×

সাময়িকী

হাস্নাহেনার পরশের হাসনাত ভাই

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ নভেম্বর ২০২০, ১০:১৪ পিএম

হাস্নাহেনার পরশের হাসনাত ভাই

প্রয়াণের খবরটি প্রথম দিল শামীমই- বেশ সন্তর্পণেই। কারণ প্রয়াত মানুষটির সঙ্গে আমার নৈকট্য ও ঘনিষ্ঠতার কথা সে জানে। শামীমের কথাগুলো কেমন যেন ইথারে ভর করে কেটে কেটে আমার হৃদয়ে পৌঁছুল- ‘নেই .... নেই ... হাসনাত ভাই .... আর ..... নেই’। এই শব্দগুচ্ছ আমার মাথায় এক বায়বীয় শূন্যতার সৃষ্টি করল- কেমন এক ভোঁতা ব্যথা ছড়িয়ে পড়ল আমার সারা চেতনায়। আমি দৃষ্টি ছড়িয়ে দিলাম জানালা পেরিয়ে রাস্তার ওপারের সবুজ পাতার গাছের মাথায় আর সময় যেন ঘুরতে লাগলো পেছনে আরে পেছনে। মধ্য-আশির দশকে ঢাকায় ব্যস্ত ছিলাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতা ও নানান উপদেষ্টা-পরামর্শকের কাজ নিয়ে। সেই সঙ্গে মেতে ছিলাম টেলিভিশন, রেডিও, সংবাদপত্র ও নানান অনুষ্ঠান নিয়ে। আড্ডারও কমতি ছিল না। একদিন তদানীন্তন জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনীর (আমার বইয়ের প্রকাশক) কর্ণধার মফিদুল হকের দপ্তরে পরিচয় হলো দৈনিক সংবাদের সাহিত্য সাময়িকী সম্পাদক আবুল হাসনাতের সঙ্গে- আমাদের ছাত্রজীবনে যাকে মাহমুদ আল জামান নামে জানতাম। হাসনাত ভাই বললেন, ‘সামনেই বাইশে শ্রাবণ। সাময়িকীর বিশেষ সংখ্যা বেরুবে। রবীন্দ্রনাথের ওপর একটা লেখা দিন না।’ ভাগ্যক্রমে তখন ‘রবীন্দ্রনাথের অর্থনীতি-চিন্তা’ বলে একটা বড়সড় গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখছিলাম। সেখান থেকে একটা অংশ নিয়ে লিখে ফেললাম ‘রবীন্দ্রনাথের গ্রামোন্নয়ন চিন্তা’। বিশেষ সংখ্যায় পূর্ণ পাতা জুড়ে বেরুল সে লেখা। তারপর কিছুদিন পর পরই সাময়িকীতে লেখা দিতে থাকলাম- তবে মূলত সমাজ, রাষ্ট্র, অর্থনীতি বিষয়ে। পরে অবশ্য কবি মোহাম্মদ রফিকের উৎসাহ অনুপ্রেরণায় সাহিত্য বিষয়েও ঢুকে পড়লাম। জাতীয় কবিতা উৎসবের পরে রফিক ভাইয়ের প্ররোচনায় লিখলাম ‘কবিতার ভবিষ্যৎ’। সেই প্রথম চারকোলের কাজ করা শিরোনাম অলঙ্করণে সাহিত্য সাময়িকীর প্রথম পাতায় বেরুল সে লেখা। কিছুদিন পরে হাসনাত ভাই বললেন, ‘একটা কলাম লিখতে শুরু করুন না’। জনান্তিকে শুনেছি, হাসনাত ভাইয়ের সহকর্মী সন্তোষ দা (প্রয়াত সন্তোষ গুপ্ত) হাসনাত ভাইকে বলেছিলেন, ‘ওকে দিয়ে কলাম লেখান। কলমের জোর আছে।’ কলামের নাম ঠিক করলাম, ‘কড়ি-কড়চা’। তারপর দীর্ঘ পাঁচ বছর ওটা লিখেছি। প্রতি মাসের এক পক্ষে লিখতেন মনজুর ভাই (সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম) সাহিত্য বিষয়ক কলাম ‘অলস দিনের হাওয়া’, অন্যপক্ষে বেরুত আমার সমাজ, রাষ্ট্র ও অর্থনীতি বিষয়ক কলাম ‘কড়ি-কড়চা’। ক’দিন পরেই বুঝলাম, নিয়মের কি গ্যাঁড়াকলে আটকা পড়েছি আমি। মাঝে মাঝেই লেখা দিতে দেরি আমার। আমার মজ্জাগত আলসেমিই আমাকে গ্রাস করে। সময়মতো লেখা না দিয়ে হাসনাত ভাইকে অনেক সময়েই বিপদে ফেলেছি। কিন্তু কখনো তাকে জিজ্ঞেস করা হয়নি কেমন