বেদনা মরিয়মের মধ্যে রয়ে গেল। নাইমুল আসার কথা থাকলে সে আসেনি। মরিয়মের বিশ্বাসকে সতেজ রাখতে তাকে আশ্বস্ত করেছেন কিন্তু পরিণতি তাকে বিধবাই করেছে। কাহিনীর সম্পূর্ণতা ও রসামৃত করতে লেখক দু’জনের মিলন দেখালেও তা যে অসম্ভব তিনি তা ব্যাখা করেছেন। বাস্তবতাকে ধারণ করেন। কারণ নাইমুলের মতো বাস্তবে অনেকে ফেরেনি। কিন্তু তাদের সমাধি হয়েছে দেশের জন্য তাই আশ্রয়দাতা হয়েছে জোছনা এবং বাংলার উন্মুক্ত প্রান্তর। বাংলার মাটি তাদের হৃদয়ে ধারণ করেছে। মূলত তিনি বীর সন্তানদের বীরত্বকাহিনী উপস্থাপন করেছেন।

বলাবাহুল্য, সেদিন যে অরাজকতা সৃষ্টি হয়েছিল, বাঙালির আত্মশক্তিই বিজয় অর্জনের বড় বিষয়। রাতে আক্রমণ ও জননীর বুক বিদীর্ণ করলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব, চিন্তানায়কদের অনুপ্রেরণা এবং বীর বাঙালির আত্মশক্তি ছড়িয়ে পড়েছে। ধূলি ধূসরতায় উপ্ত হয়েছে স্বাধীনতার বীজ। মুক্ত হয়েছে দেশ ও সমাজ। নিজস্ব চিন্তা ও পরিকল্পনার জগৎ তৈরি হয়েছে। ঔপন্যাসিক আন্তঃসম্পর্ক ও সময়কে ধারণ করে সাহিত্য ভাষায় তা প্রকাশ করেছেন। এখানে তার মানসিকতা ও আত্মার পর্যবেক্ষণ হয়েছে। প্রজন্ম পেয়েছে নিজস্ব ও মৌলিক নেশনালিজম। কথাশিল্পী তার দায়বোধ থেকে মুক্ত হয়ে প্রজন্মের প্রাত্যহিক সম্পর্ক বেঁধেছেন। এ যেন- সন্তান ও জননীর, জোছনা ও জননীর, ইতিহাস ও বাস্তবতার এবং বাংলা ও বাঙালির অভ্যুদয়ের সমাহার।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App