করে তিনি সামাল দিয়েছেন। একবার অবশ্য সন্তোষ দা’র (সন্তোষ গুপ্তের) পরামর্শে আমাকে আহমেদুল কবীর সাহেবের কক্ষে আটকে রেখে ‘এক কাপ চা ধরাইয়া দিয়া’ (সন্তোষ দা’র ভাষায়) লেখা আদায় করেছিলেন হাসনাত ভাই। আমার লেখালেখির এক মুখ্য উদ্দীপক ছিলেন হাসনাত ভাই- আমার সম্পাদক আবুল হাসনাত। তিনিই আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছেন। ঐ তার এক বিরাট গুণ। তিনি লেখক তৈরি করতে পারতেন- অনেকটা সন্তোষ কুমার ঘোষ বা বিমল করের মতো। আমাদের ঘনিষ্ঠতা ও শখ্যের শুরু ঐ লেখালেখি থেকেই। প্রায়শই আড্ডা দিতে যেতাম মফিদ ভাইয়ের দপ্তরে বা হাসনাত ভাইয়ের কক্ষে। বহুদিন আমরা তিনজন কাছের বাংলা খাবারের দোকানে দুপুরের খাবার খেতে যেতাম। বেনুর সঙ্গে কথা বলতেন নানান বই নিয়ে। পহেলা বৈশাখে বা বইমেলায় রোদেলা মেখলাকে আদর করতেন। মিনু আপার (তার স্ত্রী নাসিমুন আরা হক) ছোট ছোট লেখা আমার ভালো লাগতো। একবার তার লেখা পড়েই জেনেছিলাম যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের একতলায় মধুর ক্যান্টিনের দিকে সমাজ নিরীক্ষণ কেন্দ্রের দেয়ালঘেঁষা বহু পুরোনো ত্রিভঙ্গ মুরারী গাছটি হচ্ছে অশোক ফুলের। সে গাছে পরবর্তী সময়ে লাল লাল অশোকগুচ্ছ দেখেছি। হাসনাত ভাই ‘কালি ও কলমে’ চলে যাওয়ার পরে বহুবার বলেছেন লিখতে। সময় করতে পারিনি। এ নিয়ে তার একটি অনুযোগও ছিল। ক’বছর আগে নিউইয়র্কে দিথির বাড়িতে বেড়াতে এলে বহুক্ষণ গল্প করেছিলাম ফোনে। সামনাসামনি তিনি আমার লেখার প্রশংসা করেননি। সম্পাদকের নির্মোহ ব্যবহারে বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। কিন্তু লোকের কাছে তিনি আমার লেখার ভ‚য়সী প্রশংসা করেছেন। তারই পরামর্শে মফিদ ভাই আমার ‘কড়ি-কড়চার’ লেখা কুড়িয়ে বাড়িয়ে চার-চারটি বই প্রকাশ করেছেন। গত বছর যখন ঢাকায় কথা হয়, তখন আমার কাছেই আমার লেখার ভীষণ প্রশংসা করেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, সমাজ-রাষ্ট্র-অর্থনীতির মতো খটমটো বিষয়ে অমন সোজা করে ঝর ঝরে গদ্যে আর কোনো লেখকের দেখা পাননি তিনি। আমার লেখালেখির ক্ষেত্রে অমন বড় প্রশস্তি আমাকে আপ্লুত করেছিল- বিশেষত আবুল হাসনাতের মতো সম্পাদকের কাছ থেকে। তিনি বলেছিলেন, আমার বহু লেখার আবেদনী সার্বজনীন এবং সে সব লেখা নিয়ে ‘বেঙ্গল’ থেকে একটি বই বার করতে ভীষণভাবে চেয়েছিলেন তিনি। হয়নি তা এবং হবেও না তা আর। বড় ভালো মানুষ ছিলেন হাসনাত ভাই- ভদ্র সজ্জন, বিশাল মনের মানুষ। তিনি ছিলেন নিভৃতচারী, মৃদুভাষী ও আত্মপ্রচারবিমুখ। তার চুল, চেহারা ও সোনালি গোলাকৃতি চশমায় তাকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো লাগতো আমার। বিশেষ করে আমাকে আকর্ষণ করতো তার চোখের তীব্র ঔজ্জ্বল্য। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে তার চেহারায়, চরিত্রে ও ব্যবহারে হাস্নাহেনার মতো একটি কোমল পরশ ছিল- যে পরশের স্নিগ্ধতায় সিক্ত হয়েছে আমার জীবনও।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App